- মো. হারুন-অর-রশিদ
- ১৪ জুলাই ২০২৩, ১৯:৩৯
আওয়ামী লীগ নেতাদের মুখে ইদানীং বেশ জোরেশোরেই একটি কথা শুনতে পাওয়া যায় আর তা হলো, ‘আওয়ামী লীগ কাউকে ভয় পায় না, আমাদের ঈমানের শক্তি আছে, দেশপ্রেম আছে। আওয়ামী লীগের শক্তির উৎস এ দেশের জনগণ।’ ২০০৮ সাল থেকে টানা পনের বছর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়, এর পেছনের শক্তি কী? এক কথায় এর জবাব হওয়া উচিত ‘জনগণ’। জনগণের শক্তি না থাকলে কিভাবে বিরোধী শক্তির কোনো বড় ধরনের ঝামেলা মোকাবিলা না করেই এক ধরনের শান্তিতেই রাষ্ট্র পরিচালনা করে যাচ্ছে আওয়ামী লীগ? তবে এই প্রশ্নের উত্তর খালি চোখে এত সহজ হলেও এর ভেতরে লুকিয়ে আছে গূঢ় তত্ত্ব। কারণ ২০০৮ সালের নির্বাচন ছিল একটি ম্যানেজড নির্বাচন। কারণ ২০০৭ সালের ১২ জানুয়ারি ফখরুদ্দীনের নেতৃত্বে ১৩ সদস্যবিশিষ্ট উপদেষ্টামণ্ডলীর সমন্বয়ে যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল, সাংবিধানিক ধারা লঙ্ঘন করে দুই বছর ক্ষমতায় ছিলেন। মূলত সেনা সমর্থিত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রচণ্ড দোর্দণ্ড প্রতাপে দেশ চালিয়ে ছিলেন।
সেনাবাহিনীর সমর্থনে ওই সময় গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে ফখরুদ্দীন আহমেদ থাকলেও ক্ষমতার মূল কেন্দ্রে ছিলেন তৎকালীন সেনাপ্রধান মঈন ইউ আহমেদ। মূলত সবকিছু তার ইশারাতেই পরিচালিত হতো। এই দুই বছর সময়ের মধ্যে প্রথমে তারা তাদের কর্মকাণ্ডে জনগণের সমর্থন থাকলেও পরবর্তীতে তারা জনগণের কাছে ধিকৃত হতে থাকে। কারণ তারা দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে যেমন ব্যর্থ হয়েছিল, তেমনি অতিমাত্রায় রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের প্রতি হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের দরুন জনগণ তাদের প্রতি ক্ষিপ্ত হয়েছিল। বিশেষ করে মাইনাস টু ফর্মুলাকে জনগণ কোনোভাবেই মেনে নিতে পারেনি। ফলে তারা নির্বাচন দিতে বাধ্য হয়েছিল। রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এসে যেন তাদের এই দুই বছরের অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেয় সেই নিশ্চয়তা চেয়েছিল। তাদের এই প্রস্তাবের সাথে বেগম খালেদা জিয়া একমত হতে পারেন নাই। তিনি অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের বৈধতা দিতে সম্মত হন নাই। কিন্তু সেই সুযোগটা নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা। তিনি প্যারোলে মুক্তি পেয়ে বিদেশ যাত্রাকালে বিমানবন্দরে ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি ক্ষমতায় গেলে ফখরুদ্দীন-মঈন উদ্দিনের সব অসাংবিধানিক কর্মকাণ্ডের বৈধতা দেবেন। শেখ হাসিনা সেদিন অসাংবিধানিক উপায়ে প্রায় দুই বছর ক্ষমতায় থাকা সেনাসমর্থিত ফখরুদ্দীনের সব কর্মকাণ্ডের বৈধতাদানের মুচলেকা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সত্যিই সত্যিই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারীদের কাউকে বিচারের মুখোমুখি করেননি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সংবিধানের অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধারা সংশোধন করেন। আদালতকে ব্যবহার করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মতো সর্বজন সমর্থিত নির্বাচনকালীন সরকারব্যবস্থা বাতিল করেন। এমনকি সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ কোনো ধারা বাতিল করতে হলে জনমত নেওয়ার জন্য যে গণভোটের বিধান ছিল তাও সংবিধান থেকে তুলে দেন।
জনগণের কাছে ওয়াদা করেছিল, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে ঘরে ঘরে চাকরি দিবে, ১০ টাকা কেজি দরে চাল খাওয়াবে। কিন্তু ক্ষমতায় আসার পর সবকিছুই ওয়াদার বিপরীত হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের সন্তান না হলে কারো চাকরি যেমন হয়নি তেমনি দশ টাকার পরিবর্তে মানুষকে এখন সত্তর টাকা কেজি দরে চাল কিনে খেতে হচ্ছে। সব ধরনের দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষের ক্রয়সীমা অতিক্রম করেছে অনেক আগে। তেল, বিদ্যুৎ, গ্যাসের দাম কয়েক দিন পরপর বৃদ্ধি করতে করতে করতে অসহনীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছে। গোটা রাষ্ট্রযন্ত্রকে এমনভাবে আওয়ামীকরণ করেছে যে, এর বাইরে যে কথা বলবে তার জন্য অপেক্ষা করে আওয়ামী লীগের লগি-বৈঠার পিটুনি অথবা লাল দেয়াল। পিয়ন থেকে চাপরাশি, কেরানি থেকে সচিব সবই আওয়ামী বন্দনায় মত্ত। অফিস আদালতের ছত্রে ছত্রে ঘুষ-দুর্নীতির এক মহারাজ্যে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লীগের কর্মী থেকে শীর্ষ পর্যন্ত সবাই টাকার কুমিরে পরিণত হয়েছে। খুন, ধর্ষণ, রাহাজানি, অর্থপাচার তাদের কাছে মামুলি ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। জবাবদিহির বালাই নেই বললেই চলে।
প্রশ্ন আসতেই পারে, আওয়ামী লীগ এত বেপরোয়া কিভাবে হলো? আওয়ামী লীগ এত বেপরোয়া হওয়ার পেছনের কারণ হলো, তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়নি। ২০১৪ সালে জনগণ তাদেরকে ভোট দেয়নি আর ২০১৮ সালে মানুষের ভোট রাতের আঁধারে কেড়ে নিয়ে তারা ভোট চোর, ভোট ডাকাতের তকমা পেয়েছে। সাধারণত ডাকাতরা কাউকে ভয় পায় না বরং ডাকাতের নাম শুনলে সবাই ভয় পায়। এক ধরনের নির্লজ্জের মতোই আওয়ামী নেতারা বলেন, তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েছে। হ্যাঁ ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে দু’টি সাধারণ নির্বাচন হয়েছে বটে, দেশের জনগণ এবং আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে সেসব নির্বাচনের স্বচ্ছতা, নিরপেক্ষতা এবং গ্রহণযোগ্যতা কতটুকু পেয়েছে সেটা একবারও ভেবে দেখে না। সেই সঙ্কটই আজকে মহীরুহ আকার ধারণ করেছে। দল হিসেবে আওয়ামী লীগের গায়ে ভোট চোর, ভোট ডাকাতের তকমা লেগে গেছে। জনগণের কাছে তাদের কোন জবাবদিহি নেই। তারা মনে করে, এই রাজ্যের একমাত্র সিংহ তারাই যার কারণে তাদের মনে যা ইচ্ছা হয়, তারা তাই করে ফেলছে। আইন আদালত তাদেরকে স্পর্শও করতে পারছে না। এই সুযোগ নিয়ে তারা রাষ্ট্র এবং রাষ্ট্রের জনগণকে স্বৈরতন্ত্রের মোড়কে আটকে ফেলেছে।
আজকের এই নির্বাচনী রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্য বিচার বিভাগ দায় এড়াতে পারবে না। বরং সঙ্কটটা সেখান থেকেই সৃষ্টি হয়েছে। কৌশল করে আওয়ামী লীগের ১৭৩ দিনের হরতালের ফসল নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল করার জন্য আদালতকে ব্যবহার করেছে। আদালত সেদিন জনগণের দোরগোড়ায় না গিয়ে শুধুমাত্র দলীয় অন্ধত্বের ছায়াতলে আশ্রিত হয়ে সংবিধান থেকে এটি বাতিল করে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করার ব্যবস্থা করে দেয়। অথচ এই মামলায় শুনানির জন্য যাদের অ্যামিকাস কিউরি নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল তাদের মধ্যে টিএইচ খান, ড. কামাল হোসেন, আমীর-উল ইসলাম, মাহমুদুল ইসলাম ও রোকনউদ্দিন মাহমুদ তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা বহাল রাখার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। তবে রফিক-উল হক ও এম জহির তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। আরেকজন অ্যামিকাস কিউরি আজমালুল হোসেন কিউসি বলেছিলেন, তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এখানেও সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামত উপেক্ষা করে, বিচারপতি খাইরুল হক অবসরে থাকা অবস্থায় রায় দিয়েছেন। অথচ তিনিই তার সংক্ষিপ্ত রায়ে দেশের সার্বিক অবস্থা বিবেচনা করে আরো দুই দফা (টার্ম) এ ব্যবস্থা বহাল রাখার কথা বলেছিলেন। কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রায়ে তিনি তার সংক্ষিপ্ত রায়ের কথা না বলে পুরো ব্যবস্থাটাই বাতিল করার রায় দিয়ে রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি করে দিয়ে গেছেন। পুরস্কার হিসেবে বিচারপতি খাইরুল হক অবসরের পর আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছিন। সুবিধা ভোগের কারণে রাষ্ট্রে যে ক্ষত সৃষ্টি করে গেছেন তা থেকে রাষ্ট্র কোনো দিন মুক্তি পাবে কিনা তা আজ প্রশ্নবোধক হয়ে রইল।
সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে গোটা রাষ্ট্রযন্ত্র আজ আওয়ামী লীগ সরকারের কাছে মাথা নত করতে বাধ্য হয়েছে। পুলিশ, সেনাবাহিনী, প্রশাসনের নগ্ন হস্তক্ষেপে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে নির্বাচন নামের প্রহসনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসেছে। এটা গোটা জাতি এবং আন্তর্জাতিক বিশ্বের কাছে পরিষ্কার। সুতরাং, ‘আওয়ামী লীগের ঈমানের শক্তি আছে, দেশপ্রেম আছে। আওয়ামী লীগের শক্তির উৎস এ দেশের জনগণ।’ এ কথা বিশ্বাস করার মতো কোনো কারণ নেই। আওয়ামী লীগকে তাদের এই কথা সত্য প্রমাণ করতে হলে, একটি নিরপক্ষে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন দিয়ে বিজয়ী হয়ে প্রমাণ করতে হবে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা আছে।