আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পুনর্জীবন রুখতে হবে

 আমার দেশ
২৯ এপ্রিল ২০২৩

মাহমুদুর রহমান

মাহমুদুর রহমান

মাহমুদুর রহমান

সময়টা চরম একনায়ক শেখ মুজিব পতনপরবর্তী বাংলাদেশ। এক দল দেশপ্রেমিক, মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসার ও সৈনিকদের দু:সাহসিক অভ্যুত্থানে সোভিয়েট আদর্শে অনুপ্রাণিত একদলীয় শাসন, বাকশালের কবর রচিত হয়েছে। শেখ মুজিব সংবাদপত্রের যে স্বাধীনতা এক ঘোষণায় নির্মমভাবে ছিনিয়ে নিয়েছিলেন সেটি পরবর্তী সরকার ফিরিয়ে দিয়েছে। দেশে সামরিক শাসন বলবৎ স্বত্ত্বেও মিডিয়ার উপর নিয়ন্ত্রণ বেশ শিথিল। মানুষ নির্ভয়ে লিখতে পারছে, কার্টুন আঁকছে। বর্তমান বাংলাদেশের মত কোন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের তরবারি জনগণের মাথার উপর ঝুলছে না। সেই সময়  সম্ভবত: খুবই জনপ্রিয় সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত একটা কার্টুনের কথা আজকের সম্পাদকীয় লিখতে বসে মনে পড়ছে। কার্টুনিস্টের শিল্পকর্মটা অনেকটা এরকম ছিল।

একটি ল্যাম্পপোস্টের নিচে দুজন পথচারি একে অপরকে অবাক হয়ে প্রশ্ন করছে, “আচ্ছা, এত বাকশালীরা গেল কই রে”? ওই ল্যাম্পপোস্টেরই উপরে তখন কালো মুজিবকোট গায়ে দুই বাকশালী কোনক্রমে জড়াজড়ি করে ঝুলে থেকে লুকিয়ে জনরোষ থেকে পালিয়ে থাকার চেষ্টা করছে। লুটেরা, জালিম বাকশালীদের এভাবেই পালিয়ে থেকে কৃতকর্মের খেসারত দিতে হয়েছিল।  গত পনেরো বছরের ফ্যাসিস্ট শাসনে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের জনগণকে এই ইতিহাস প্রায় ভুলিয়ে এনে একজন স্বৈরাচারী, জনধিকৃত শেখ মুজিবকে দেবতা বানিয়ে পূজা করাচ্ছেন। আর চলমান ইতিহাস বিকৃতিকে সর্বপ্রকারে সহায়তা করে যাচ্ছে আওয়ামী বুদ্ধিজীবী নামক উচ্ছিষ্টভোগীর দল এবং বাংলাদেশের নির্লজ্জ গোলাম মিডিয়া।

শহীদ জিয়াউর রহমান বাংলাদেশের সংবিধানে বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার পর বাকশালের কবর থেকে আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম হয়েছিল। ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারীতে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে পুনর্জীবিত আওয়ামী লীগ ৩৯টি আসন নিয়ে সংসদে প্রধান বিরোধী দল নির্বাচিত হয়েছিল এবং আসাদুজ্জামান খান বিরোধী দলের নেতা হয়েছিলেন। সেই নির্বাচনে বিএনপি ২০৭ আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করেছিল। জাসদ ৮ আসন নিয়ে তৃতীয় অবস্থানে ছিল। যতদূর মনে পড়ছে, আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা মুজিব কোট  গায়ে দিয়েই সংসদে আসতেন। জিয়াউর রহমান একটি দরিদ্র, সদ্য স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থে রাজনৈতিক বিরোধিতার উর্ধ্বে উঠে এক প্রকার জাতীয় ঐক্য সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন। সম্ভবত: সেই উদ্দেশ্যেই তিনি কখনও শেখ মুজিবের সাড়ে তিন বছরের অনাচার ও অপশাসনের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগতভাবে মুখ খোলেন নাই। বরঞ্চ, স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিবের ভূমিকার কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছেন।

১৯৭৫ থেকে ১৯৮১ পর্যন্ত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা “র” এর সঙ্গে দীর্ঘ ছয় বছর ধরে বাংলাদেশকে দিল্লির আঘোষিত উপনিবেশে পরিণত করবার যাবতীয় শলাপরামর্শ সমাপ্ত করে শেখ হাসিনা ইন্দিরা গান্ধীর আশ্রয় থেকে দেশে ফিরলে জিয়াউর রহমানের গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার তখন রীতিমত তালিকা করে ধানমন্ডির বিখ্যাত ৩২ নম্বর সড়কের বাড়ীসহ শেখ মুজিবের রেখে যাওয়া বিপুল সম্পদ শেখ হাসিনাকে ও শেখ রেহানাকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সম্পদের বৈধতা প্রমাণের জন্য কোন হিসাব সরকারের পক্ষ থেকে শেখ মুজিবের উত্তরাধিকারীদের কাছে সেদিন চাওয়া হয় নাই। বাড়িতে অবৈধ অস্ত্র রাখার অপরাধে কোন মামলা করাও হয় নাই। উল্লেখ করা যেতে পারে, পাকিস্তানী আমলে মন্ত্রি থাকা অবস্থায় দুর্নীতির অভিযোগে শেখ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছিল। জিয়াউর রহমানের সেই উদারতার ফলেই একবিংশ শতাব্দিতে পৌঁছে নির্লজ্জভাবে ইতিহাস বিকৃত করে বাংলাদেশে এক অতিকায় বায়বীয় “শেখ মুজিব মিথ” তৈরি করা ফ্যাসিস্ট হাসিনার পক্ষে অনেক সহজ হয়েছে। অথচ, চরম ঈর্ষাকাতর ও জিঘাংষাপরায়ণ শেখ হাসিনা সেই উদারতার বিনিময়ে জিয়া পরিবারকে চরম হয়রানিসহ শহীদ জিয়ার বিরুদ্ধে অব্যাহতভাবে মিথ্যা ও অশ্লীল কুৎসা রটনা করে চলেছেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রী, বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়াকে সম্পূর্ণ মিথ্যা মামলায় সাজা দিয়ে অন্যায়ভাবে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে বানোয়াট মামলায় সাজাপ্রদানসহ আওয়ামী আদালতে তার বিরুদ্ধে একাধিক ভুয়া মামলা চলছে। এমনকি, রাজনীতির সঙ্গে একেবারেই সংশ্রবহীন তারেক রহমানের স্ত্রী, কার্ডিওলজিস্ট ডা: জোবায়েদা রহমানের বিরুদ্ধেও হাসিনার নির্দেশে দুদক মামলা দায়ের করেছে।

২০২৩ সালের মধ্যে শেখ হাসিনার ফ্যাসিস্ট শাসনের পতন হচ্ছে কিনা আমাদের জানা নেই। তবে গণতান্ত্রিক বিশ্বে তার অবৈধ শাসন অনেক দিন ধরেই প্রশ্নবিদ্ধ। প্রেসিডেন্ট বুশের ইসলামের বিরুদ্ধে অন্তহীন যুদ্ধের বর্ণবাদী ও চরম সাম্প্রদায়িক নীতি থেকে বাইডেন প্রশাসন দৃশ্যত: সরে আসায় হাসিনার “ইসলামী জঙ্গী” কার্ড আন্তর্জাতিক পরিমন্ডলে এখন অকেজো হয়ে পড়েছে। র‍্যাব আর পুলিশের গোয়েন্দা সেল থেকে তৈরি করা বানোয়াট সব ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীর অস্তিত্বে প্রথম আলো, ডেইলি স্টার, কালের কন্ঠ, জনকন্ঠ, একাত্তর টেলিভিশন মার্কা চরম ইসলামবিদ্বেষী ও হিন্দুত্ববাদি মিডিয়া ছাড়া বাংলাদেশের আর কেউ বিশ্বাস করে না। এই সকল বানোয়াট সংগঠন তৈরি করে র‍্যাব এবং পুলিশ গত পনেরো বছরে অসংখ্য বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ড ও গুমখুন চালিয়েছে। ইনশাআল্লাহ, বাংলাদেশে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে এই সকল মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার দেশের স্বাধীন, পুনর্গঠিত আদালতে এবং আন্তর্জাতিক আদালতে হবে বলে আমাদের আস্থা আছে। গত এক বছরের অধিককাল ধরে ওয়াশিংটন থেকে সুস্পষ্ট বার্তা দেওয়া হচ্ছে যে, ২০১৪ এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনী প্রহসনের পুনরাবৃত্তিকে কোন প্রকারেই পূর্বের মত বৈধতা দেওয়া হবে না। মিয়ানমারের চীনপন্থী, চরম অগণতান্ত্রিক, সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র “বার্মা এক্ট” আইনতভাবে গ্রহণ করার প্রেক্ষাপটে ক্রমেই চীন ও রাশিয়ার দিকে ঝুঁকে পড়া বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট শাসককে কোনরকম আশকারা দিলে দক্ষিণ এশিয়ায় বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তির নৈতিক ও আইনগত অবস্থানও দুর্বল হয়ে যাবে। তাছাড়া, খোদ “বার্মা এক্ট” এর ভিতরেই বাংলাদেশ প্রসঙ্গও রয়েছে।

দেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতিতে বিএনপি খানিকটা ধীরে হলেও এখন পর্যন্ত ফ্যাসিবাদবিরোধী সঠিক আন্দোলন কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে। হাসিনার অবৈধ এবং চরম একনায়কতান্ত্রিক সরকারের অধীনে কোন নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করবার দৃঢ় সিদ্ধান্ত ফ্যাসিবাদের পাশাপাশি বিএনপির ভিতরকার সুবিধাবাদি শ্রেণিকেও চরম বিপাকে ফেলেছে। অবশিষ্ট “উকিল সাত্তার” গং যারা সময় এবং সুযোগমত আস্তিনের সাপের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতো তারা আসন্ন সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন নিয়ে শীর্ষ নেতৃত্বের অনমনীয় সিদ্ধান্তের কাছে আপাতত: নতি স্বীকারে বাধ্য হয়েছে। তারেক রহমানও এদের চিনতে শুরু করেছেন। ২০১৮’র পূর্ব-নিশিরাত নির্বাচন পরবর্তী ব্ল্যাকমেইলের সুযোগ এবার আর অন্তত: তারা পাচ্ছে না। তবে এদের সম্পর্কে দলের নীতিনির্ধারকদের সতর্ক থাকা প্রয়োজন। দেশের নিপীড়িত জনগণ এখন বিএনপির কাছ থেকে হাসিনা পতনের ঐক্যবদ্ধ চূড়ান্ত এক দফা ডাকের জন্য অপেক্ষমান। তাদের প্রত্যাশা আগামী অক্টোবরের মধ্যে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে সারা দেশ উত্তাল হয়ে উঠবে। এবং ঐতিহাসিক গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকারের পতন ঘটবে। সেই পতন শান্তিপূর্ণ নাকি রক্তাক্ত হবে সেটা নির্ধারণ করবে ফ্যাসিস্ট সরকারের নিপীড়ণের মাত্রা, আন্তর্জাতিক মহলের প্রতিক্রিয়া, সময় এবং পরিস্থিতি। তবে এটা নিশ্চিত যে, পরিবর্তিত বিশ্ব ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনার অবৈধ ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার জন্য কৌশল গ্রহণের সুযোগ অনেকাংশেই সংকুচিত হয়ে এসেছে।

দেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী ২০২৩ সালে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতন ঘটলে, ১৯৭৯ সালের মত এই জন্ম-সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর আদর্শিক পুনর্জীবনের সুযোগ না দেয়াই দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কল্যাণকর হবে। বর্তমান প্রজন্ম গত পনেরো বছর ধরে ফ্যাসিবাদের দানবীয় রূপ দেখেছে। একজন তিরিশের যুবক বাংলাদেশে তার ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারে নাই। পুলিশি নির্যাতন, গুমখুন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার আশংকায় সে সর্বক্ষণ আতংকিত থেকেছে। দেশের শান্তিপ্রিয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জণগোষ্ঠীকে অসত্য “জঙ্গীবাদি”র তকমা লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। বাঙ্গালী মুসলমানের নিজস্ব সংস্কৃতি, দেশের স্বাধীনতা, শিক্ষা ও মুল্যবোধের সার্বিক অবক্ষয় ঘটিয়ে ফ্যাসিবাদের উত্থান ঘটেছে। ভবিষ্যতে এদের পুনরুত্থান রহিত করতে এবার প্রয়োজন ইতিহাসের আলোকে “শেখ মুজিব মিথ” এর প্রকৃত রূপ উদঘাটন। ভারতীয় আধিপত্যবাদ মুক্ত বাংলাদেশে দেশপ্রেমিক এবং নীতিনিষ্ঠ, বিদ্বান ও ইতিহাসবিদদের ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সঠিক ও নির্মোহ ইতিহাস প্রণয়নের দায়িত্ব নিতে হবে। দূর্ভাগ্যজনকভাবে, সেই দায়িত্বটি আজ পর্যন্ত তারা পালন করেন নাই। সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার মাধ্যমে একজন অগণতান্ত্রিক, স্বৈরাচারী, শেখ মুজিবকে দেবতা বানানোর অপচেষ্টা থেকে জাতিকে তারাই সম্ভবত: মুক্তি দিতে পারেন।

লেখক: সম্পাদক, আমার দেশ
২৯/০৪/২০২৩