আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল না হয় ডামি প্রার্থী জিতবেন

বর্তমানে যা হচ্ছে এটাকে নির্বাচন ভাবার কোনো কারণ নেই। এ পরিস্থিতির জন্য সরকারি দলই দায়ী। দিনভর দলটির মন্ত্রী-নেতারা যেভাবে অসত্য বলে যাচ্ছেন তাতে তারা জনগণকে বেকুব মনে করছেন। ২০১৪, ২০১৮’র নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হয়নি বলেই তারা বর্তমান নির্বাচন নিয়ে আরেক ধরনের ধোঁকা দেয়ার জন্য সাজানো ব্যবস্থা তৈরি করেছে। রাজনীতি এখন চলে গেছে পেশিশক্তির দখলে। হলফনামায় দেয়া সম্পদের যে হিসাব প্রকাশ হয়েছে তাতে এমপি, মন্ত্রী হওয়া যেন এখন লাভজনক বিনিয়োগ। রাজনীতিকরা এই রাষ্ট্রের জন্মের অঙ্গীকারের কথা ভুলে গেছেন। সত্তরের নির্বাচনকে অসম্মান করার জন্যই এদেশে সশস্ত্র যুদ্ধ হয়েছিল। স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও একটি নীতিসিদ্ধ নির্বাচনী ব্যবস্থা না হওয়ার দায় রাজনীতিকদেরই। মানবজমিনকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে বলছিলেন সময়ের বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, নিউএজ সম্পাদক নূরুল কবীর।

দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে উঠে আসে বর্তমান নির্বাচন পরিস্থিতি, মার্কিন নিষেধাজ্ঞা, ৭ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর দেশের পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে?

প্রশ্ন: নির্বাচন হতে যাচ্ছে। বিরোধীরা বলছে নির্বাচনের নামে নাটক হচ্ছে, অন্যদিকে সরকারি দল বলছে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের চেষ্টা চলছে- কীভাবে দেখছেন?
উত্তর: প্রশ্নটি সবার জন্য অত্যন্ত বেদনাদায়ক। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক নানাদিক থেকে আমরা হতাশাব্যঞ্জক পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছি। নির্বাচনে হার-জিতের ব্যাপার থাকে। সরকারি দলের পক্ষ থেকে এই নির্বাচন ব্যবস্থাকে এবার যেভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে; নিজেদের জোটের প্রার্থীদের যেভাবে সিট বিতরণ করা হয়েছে; সরকারি দল যাদেরকে যেখানে দিবে তাতে কেউ হারবে না। কারণ হচ্ছে, এখানে একদিকে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন যারা এখন নির্বাচনের নামে একটা ডামি পদ্ধতির মধ্যে অংশগ্রহণ করছেন। আর এটাকে যারা নির্বাচন মনে করছেন না বলে দাবি করে এর বাইরে আছেন বিএনপি নেতৃত্বাধীন আরেকটা পক্ষ। দু’পক্ষই জনগণের একটা বিরাট অংশের প্রতিনিধিত্ব করে। যারা আওয়ামী লীগ শিবিরের তারা এটাকে নির্বাচন বলবেন আর যারা বিরোধী শিবিরের তারা এটাকে নির্বাচন বলবেন না। কিন্তু আমরা কী বলবো? আপনি আমি কি ২০০৮ সালের পরে ইচ্ছা করলেই ভোট দিতে পারতাম? না। ২০০৮ সালের পর যে তরুণ-তরুণীরা নতুন ভোটার হয়েছে সেই সংখ্যা প্রায় ৩ কোটি। এই তিন কোটি তরুণ-তরুণী ২০০৮ সালের পর থেকে তার বয়স বাড়ার কারণে নতুন ভোটার হয়েছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তখন থেকে ক্ষমতায়। তারা এমন কোনো নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে পারেনি যে কারণে বিপুল উদ্দীপনা নিয়ে এই তরুণ-তরুণীরা ভোটে অংশ নেবে। কারণ কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, প্রতিযোগিতামূলক ভোটের ব্যবস্থা ছিল না। এই যে ছিল না, এটা একটা রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। দেশে বড় বড় রাজনৈতিক দল থাকবে- এক পক্ষ একা একা নির্বাচন করবে, আরেক পক্ষ নির্বাচন বয়কট করেই চলবে এই সংকটটা তো তৈরি করেছে সরকারি দল। প্রতিদিন অসত্য কথা শুনতে কিন্তু একটা সাংস্কৃতিক নিপীড়ন হয় কানের, মনের। প্রায় প্রতিদিনই মন্ত্রীরা বা রাজনীতিকরা যারা সরকারি শিবিরভুক্ত তারা এমন আলেম সাহেবদের মতো করে বলছেন যে, সংবিধানে তো তত্ত্বাবধায়ক সরকার নেই। তা সংবিধানে লেখা নাই কেন? ছিল তো? তাদের আন্দোলনের মধ্যদিয়েই তো সেটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। দুই পক্ষ মিলেই করেছিল। কেউ আনন্দের সঙ্গে, কেউ মনোবেদনা নিয়ে। কারণ দুই পক্ষ মিলে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সমাজের চাহিদার ভিত্তিতে তারা একটা প্রতিনিধিত্বহীন এক ধরনের ব্যবস্থা ৩ মাসের জন্য করেছিল। যারা এটা করলেন প্রথম তো তারা এককভাবে সরে গেলেন।  দু’পক্ষের চুক্তির ভিত্তিতে কোনোকিছু যদি একমত হয় সেটার প্রথম অন্যায় গায়ের জোরে একপক্ষীয়ভাবে সরে যাওয়া। স্বাধীনতার ৫২ বছর পূর্তিতে এসে আমরা যে আলোচনা করছি সেটা আমাদের সবার জন্য লজ্জার। সবচেয়ে বেশি লজ্জার যে শাসক শ্রেণি, বড় বড় রাজনৈতিক দল ৫২ বছরেও একটা নির্বাচন ব্যবস্থা সকলের জন্য গ্রহণযোগ্য করে গড়ে তুলতে পারেনি। একটা শাসক শ্রেণির- ক্ষমতাসীন ও ক্ষমতা বহির্ভূত উভয়দিকে যারা আছেন তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্ব ছাড়া কিছুই নয়। রাষ্ট্র পরিচালনায় জনগণের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণ ছাড়া একটি দেশের সার্বিক উন্নতি অসম্ভব। তাই রাজনীতিকদের খুব সিরিয়াসলি ভাবতে হবে এই ব্যবস্থা থেকে বের হওয়ার। যা হচ্ছে এটাকে নির্বাচন মনে করার কোনো কারণ নেই।

প্রশ্ন: স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও শাসনক্ষমতার পরিবর্তনের নীতিসিদ্ধ পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত হয়নি. ব্যর্থতাটা কাদের? 
উত্তর: আপনাকে আমাকে কেউ দায়িত্ব দেয়নি কিংবা এই দায়িত্ব আমরা গ্রহণও করিনি। এটা এমপি-মন্ত্রী যারা হন বা হওয়ার প্রত্যাশী, যারা রাজনৈতিক দল করেন তাদেরই করার কথা। কীভাবে একটা প্রতিষ্ঠানিক রূপ নেবে নির্বাচনী ব্যবস্থা সেটা উদ্ভাবন করে মানুষের অনুমোদনসহ একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার দায়িত্ব রাজনীতিকদের। দায়ী মূলত প্রধানত এই রাজনৈতিক শ্রেণি, যারা ক্ষমতার ভেতর ও বাইরে। আমাদের কাজ হচ্ছে এই কথাগুলো পরিষ্কার করে মানুষকে বলা ও চিন্তার দিক থেকে সংগঠিত করা। কমপক্ষে দুই যুগের সংগ্রাম, ৯ মাসের সশস্ত্র লড়াই, অসংখ্য আত্মদানের মধ্যদিয়ে যে দেশটির জন্ম হলো, দেশটি প্রতিষ্ঠার প্রথমে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরুর প্রথম কথা যেখানে গণতান্ত্রিক রায়ের কথা বলা হয়েছে। ১৯৭০ সালে জনগণ আওয়ামী লীগের পক্ষে পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনা করার জন্য রায় দিয়েছিল। সেই রায়কে অসম্মান করার জন্যই সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে। এটাকে বলে এই রােষ্ট্েরর জন্মকালীন অঙ্গীকার। জন্মকালীন যে প্রতিজ্ঞা এই রাষ্ট্রের সেই রাষ্ট্রকে ৫২ বছর ধরে রাজনৈতিক, আধা রাজনৈতিক, সামরিক যারাই এই পর্যন্ত সরকার পরিচালনা করেছে তাদের দায় এবং দায়িত্বহীনতা আজকে এদিকে ঠেলে দিয়েছে।

প্রশ্ন: নব্বই’র স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের পর মনে হয়েছিল যে, দেশ অন্যরকম রাজনীতিতে প্রবেশ করছে?
উত্তর: আপাতত দৃষ্টিতে ’৯০- এর এক দশকব্যাপী আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে যে সরকার পতন হয় তার মধ্যদিয়ে বৃহত্তর সমাজে এই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের যে রাজনৈতিক ভাবনা সঞ্চার হয়েছিল, একটা গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছিল।  এক ধরনের স্থিতিশীলতার মধ্যে এসব বিষয়ে আলাপ-আলোচনাগুলো চালিয়ে নেয়ার জন্য বা বিতর্ক করার জন্য একটা পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। তারপরে বিএনপি’র দিক থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দু’পক্ষ একমত হয়েছিল সেটা ম্যানুপুলেট করে নিজেদেরকে ক্ষমতায় টিকে থাকার প্রচেষ্টা এবং পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ একতরফাভাবে রাষ্ট্রের সংবিধান থেকে আইনি ব্যবস্থাকে ম্যানুপুলেট করে। তার ফলে আজ আমরা এমন বেদনাদায়ক একটা অবস্থান দেখতে পারছি। ইতিমধ্যে সমাজে বিরাজনৈতিকৃত হয়েছে। আমরা শুনি, পরস্পর পরস্পরকে গালাগাল দেয়। সেই গালাগালের মধ্যেও অসত্য থাকে। এটার কারণে দুটো ঘটনা হয়েছে। সমাজের মধ্যে রাজনীতি সম্পর্কে একটা বীতশ্রদ্ধভাব এসেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও রাজনৈতিক চর্চা নেই বলে ক্ষমতা দখল করে অর্থবিত্ত, ঐশ্বর্য গড়ে তোলার মাধ্যম হিসেবে রাজনীতি একটা বিনিয়োগ ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

যার ফলে রাজনৈতিক দলগুলো এখন দখল করেছে পেশিশক্তি। রাজনৈতিক ভাবনা, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ভাবনাবিবর্জিত জায়গায় দাঁড়িয়েছে। পত্র-পত্রিকায় দেখলাম, একজন মানুষ এমপি হতে পারলে তার বিত্তবৈভবের পরিমাণ ১০ থেকে ২৫০ গুণ পর্যন্ত বেড়ে যায়। আর যদি মন্ত্রী হয় তাহলে নিশ্চয় আরও বাড়ে। আবার এমন পরিসংখ্যানও দেখলাম সরকারি দলের প্রার্থীর ২০ ভরি স্বর্ণ আছে বাড়িতে। এর দাম ধরা হয়েছে ২১ হাজার টাকা বা গুলশান এলাকায় একটা ৫তলা বাড়ি তার মূল্য ধরা হয়েছে ৪০ লাখ বা ৬০ লাখ টাকা। এই যে অসত্য ও মিথ্যা দিয়ে যে রাজনৈতিক চর্চা এবং যেগুলো কেবল বিত্তবৈভব গড়ে তোলার একটা মাধ্যম মাত্র হয়েছে।  রাজনীতিকে এভাবে অধপতিত করেছে এরাই।

প্রশ্ন: রাজনীতিকরা অসত্য কথা বলেন। কিন্তু সম্প্রতি কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের একটি বক্তব্য ব্যাপক আলোচানার জন্ম দিয়েছে-  
উত্তর: তিনি যেটা বলেছেন সেটা এদেশের মানুষের জানা কথা। সত্য কথা বলার জন্য তাকে বোকাও বলা হচ্ছে। তিনি যদি নাও বলতেন আমরা কী দেখতে পারছি না। একই মামলায় অভিযুক্ত বিএনপি’র বিরোধীদলীয় নেতা আওয়ামী লীগে যোগ দেয়ার কথা স্বীকার করলে তার জামিন হয়ে যায়। এমনকী আওয়ামী লীগের মুদ্রিত নীতি যে পার্টির কাউকে এমপি নমিনেশন পেতে হলে অন্তত তার আগের দুই বছর অন্তত দুটি কমিটিকে তার সার্ভ করতে হবে পার্টিকে। কিন্তু তিনি তো ২৪ ঘণ্টা আগে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন, ফলে আওয়ামী লীগের দল হিসেবে সার্ভ করার কোনো সুযোগ তার ছিল না। কৃষিমন্ত্রীর কথা থেকে জানলাম, বহু উদ্যোগ নেয়া হয়েছে যদি তাদের ছকের মধ্যে অর্থাৎ সরকারি দলের ছকে নির্বাচনে অংশ নেয় তাহলে এক রাতের মধ্যে সবাইকে মুক্ত করে দেয়া হবে। এর অর্থ কী? অর্থাৎ এখানে একটা রাষ্ট্রের যে ক্ষমতার পৃথকীকরণ বলা হয়ে থাকে, অর্থাৎ নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের যে একটা পৃথকীকরণ যার কারণে নির্বাহী বিভাগের আদেশ-নির্দেশের বাইরে গিয়ে বিচার বিভাগ স্বাধীনভাবে বৈচারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে অর্থাৎ কাকে জেল দেয়া হবে আর কাকে জেল দেয়া হবে না- সেটা আইন অনুযায়ী, অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী আইনের ভেতরে নির্ধারণ করা হবে সেটা এখানে বিরাজ করে না তা প্রমাণিত। সে কথাটাই কৃষিমন্ত্রী বলেছেন।

দেশ কোন অবস্থায় পৌঁছেছে, এখানে জুডিশিয়ারির যে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ নেই এবং নির্বাহী বিভাগ অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বাধীন যে নির্বাহী বিভাগ তারা কি ধরনের ভয়ের সঞ্চার জুডিশিয়ারির মধ্যে করেছে তার একটা আভাস ও ইঙ্গিত স্পষ্টভাবে পাওয়া গেল। এতে ক্ষমতার বাইরে থাকা কোনো মানুষ সুবিচার পাবে না। এটা একটা স্বাধীন দেশের গণতন্ত্রের নামে কাঙ্ক্ষিত হতে পারে না। অসত্য কথার মধ্যদিয়ে নিজেদের তারা মানুষ হিসেবে ছোট করে তাই নয়, এই যে ২০১৪তে ভোটারবিহীন নির্বাচন হলো, ২০১৮তে আগের রাতে বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার ভোটের বাক্স ব্যালটে ভরে গেল। এই রকম একটা পরিস্থিতি দেশের মানুষ নিজের জীবন দিয়ে প্রত্যক্ষ করেছে। প্রতিদিন আওয়ামী লীগের কোনো না কোনো নেতা বলতেই থাকে যে তারা ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়েছেন। এই যে অসত্য কথাটা বলে, এই অসত্য কথা বলতে তাদের কণ্ঠস্বর কেঁপে উঠে না। তাদের মুখ লাল হয়ে যায় না লজ্জায়। সেটা একটা দিক। আরেকটা দিক হচ্ছে, প্রতিবার এই কথা উচ্চারণের মধ্যদিয়ে তারা আমাদের বুদ্ধিমত্তার লেভেল নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। অর্থাৎ আমরা এতই নির্বোধ তারা প্রতিদিন এই কথা বললে আমাদের মেনে নিতে হবে। এই আশায় নিশ্চয় বলে, এটা বলতে বলতে ঠিক হয়ে যাবে।

প্রশ্ন: ২০১৪ ও ২০১৮ এরপর এবার নমিনেশনের সময় ডামিনেশনের কথা ব্যাপক আলোচনায় আছে। পরিস্থিতি কীভাবে দেখছেন? 
উত্তর: একটা সাজানো ব্যবস্থা তো করতে হবে। এটা তারা কেনো করেছে সেটা সবাই জানেন। আওয়ামী লীগ নতৃত্ব জানে ২০১৪ বা ২০১৮ সালে প্রতিনিধিত্বমূলক ভোট হয়নি। ওখানে কে কোনো অংশগ্রহণমূলক কিছু ছিল না। এবার আরেক ধরনের ধোঁকা দেয়ার জন্য নিজের একটা অফিসিয়াল প্রার্থী আরেকটা আন অফিসিয়াল প্রার্থী ভোট করে দেখাবে যে প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচন হচ্ছে। অর্থাৎ কোনো নির্বাচনী এলাকাতেই আওয়ামী লীগের হারার কোনো পথ নেই। এ কারণে এটা নির্বাচন না, হয় আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল প্রার্থী জিতবে অথবা আওয়ামী লীগের ডামি প্রার্থী জিতবে। মোদ্দাকথা আওয়ামী লীগই জিতবে।

প্রশ্ন: অনেকে বলছেন, এবার শরিকদের জিতিয়ে আনতে হলেও এক ধরনের ম্যাকানিজম লাগবে। 
উত্তর: তার নিজের দলের বাইরে যে জোটের শরিক দল আছে তাদের সঙ্গে আচরণের একটা কৌশলগত বৈশিষ্ট্য আছে। তিনি রাজনীতিতে আসার আগে কিংবা তারপরও আওয়ামী লীগকে কিংবা তার পিতাকে যেসব দলের নেতারা সবচেয়ে বেশি সমালোচনা করেছে। কখনো কখনো সভ্যতার মাত্রা অতিক্রম করে অভদ্রভাবে আওয়ামী লীগকে কিংবা শেখ মুজিবুর রহমানকে যারা অপমানজনক কথা বলেছে বিভিন্ন সময়ে তাদেরকে শেখ হাসিনা রাজনৈতিক, ব্যক্তিগত নানাভাবে তার জোটের বলয়ের ভেতরে ঢুকিয়েছেন এবং পুরস্কৃৃত করেছেন। যেমন, রাশেদ খান মেনন কিংবা হাসানুল হক ইনু, মতিয়া চৌধুরী। তারা এক সময় আওয়ামী লীগের খুব সমালোচক ছিলেন। শেখ মুজিবকে সমালোচনা করতে ছাড়েননি। সব সময় ভাষার মধ্যে ভদ্রতাও ছিল না। তিনি তাদেরকে মন্ত্রী বানিয়েছেন এবং তার যখন কাজ শেষ হয়ে গেছে তাদের অবস্থা আজকে কোথায় দাঁড়িয়েছে? রাশেদ খান মেনন কিংবা হাসানুল হক ইনু তাদের যে অতীত রাজনীতিতে বর্ণাঢ্য ভূমিকা ছিল। তাদের দেশপ্রেম, সততা এগুলো তো এই সমাজেরই ঘটনা, সত্য। তাদের শাস্তি তিনি এভাবেই দেন। আরেকটি প্রমাণ দেই, বিএনপির ভাইস প্রেসিডেন্ট আছে প্রায় ২০-২২ জন। কিন্তু কেনো শাহজাহান ওমরকে আওয়ামী লীগকে আনতে হবে? আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব যেদিন জিয়াউর রহমানের লেখাপড়া নিয়ে খুব কটাক্ষ করেছিলেন, বিএনপি’র দিক থেকে সবচাইতে বেশি সোচ্চার হয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্যকে প্রতিবাদ করেছেন, শেখ হাসিনার শিক্ষা দীক্ষা নিয়ে কটাক্ষ করেছেন তিনি শাহজাহান ওমর। আমার ধারণা যে কারণে বাম রাজনৈতিক নেতাদের তিনি তার কাছে নিয়ে গিয়ে তাদেরকে শেষ পর্যন্ত তার যে করুণ অবস্থার মধ্যে নিপতিত করেছেন, যে মনস্তত্ব সেই একই মনস্তত্বের কারণে শাহজাহান ওমরকে তিনি নিয়ে এসেছেন। আওয়ামী লীগ শীর্ষ নেতৃত্বের এটা একটা স্টাইল।

প্রশ্ন: ওয়ান-ইলেভেনে দেখেছি, বর্তমান সময়ও দেখছি আলোচনায় কিংস পার্টি। এই দলগুলোর ভবিষ্যৎ কি? 
উত্তর: বাংলাদেশে এদের নাম কুইনস পার্টি হওয়া উচিত। ধরুণ তৃণমূল বিএনপি, এমনকি জাতীয় পার্টি তারা নির্বাচনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সরাসরি এক বা একাধিকবার বৈঠক করার পর। অর্থাৎ তারা তার কাছ থেকে কিছু আশ্বাস পেয়েছে। যে আশ্বাসের ভিত্তিতে শেখ হাসিনা তাদের সঙ্গে সমঝোতার কথা চিন্তা করেছিলেন সেই আশ্বাস যদি তারা পূরণ করতে না পারে, তারা যদি বিএনপিকে না ভাঙতে পারে তাহলে হয়তো তাদের কাছে দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষার কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। এভাবে নিজের রাজনীতি না করে, পরিশ্রম না করে বড় হওয়ার যে আকাঙ্ক্ষা বা বিত্ত-বৈভব লাভের যে আকাঙ্ক্ষা সেটা যে রাজনীতিতে শেষ পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে না এবং নিজেদের মধ্যে যে একটা ধ্বংস ডেকে নিয়ে আসে তা আরেকবার প্রমাণ হলো।

প্রশ্ন: বিশ্বজুড়েই এই নির্বাচন স্পটলাইটে। সর্বশেষ হোয়াট হাউসের মুখপাত্র জন কিরবির বক্ত্যব্যেও দেখা গেছে, অংশগ্রহণমূলক ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কথা। কীভাবে দেখছেন?  
উত্তর: এটা সবচেয়ে বেশি দেখতে চায় বাংলাদেশের মানুষ। কারণ একটা অংশ্রগ্রহণমূলক প্রতিদ্বন্দিতাপূর্ণ নির্বাচনের মধ্যদিয়ে অবাধভাবে নিজস্ব প্রতিনিধিকে নির্বাচিত করা সবচেয়ে বেশি দরকার বাংলাদেশের। এই নির্বাচন প্রক্রিয়াকে অসম্মানিত করার কারণেই বাংলাদেশে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূত্রপাত হয়েছিল। তার আকাঙ্ক্ষা নানানভাবে বিভিন্ন সময় গড়ে উঠেছে। কিন্তু যেই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু হয় সেটা হলো এটা। এটা বাংলাদেশে একটা জন্মকালীন ঐতিহাসিক অঙ্গীকার। মার্কিন অংশটা একটা ভূরাজনৈতিক। প্রত্যেকটা দেশ তার আপন জাতীয় স্বার্থ দেখে। বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কিংবা ভারত, রাশিয়া, চায়না তাদের কার কী দৃষ্টিভঙ্গী হবে হবে সেটা নির্ভর করবে এখানে কী কী দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করলে তাদের স্বার্থের নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে এবং স্বার্থ বিকশিত হবে। যারা যারা আজকে শেখ হাসিনার এই যে রাজনৈতিকভাবে অন্যায্য সরকারকে সমর্থন করছেন সেটা তারা করছেন ওই রাশিয়া কিংবা চায়না কিংবা ভারত তা তাদের নিজের প্রয়োজনে প্রধানত।

আমি মনে করি, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের জন্য শেষ পর্যন্ত নির্ধারক শক্তি হচ্ছে এদেশের মানুষ। তবে সময় লাগবে। বোঝাই যাচ্ছে নানানভাবে রাজনৈতিক চৈতন্যের মান নিচে নেমে গেছে। যেমন গণতন্ত্র তো একটা জীবন ব্যবস্থা। তার যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে ব্যক্তিগত সম্পর্কের মধ্যে, পারিবারিক সম্পর্কের মধ্যে, সামাজিক সম্পর্কের মধ্যে প্রতিফলন করতে হয়। শিক্ষার মধ্যে, জ্ঞান চর্চার মধ্যে ভিন্নমত সম্মান করার প্রবণতা থাকে। কিন্তু এখন এটাকে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যাক কিংবা বিএনপি ক্ষমতায় যাক এমন একটা সংকীর্ণ জায়গায় এই শাসক শ্রেণি গণতন্ত্রের সংজ্ঞাটাকে নিয়ে এসেছে। এখান থেকে উত্থান হতে আবার নতুন ধরনের গণতান্ত্রিক জাগরণ সমাজে দরকার হবে। সেটা এখানকার বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিল্পী সাহিত্যিক ও রাজনৈতিককর্মী তো বটেই- তাদের একটা ভূমিকা পালন করতে প্রয়োজন হবে। আর বৈশ্বিক যেগুলো নজরদারি আমাদের থাকতে হবে। কে কোনো ধান্দার কারণে আমাদেরকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে একপক্ষকে আরেক পক্ষ বিরোধিতা করছে। তবে কিছু বৈশিষ্ট্য কিন্তু অলরেডি দেখা যায়। রাশিয়া বাংলাদেশকে সমর্থন করছে কেন? তারা ভারতে যে নিউক্লিয়ার প্লান্ট বিক্রি করছে তার চেয়ে ৫ গুণ দামে আমাদের কাছে বিক্রি করছে। সুতরাং তার এখানে অর্থনৈতিক স্বার্থ আছে। চীন সারা পৃথিবীতে নানানভাবে বিনিয়োগ করছে তার লাভের জন্য। সেই বিনিয়োগে আমাদের কিছু লাভ হয়। দুটি দেশেই কিন্তু কতৃত্ববাদী সরকার প্রতিষ্ঠা আছে। আজকের যে ভারত, হিন্দুত্ববাদী যে সরকার এটা কর্তৃত্বপরায়ণ না হয়ে তার কোন ব্যবস্থাই নেই। কারণ তার রাজনৈতিক আদর্শের মধ্যেই যখন একটা ধর্মভিত্তিক কোন সরকার বা রাষ্ট্র পরিচালিত হয় তখন অন্য ধর্মের মানুষরা দ্বৈত ক্যাটাগরির নাগরিকে পরিণত হয়। যেটা বাংলাদেশ বা যেকোনো দেশের ক্ষেত্রে এই ঘটনা ঘটবে যদি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি প্রধান হয়ে উঠে।  মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্রের কথা বলছে, কিন্তু অন্তর্গতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রাষ্ট্র হিসেবে আজকে প্যালেস্টাইনিদের নিয়ে আর ইসরাইলকে নিয়ে যে ভূমিকা তারা পালন করছে তাতে এটা কি প্রমাণিত হয় না যে আদর্শগতভাবে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তারা বিশ্বাস করে। কাজেই তার জন্য এটা কৌশলগত। সেই কৌশল আমার কাজে লাগলে আমি থ্যাঙ্ক ইউ বলবো। যেখানে আমার আদর্শ বিরোধী কাজ করবে যেমন ধরুন প্যালেস্টাইনে সেখানে সে কাজের নিন্দা অব্যাহতভাবে করতে হবে। মার্কিন যক্তরাষ্ট্রের যে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড সেটার বিরুদ্ধে পরিষ্কার করে কথা বলতে হবে। একই সঙ্গে যেসব কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলো তাদের জনগণের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক দরকার। দেশের সঙ্গে দেশের সম্পর্ক দরকার। ব্যবসা, বাণিজ্য, জ্ঞান ইত্যাদি নানান বিষয়ে পারস্পরিক সহযোগিতা নিশ্চিত করার জন্য। কিন্তু তাদের যে রাজনৈতিক ব্যবস্থা সেই ব্যবস্থার সঙ্গে শেখ হাসিনার যে সরকার তার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে মিল আছে তার সমর্থন করা ঐতিহাসিক সুযোগ বা ইতিহাসের দিক থেকে দেখলে আমাদের মানুষের যে আকাঙ্ক্ষা সেই আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে অসঙ্গতি পরায়ণ। ফলে অসমর্থন যোগ্য।

প্রশ্ন: শাসন ব্যবস্থায় ত্রুটি বা দুর্বল গণতন্ত্র যদি থাকে তাহলে কি বহির্বিশ্বের চাপ বাড়ে?
যখন একটা সরকার সত্যিকার অর্থে জনসমর্থন থাকে তার পেছনে সেই সরকার, সেই দেশ এবং রাষ্ট্র অনেক শক্তিমান থাকে। কারণ সরকারের পেছনে অর্গানিকলি এক ধরনের জনসমর্থন আছে। ১৮ কোটি লোক কিন্তু কম নয়। শেষ পর্যন্ত মানুষ, মানুষের চিন্তা, মানুষের দেশপ্রেম ম্যাটার করে। সেক্ষেত্রে রাজনৈতিকভাবে একটা দেশ যখন দুর্বল হয় তখন সেই দেশে প্রতিষ্ঠিত সরকার যদি স্বৈরতান্ত্রিক হয় তাহলে এর সুযোগ সবাই নিবে। এজন্য বহির্বিশ্বের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য আমাদের নিজেদের রাষ্ট্রের ও সমাজের গণতান্ত্রিক বিকাশ, প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার, রাষ্ট্রের জবাবদিহিতা, রাষ্ট্রের প্রধান ৩ অঙ্গ- আইন, বিচার এবং নির্বাহী বিভাগগুলোকে পারস্পরিক শ্রদ্ধার ভিত্তিতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেয়ার একটা ব্যবস্থা সৃষ্টি করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা চালু করতে পারলে আমাদের সঙ্গে অন্যদের ব্যবহার বদলে যাবে।

প্রশ্ন: অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার একটা কথা নানাভাবে অলোচনায় আছে। 
উত্তর: সেটা যদি হয়, সেই অস্ত্র যদি পশ্চিমারা ব্যবহার করে তার মানে খুব বিপদে পড়ে যাবে পুরো দেশ, অর্থনীতি। আপনি লক্ষ্য করুন, যেসব দেশগুলো এই সরকারকে সমর্থন করছে, চীন, ভারত কিংবা রাশিয়া- এদের কাছ থেকে আমরা জিনিস কিনি। বেচি কিন্তু ইউরোপে, পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে। অর্থাৎ আগেরগুলোর ক্ষেত্রে আমাদের টাকা খরচ হয় আর পশ্চিম থেকে আমাদের টাকা আয় হয়, ফলে একটা রাষ্ট্রে প্রথম দরকার হচ্ছে সকল বড় বড় পাওয়ারের সঙ্গে একটা সুষ্ঠু ব্যলেন্স বা সুষ্ঠু সম্পর্ক  তৈরি করা ব্যালেন্স রেখে। সেটা যদি না পারে আমাকে প্রেফারেন্সের দিকে যেতে হয়, আমার ইনকাম কোথায় বেশি, খরচ কোথায়, এক্সপেন্ডিচার কোথায় করতে হয়। এগুলো কিন্তু বৈদেশিক সম্পর্ক নির্ণয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হওয়া উচিত।

প্রশ্ন: আওয়ামী লীগ, বিএনপি দু’টি বড় পার্টি। একটি পার্টি সরকারে আছে, নির্বাচনে করছে আরেকটি পার্টি নির্বাচনের বাইরে। বিএনপি’র ক্ষেত্রে আপনার কি পরামর্শ থাকবে?
উত্তর: প্রথম কথা হচ্ছে, রাজনৈতিক দলকে পরামর্শ দেয়ার প্রজ্ঞা এবং যুক্তি আমার নেই। আমি যেটা আলাপ করি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আমার দাবি কী নাগরিক হিসেবে। বিএনপি এবং অপজিশনে বাকি যারা আছে, আমাদের কৃষিমন্ত্রী রাজ্জাক সাহেবের কথায় ফেরত আসি। তাদের (বিএনপি) হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাবন্দি করা হয়েছে। তিনি পরিষ্কার ইঙ্গিত করেছেন সমাজে যাতে আন্দোলন, সংগ্রাম না হয় তারজন্য এই আটক। হরতালের সময় যাতে গাড়ি চলতে পারে। সরকার যে পদ্ধতির যে নির্বাচন করছে তার বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ আছে সেই প্রতিবাদ যাতে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হতে না পারে সে কারণে তাদেরকে বন্দি করা হয়েছে। বন্দি করার প্রক্রিয়ায় বিএনপি কর্মীদের সঙ্গে বা অন্যান্য অপজিশন কর্মীদের সঙ্গে রাষ্ট্রের পুলিশ কীভাবে ব্যবহার করছে? এই পুলিশকে এ দেশের মনে হয়? এই অর্থে যে, তারাও তো এদেশের নাগরিক। আইনের নিয়ম হচ্ছে যে, আপনি যদি তার দৃষ্টিতে অপরাধী হয়ে থাকেন সেটা শেষ পর্যন্ত নির্ণয় করবেন আদালত। কিন্তু পুলিশের দৃষ্টিতে যদি অপরাধী হয়ে থাকেন আপনাকে খুঁজতে আপনার বাড়িতে যেতে পারে। কিন্তু আপনাকে না পেয়ে আপনার সন্তান, বৃদ্ধ বাবা-মা তাদের যদি ধরে নিয়ে যায় তাহলে এর চেয়ে অন্যায়, অন্যায্য ও অগণতান্ত্রিক আচরণ রাষ্ট্রের দিক থেকে হতে পারে না। এগুলো তারা হরহামেশা করছে। গত বছরগুলোতে বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামে যুক্ত থাকাদের দৌড়ের ওপর রাখা হয়েছে। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, পারিবারিক জীবন, সন্তানদের সঙ্গে দেখা করার স্বাভাবিক সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে আমি বিরোধী নেতাকর্মীদের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে সহনুভূতিশীল। কিন্তু তারা যে রাজনীতির কথা বলছে তাদেরও দেখতে হবে এ নির্বাচন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্রের যে অগণতান্ত্রিক রূপ নৃশংস রূপ ধারণ করেছে এটাকে গনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় অন্তত কিছু সংস্কার করার জন্য কর্মসূচি আছে কি না। তারা ৩১ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। কিন্তু বলার সময় এ দাবিগুলোকে জনপ্রিয় করার কোনো উদ্যোগ আমি দেখি না। দেখি কেবল, শেখ হাসিনা সরকারকে উৎখাত করতে হবে এবং তত্ত্বাবধধায় সরকারের অধীনে এমন একটা নির্বাচন দিতে হবে যে নির্বাচনের মাধ্যমে তারা ক্ষমতায় যেতে পারে। ফলে বিরোধীদের ওপরও জনগণের বিশ্বাস আনার যে উদ্যোগ আমি দেখছি না তা নিয়ে আমি দুশ্চিন্তার মধ্যে আছি।

আমি মনে করি,  আওয়ামী লীগ নৈতিকভাবে তার ঐতিহাসিক অঙ্গীকার ছিল স্বাধীন বাংলাদেশে নির্বাচনভিত্তিক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা তৈরি করার যে অঙ্গীকার ছিল সেখান থেকে তারা নিজেদের প্রতি অন্যায় করেছেন, ইতিহাসের প্রতি অন্যায় করেছেন এবং মানুষকে অধিকারহারা করার জন্য তারা দায়ী থাকবেন। ভবিষ্যতে ইতিহাসের এ রায় তাদের পক্ষে যাবে না। অন্যদিকে, বিএনপি দুঃখ ভোগ করার পরও পরিষ্কারভাবে গণতান্ত্রিক কর্মসূচির জন্য কথা বলে না তার দায়িত্বহীনতার দায়ভার তাদেরও ভোগ করতে হবে।

প্রশ্ন: ৭ই জানুয়ারির পর কী হবে? 
উত্তর: ৭ই জানুয়ারির পর নানা উদ্বেগের ব্যাপার আছে। তা হচ্ছে আওয়ামী লীগের অপরাধবোধ বাড়বে, যদিও তারা তা স্বীকার করবে না। সেই অপরাধবোধ থেকে তারা বলছে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতার জন্য তারা নির্বাচনটা করছে। কিন্তু তাদের আবার নতুন করে চেষ্টা করতে হবে যে তাদের অন্য পক্ষ বিএনপি’র সঙ্গে নতুন করে আলোচনার পথ তৈরি করা এবং এভাবে আধা ন্যায্য নির্বাচনের মাধ্যমে গঠিত সরকার থেকে বেরিয়ে এসে নতুন একটা নির্বাচনের দিকে যাওয়ার চেষ্টা করা। কিন্তু আজকে ওবায়দুল কাদের বলেছেন- সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার জন্য এ নির্বাচন যেটি ২০১৪ সালে তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফও বলেছিলেন- এটা ধারাবাহিকতা রক্ষার নির্বাচন, আমরা আরেকটি করবো। কিন্তু করেননি। অপরাধবোধ ও কর্তব্যবোধ থেকে কোনো ইতিবাচক উদ্যোগ নিলে ভালো। অন্যদিকে, আরও নিপীড়নমূলক হয়ে উঠার সম্ভবনাও আছে। যখনই সমাজে অশান্তি থাকে, তখন যে কোনো সময় তুষের আগুনের মতো জ্বলে উঠতে পারে। সেটাকে বিবেচনায় নিয়ে ইতিবাচক কিছু করতে পারে। অথবা সেটাকে আরও স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য প্রতিবাদী সভা সমাবেশ বন্ধ করে চীনের মতো আরও একদলীয় হয়ে নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারে। অন্যদিকে, বিএনপিকে আরও দায়িত্ববান ও চিন্তাশীল আচরণ করতে হবে তাদের কর্মীদের জন্য ও দেশের জন্য।

নাশকতার ঘটনা ঘটছে, এই যে আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মারার প্রক্রিয়া, শিশুসহ মা মৃত্যু বরণ করেছে। এটা পিশাচরাও করে না, যারাই করুক না কেন। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য প্রতিবার এসব আন্দোলন যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আওয়ামী লীগের আন্দোলন যে আন্দোলনে শেরাটনের সামনে বাসে বোমা ও এসিড মেরে মানুষ মেরে ফেললো আজ পর্যন্ত সেসকল ঘটনার কোনো নিঃসংশয় তদন্ত হয়নি। কারণ এমন কোনো বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত হয়নি যে এ ধরনের অপরাধের পেছনে কারা? কেউ না কেউ এসবের সিদ্ধান্ত দেয়। আমার অবাক লাগে যারা এসব বাস্তবায়ন করে তারা ঘুমায় কী করে? তাদের মধ্যে মানবীয় বৈশিষ্ট্যের সর্বশেষ উপদানটা নষ্ট হয়ে যাওয়া পর্যন্ত এ ধরনের কাজ করতে পারে না। সমাজকে সংজ্ঞবদ্ধভাবে বিশ্বাসযোগ্য তদন্তের মধ্য দিয়ে এ লোকগুলোকে খুঁজে বের করা প্রয়োজন। এভাবে চলতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষ এটা ডিজার্ভ করে না। আমাদের দেশের মানুষের প্রাপ্য এটা না। এতো কিছুর মধ্যেও সাহস রেখে ইতিবাচক মনোভঙ্গী নিয়ে সংগ্রামটা তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পর্যায়ে অব্যাহত রাখতে হবে। আজকের যে বাংলাদেশ সেটা বাংলাদেশের ইতিহাসের নিয়তি হওয়ার কথা না।

মানবজমিন