শুধু বিরোধী দল নয়, নিজের দলের বিরুদ্ধ মতের নেতা-কর্মীদেরও এলাকাছাড়া করেছেন তিনি। ঘরছাড়া করেছেন অনেককেই। ভেঙে দিয়েছেন স্থানীয় সরকারের নির্বাচনী ব্যবস্থা। পছন্দের লোক ছাড়া জনপ্রতিনিধি হতে পারতেন না কেউ। সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা দখল করে গড়ে তোলেন বাগানবাড়ি, বিপণিবিতান। গুম-খুনের অভিযোগ তো আছেই। এত সব অভিযোগ যাঁর বিরুদ্ধে, তিনি হলেন আওয়ামী লীগের সাবেক সংসদ সদস্য এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী।
চট্টগ্রাম-৬ (রাউজান) আসনের সাবেক এই সংসদ সদস্য যেন নিজ এলাকায় ছিলেন ‘রাজা’। মূলত ২০১৪ সালের সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন ফজলে করিম। কেউ ‘টুঁ-শব্দ’ করার সাহস পেতেন না। তাঁর কারণে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ছাড়াও দুই শতাধিক শিক্ষক, কর্মচারী তাঁদের কর্মস্থল রাউজানে যেতে পারেননি। ফজলে করিমের ৭০ থেকে ৮০ জনের একটি বাহিনীও সক্রিয় ছিল।
ধর্মীয় একটি আধ্যাত্মিক সংগঠনের ৪৬টি কার্যালয় গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগও রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। এত দিন কেউ ভয়ে মুখ না খুললেও এখন এলাকায় ফিরছেন। প্রতিকার চেয়ে মামলাও করছেন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম আদালত প্রাঙ্গণে বিক্ষুব্ধ লোকজন ফজলে করিমকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান ঘিরে বিক্ষোভ করেছেন। সরেজমিন ভুক্তভোগীদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
ফজলে করিম ১৯৯৬ সালের আগে যুক্ত ছিলেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এনডিপি) রাজনীতিতে। আওয়ামী লীগবিরোধী এই দল ছিল যুদ্ধাপরাধের দায়ে দণ্ডিত হয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়া সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর। ফজলে করিম সালাউদ্দিন কাদেরের চাচাতো ভাই। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেলেও বিপুল ভোটে হেরে যান ফজলে করিম। এরপর ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হন তিনি। এরপর ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালেও আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হয়েছেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন।
রাজনৈতিক প্রভাবের সঙ্গে বেড়েছে তাঁর সম্পদও। আওয়ামী লীগের টানা ক্ষমতায় থাকা ১৫ বছরে তাঁর বার্ষিক আয় বেড়েছে ১১ গুণ।
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর কিছুদিন আত্মগোপনে ছিলেন ফজলে করিম। ১২ সেপ্টেম্বর অবৈধভাবে ভারতে যাওয়ার সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া সীমান্তের আবদুল্লাহপুর এলাকা থেকে ফজলে করিমকে আটক করে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকা ফজলে করিমের বিরুদ্ধে হত্যা, জায়গা দখল, গুমের অভিযোগে ১২টি মামলা হয়েছে। অবৈধভাবে তাঁর দখলে থাকা জমির তালিকা তৈরি করছে স্থানীয় প্রশাসন।
ভোট নয়, পছন্দের লোকই জনপ্রতিনিধি
২০১৪ সালে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাউজান থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এর পর থেকে রাউজানে স্থানীয় সরকারের প্রায় সবপর্যায়ের নির্বাচনে বিনা ভোটের প্রচলন শুরু হয়।
২০১৬ সালে অনুষ্ঠিত ১৪টি ইউপি নির্বাচনের মধ্যে ১১টিতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০২১ সালে ১৪ ইউনিয়নের সব কটিতেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় চেয়ারম্যান ও সাধারণ সদস্যরা নির্বাচিত হন। ২০১৯ সালের উপজেলা পরিষদ নির্বাচনেও চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও সংরক্ষিত নারী চেয়ারম্যান পদে সবাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। ২০২৩ সালেও তিনটি পদে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই তিনজন নির্বাচিত হন।
তবে ২০১১ সালের পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েও এলাকায় যেতে পারেননি উত্তর জেলা বিএনপির সদস্যসচিব আবদুল্লাহ আল হাছান। তিনি ২০১৮ সালে মারা যান। এরপর ২০১৫ সালের নির্বাচনে ফজলে করিমের পছন্দের প্রার্থীকে পাশ কাটিয়ে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে নির্বাচন করেন উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক দেবাশীষ পালিত। কিন্তু নির্বাচিত হয়েও তিনি এলাকায় যেতে পারেননি। ২০২১ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হন ফজলে করিমের অনুসারী উপজেলা যুবলীগের সভাপতি জমির উদ্দিন। সাধারণ সদস্যরাও নির্বাচিত হন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়।
বিরুদ্ধ মতের নেতা-কর্মী এলাকাছাড়া
ফজলে করিমের লোকজনের বাধা, হামলা ও মামলার কারণে টানা ১৫ বছর এলাকাছাড়া ছিলেন রাউজান উপজেলা বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান গিয়াস উদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘সাধারণ নেতা-কর্মী দূরের কথা, আমি নিজেও যেতে পারিনি। সরকার পতনের পর রাউজানে বিএনপির নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে বিজয় মিছিল ও সমাবেশ করেছেন।’ একই কথা বলেছেন রাউজানের বাসিন্দা ও উত্তর জেলা বিএনপির আহ্বায়ক গোলাম আকবর খোন্দকারও।
শুধু বিএনপি নয়, নিজ দলের অনেক নেতাকেও এলাকাছাড়া করেছেন ফজলে করিম। এসব নেতা-কর্মীর মধ্যে রয়েছেন চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, যুগ্ম সম্পাদক দেবাশীষ পালিত, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মুসলিম উদ্দিন খান, সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম চৌধুরী, উপজেলা উত্তরের সভাপতি জিল্লুর রহমান, উপজেলা দক্ষিণের সভাপতি সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন। মুসলিম উদ্দিন খান তাঁর নির্দেশের বাইরে গিয়ে উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে নির্বাচন করতে চাইলে তাঁকে এলাকাছাড়া করা হয়। অন্যরাও এলাকাছাড়া হন তাঁর মতের বিরুদ্ধে গিয়ে।
দেবাশীষ পালিত প্রথম আলোকে বলেন, ‘জনগণের ভোটে নির্বাচিত হয়েও বিরোধী দলের মতো পালিয়ে বেড়াতাম। কেউ আমার ফেসবুকে লাইক, কমেন্ট করলে তাঁকে ধরে নিয়ে মারধর করা হতো। ফজলে করিম আমাকে কর্মীশূন্য করে ফেলেছিলেন।’
সাইফুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘মেয়র নির্বাচনের মনোনয়ন ফরম কেনায় আমার বাড়িতে হামলা চালায় ফজলে করিমের লোকজন। এর পর থেকে আমি এলাকাছাড়া। মা-বাবার কবর পর্যন্ত জিয়ারত করতে যেতে পারিনি।’
গুম-খুনের অভিযোগ
দেশে ফিরে গত ফেব্রুয়ারিতে মা-বাবার কবর জিয়ারত করতে গ্রামে যান ওমানের ওয়ালজিয়া শাখা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ মুসা (৪৫)। তাঁর ভাই মুহাম্মদ সোহেল বলেন, ফজলে করিমের লোকজন এসে মসজিদ থেকেই মুসাকে পিটিয়ে বের করেন। পিটুনিতে তাঁর ভাইয়ের মৃত্যু হয়। ভাইয়ের লাশ মসজিদের পাশে ফেলে রেখে যায় খুনিরা।
কেন্দ্রীয় ছাত্রদলের সাবেক সহসাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম হত্যা মামলায় তাঁর স্ত্রী সুমি আক্তার বাদী হয়ে ১ সেপ্টেম্বর নগরের চকবাজার থানায় মামলা করেন। এতে ফজলে করিম চৌধুরীসহ ১৭ জনকে আসামি করা হয়। মামলায় বলা হয়, নগরের বাসা থেকে ২০১৭ সালের ২৯ মার্চ রাতে পুলিশ পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছিল নুরুল আলমকে। পরদিন চোখ, হাত-পা বাঁধা অবস্থায় লাশ উদ্ধার করা হয় তাঁর গ্রামের বাড়ি রাউজানের খেলারঘাট কর্ণফুলী নদীর তীর থেকে। নিহতের স্ত্রী সুমি আক্তার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার তিন সন্তানকে এতিম করেছেন ফজলে করিম। এত দিন মামলাও করতে পারিনি।’
২০১৩ সালে উপজেলার বাগোয়ানে মোজাম্মেল হক ও মুহাম্মদ সুমনকে পিটিয়ে হত্যা, ২০১৫ সালে যুবদল নেতা আবুল হাশেম, ২০১৯ সালে মুক্তিযোদ্ধা নুরুল আজিম, ২০২০ সালে যুবদল নেতা আবদুর রশিদকে খুনের ঘটনায় ফজলে করিম জড়িত বলে দাবি নিহতদের পরিবারের।
২০১০ সালে চট্টগ্রাম নগর থেকে নিখোঁজ উপজেলা যুবলীগের সাবেক নেতা আজিম উদ্দিন মাহমুদ এবং ২০১১ সাল থেকে নিখোঁজ বাগোয়ান ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান আবু জাফরকে গুম করার অভিযোগ রয়েছে ফজলে করিমের বিরুদ্ধে। আবু জাফরকে একটি মাইক্রোবাসে করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়। দুজনের খোঁজ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি।
জমি দখল করে বাগানবাড়ি
রাউজান পৌরসভার ফকির তাকিয়া এলাকায় ৫ একর জায়গার ওপর ফজলে করিম চৌধুরী ২০১৫ সালে গড়ে তোলেন বাগানবাড়ি। চারপাশে গ্রিল দিয়ে ঘেরা। সেখানে দুটি বাংলো, গরুর খামার, পশু, পাখি ও হরিণের খাঁচা রয়েছে। সরকার পতনের পর সেখানে হামলা চালায় বিক্ষুব্ধ লোকজন।
বাগানবাড়ির ৫ একর জমির মধ্যে ২ দশমিক ৩৮ একর খাসজমি বলে জানান রাউজান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রিদুয়ানুল ইসলাম। বাকি জমিও স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দাকে জিম্মি করে দখল করার অভিযোগ রয়েছে।
বাগানবাড়ির জন্য বন বিভাগেরও ৮০ শতক জায়গা দখল করার অভিযোগ রয়েছে। রাউজান উপজেলা বন কর্মকর্তা উজ্জ্বল কান্তি মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, তিনি যোগ দেওয়ার আগেই এসব জায়গা দখল করা হয়েছে।
স্থানীয় বাসিন্দা বখতিয়ার উদ্দিন বলেন, বাগানবাড়িতে তাঁর পৈতৃক ১৪০ শতক জায়গা দখল করেছেন ফজলে করিম। তাঁর মতো স্থানীয় তোফায়েল আহমদ ও জাফর আহম্মদ নামে দুই ভাইয়ের ৮০ শতক জায়গা দখল করা হয়েছে। এ ছাড়া বাগানবাড়ির জন্য দখল করা হয়েছে নুরুল ইসলাম নামের আরেক ব্যক্তির জায়গা। বাগানবাড়ির পাশে স্থানীয় বাসিন্দাদের জমি দখল করে ফজলে করিম একটি পেট্রলপাম্প তৈরি করেছেন। জমির মালিকদের টাকা পরিশোধ না করেই এসব জমি রেজিস্ট্রি করিয়ে নেওয়া হয়েছে।
২৩ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের আদালতে ফজলে করিম, তাঁর দুই ছেলে ফারাজ করিম চৌধুরী, ফারহান করিম চৌধুরীসহ নয়জনের বিরুদ্ধে জমি দখলের অভিযোগে আদালতে একটি মামলা করেন উপজেলার ফরেস্ট বিট এলাকার বাসিন্দা ইসলাম মিয়া।
ফজলে করিমের নির্দেশে সরকারি ও ব্যক্তিমালিকানাধীন জায়গা দখল করে রাউজানের ১৪টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের কার্যালয় গড়ে তোলার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
ফজলে করিমের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তাঁর স্ত্রী রিজওয়ানা ইউসুফ প্রথম আলোকে বলেন, সব ষড়যন্ত্র, অভিযোগের কোনো প্রমাণ নেই। তাঁর স্বামী গুম-খুনেও জড়িত নন, তিনি রাউজানের উন্নয়ন করেছেন।
গড়ে তোলেন বিপণিবিতান
উপজেলার নোয়াপাড়া পথেরহাট বাজারে সরকারি খাস এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের ১৫ শতক জমি দখল করে একটি তিনতলা ভবন গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে ফজলে করিমের বিরুদ্ধে। ভবনের নিচতলায় ১টি কমিউনিটি সেন্টার ও ১২টি দোকান এবং ওপরে রয়েছে একাধিক ব্যাংক ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান।
ওই ভবনের ৫০০ মিটার পশ্চিমে নতুন একটি দোতলা ভবনের কাজ শেষ হয়েছে। ব্যবসায়ীরা জানান, এটি সড়ক ও জনপথের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে। ফজলে করিমের যোগসাজশে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান মুহাম্মদ বাবুল মিয়াসহ কয়েকজন ভবনটি নির্মাণ করেন। ভবনের ২৫টি দোকান এরই মধ্যে ৪০-৪৫ লাখ টাকা করে বিক্রি করা হয়েছে।
একইভাবে দলীয় লোকজন দিয়ে এর পাশে আরেকটি দোতলা বিপণিবিতানও গড়ে তোলা হয়েছে সরকারি জায়গায়। রাঙামাটি-রাউজান সড়কের পশ্চিম গহিরার হালদা সেতু এলাকায়ও সরকারি জায়গা দখল করে তিনতলা একটি ভবন নির্মাণ করার অভিযোগ রয়েছে ফজলে করিমের বিরুদ্ধে।
রাউজান উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মুহাম্মদ রিদুয়ানুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, উপজেলার একাধিক ইউনিয়নের বাজার, সড়কের পাশে সরকারি জমি দখলের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। শিগগিরই এসব জমি উদ্ধারে অভিযান চালানো হবে।
কর্মস্থলে যেতে পারেননি ২০০ শিক্ষক-কর্মচারী
রাউজানের গহিরা কলেজের ব্যবস্থাপনা বিভাগের প্রভাষক গোলাম ফারুক ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কয়েক দিন পর থেকে আর কলেজে যেতে পারেননি। এ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি কলেজে যোগ দেন।
গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচনে রাউজানের নদিমপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তিনি প্রিসাইডিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর কাছে অবৈধভাবে সিল মারার জন্য ব্যালট পেপার চাওয়া হয়েছিল। তিনি দিতে রাজি হননি। এরপর ফজলে করিম তাঁকে কলেজে আসতে বারণ করেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ নানা জায়গায় যোগাযোগ করেও তিনি কর্মস্থলে ফিরতে পারেননি।
শুধু গোলাম ফারুক নন, তাঁর মতো রাউজানের স্কুল-কলেজ–মাদ্রাসার ২০০ শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারী দীর্ঘদিন কর্মস্থলে যেতে পারেননি। সরকার পরিবর্তনের পর তাঁরা কর্মস্থলে ফিরেছেন। তবে এর মধ্যে কয়েকজনের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়েছে। মারাও গেছেন কয়েকজন।
নোয়াপাড়া উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হাবিব উল্লাহ বলেন, বিএনপি–সমর্থক সন্দেহে ২০১৭ সালে তাঁকে এলাকা ও স্কুলছাড়া করা হয়েছিল। তাঁর বাড়িতেও অন্তত পাঁচবার হামলা ও ভাঙচুর করা হয়।
গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় মুনিরীয়ার ৪৬ কার্যালয়
তরীকতভিত্তিক আধ্যাত্মিক সংগঠন মুনিরীয়া যুব তবলিগ কমিটির ৪৬টি শাখা কার্যালয় ও ইবাদতখানা ২০১৯ সালে গুঁড়িয়ে দেওয়ার অভিযোগ রয়েছে ফজলে করিমের বিরুদ্ধে। এর বাইরে বাকি কার্যালয়গুলোতেও মেরে দেওয়া হয় তালা। হামলা-মামলার শিকার হন সংগঠনের পাঁচ শতাধিক কর্মী ও ভক্ত। মামলায় কারাভোগ করেন ৭৪২ জন। ভাঙচুর হয় ৮০০ সদস্যের বাড়িঘর ও দোকানপাট।
মুনিরীয়া যুব তবলিগ কমিটি বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় পরিষদের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল মনসুর বলেন, রাউজানে ৫০ শতাংশ মানুষ তাঁদের দরবারের অনুসারী। এ কারণে ফজলে করিম এ দরবারের পীর সাহেবকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতেন। তাই হামলা-মামলায় মুনিরীয়ার কর্মীদের এলাকাছাড়া করেন ফজলে করিম। তিনি বলেন, আগে আইনের আশ্রয় নেওয়াও সম্ভব হয়নি। সম্প্রতি আটটি মামলা হয়েছে। আরও মামলার প্রস্তুতি চলছে।
উন্নয়ন প্রকল্প থেকে ১০ শতাংশ কমিশন
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাউজানে ১৫ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এসব কাজে ফজলে করিমকে ১০ শতাংশ হারে কমিশন দিতে হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারেরা। বেশির ভাগ দরপত্রে অংশ নিতে পারতেন না ঠিকাদারেরা। পছন্দসই ব্যক্তিকে দেওয়া হতো কাজ।
বাগোয়ান ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ও ঠিকাদার মুহাম্মদ মাহবুব আলম প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৬ সালে তিনি ২২ লাখ টাকা বরাদ্দের একটি সড়কের কাজ করেছিলেন। সে সময় তাঁকে ১০ শতাংশ কমিশনের ২ লাখ ২২ হাজার টাকা ফজলে করিমকে অগ্রিম দিতে হয়েছিল। একই ধরনের অভিযোগ করেছেন আরও কয়েকজন ঠিকাদার।
১৬ বছরে আয় বেড়েছে ১১ গুণ
রাউজানে ২০০৮ সাল থেকে টানা চারবার ২০২৪ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ফজলে করিম চৌধুরী। ২০০৮ সালের তুলনায় এখন তাঁর বার্ষিক আয় বেড়েছে ১১ গুণ। আগে শুধু ব্যবসা থেকে আয় এলেও এখন কৃষি ও মৎস্য খাতে নতুন করে বিনিয়োগ করেছেন তিনি। নির্বাচন কমিশনে গত বছরের ডিসেম্বরে জমা দেওয়া হলফনামা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
১৬ বছর আগে ২০০৮ সালে ফজলে করিমের বার্ষিক আয় ছিল ২১ লাখ ১৯ হাজার টাকা। এখন তাঁর বার্ষিক আয় ২ কোটি ৩২ লাখ টাকা। ১৬ বছর আগে এ বি এম ফজলে করিম চৌধুরীর অস্থাবর সম্পত্তি ছিল ৮৩ লাখ টাকার। এখন তাঁর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ ৪ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রামের সম্পাদক আখতার কবির চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, সারা দেশের মধ্যে রাউজান ছিল আলাদা। এখানে তাঁর কথাই ছিল শেষ কথা। ভয়ে কেউ মুখ খুলতে পারেননি। এখন ফজলে করিমের দখল, দুর্নীতি, অবৈধ সম্পদের তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
prothom alo