আইন মানুষের জন্য, নাকি মানুষ আইনের জন্য

  • ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
  •  ২৫ এপ্রিল ২০২২, ২০:১৩

মহাগ্রন্থ আল-কুরআন শুধু ধর্মীয় গ্রন্থই নয়, বরং এটি আইনের উৎসগ্রন্থও। ধর্ম বলতে যা বোঝায়, সেই সব বিষয়ের পাশাপাশি পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সব সমস্যার সমাধানে দিকনির্দেশনা রয়েছে এতে দেড় হাজার বছর ধরে। সামাজিক ও ব্যবসায়িক লেনদেন, রাজনীতি, মানবাধিকার সংক্রান্ত আইন চূড়ান্তরূপে লিপিবদ্ধ রয়েছে কুরআনে, যা অমোচনীয়, অলঙ্ঘনীয় ও অপরিবর্তনীয়। কুরআন এসেছে মানবজাতিকে পথ দেখাতে। তাই এতে বিধিবিধান, নিয়মনীতি ও আইনকানুন এমনভাবে বিবৃত হয়েছে, যা সর্বকালে সর্বজনীন ও মানানসই এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জন্য সহজসাধ্য। এ সম্পর্কে কুরআনে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলা হচ্ছে, ‘আল্লাহ কারো ওপর তার সাধ্যাতীত ভার চাপিয়ে দেন না।’ (সূরা আল-বাকারা, আয়াত-২৮৬) কুরআনের সব আয়াত ওহি বা প্রত্যাদেশের মাধ্যমে এই মাটির পৃথিবীতে নাজিল হয়েছে। এই আয়াতে রয়েছে মহান স্রষ্টার পরম ভালোবাসার ছোঁয়া।

আইন বা নির্দেশ হতে হবে গ্রহণযোগ্য। যা পালনযোগ্য নয়, তা প্রত্যাহারযোগ্য এবং সংশোধনীয়। সূরা মুজাদালায় বর্ণিত একটি সংশ্লিষ্ট ঘটনা এখানে উল্লেখ করার মতো। ঘটনাটি রাসূলুল্লাহ সা:-এর সাথে একান্তে কথা বলা নিয়ে। তিনি সবার প্রিয়ভাজন। সবার মধ্যমণি। সবাই চায় তাঁর সাথে একান্তে কথা বলে মনের ভার মুক্ত করতে। সবাই চায় মন খুলে কথা বলে তাঁর সান্নিধ্যের পরম পরশ লাভ করতে। কিন্তু এভাবে সবাইকে একান্তে সময় দিতে গেলে কয়জনই বা সুযোগ পাবে। আল্লাহ তায়ালা বললেন, ‘হে মুমিনগণ, তোমরা রাসূলের সাথে চুপিচুপি একান্তে কথা বলতে চাইলে তার আগে সাদাকা প্রদান করো।’ (সূরা মুজাদালাহ, আয়াত-১২) মূলত মুনাফিকদের দুরভিসন্ধি বন্ধের জন্য এ আইন চালু করা হয়। হজরত আলী রা: এক দিনার সাদাকা করে এ আইন বাস্তবায়ন করেন। কিন্তু সাহাবায়ে কেরামের অনেকেই অসুবিধার সম্মুখীন হন। ফলে অল্প সময়ের মধ্যেই আল্লাহ তায়ালা এ বিধান রহিত করে দেন। এতে শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, আইন সর্বজনীন হতে হবে। কারণ মানুষের সুবিধার জন্যই আইন প্রণীত হয়। আর সেই আইনই যদি মানুষের জন্য বোঝা হয়ে যায়, তাহলে তার কার্যকারিতার আবেদন হারিয়ে যায়।

মানুষ আইনের জন্য নয়, বরং আইন মানুষের জন্য। এর আরেকটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে, রোজার সময়-পরিধির সংস্কার। দ্বিতীয় হিজরিতে প্রথমবারের মতো মুসলমানদের জন্য রমজান মাসে রোজা ফরজ করা হয়। একেবারে প্রথম দিকে বিধান ছিল সূর্যাস্তের পর থেকে শয্যাগ্রহণের আগ পর্যন্ত যাবতীয় পানাহার ও স্ত্রী-ব্যবহার বৈধ। শয্যাগ্রহণের পর এগুলো নিষিদ্ধ। একদিন কায়স ইবনে সারমা রা: নামে এক সাহাবি ইফতারের সময় বিবির কাছে ঘরে খাবার আছে কি না জানতে চাইলেন। তিনি জানালেন, ঘরে খাবার নেই। তিনি বললেন, একটু অপেক্ষা করুন, আমি খাবার জোগাড় করে নিয়ে আসছি। তিনি খাবার জোগাড় করে এসে দেখেন, তার স্বামী সারাদিন খেজুর বাগানে কাজ করার কারণে প্রচণ্ড ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে গেছেন। ফলে তার আর খাওয়া হলো না। পরদিন দুপুর বেলায় তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এ ধরনের আরো কয়েকটি ঘটনা ঘটে। রাসূলুল্লাহ সা:কে এ সম্পর্কে অবহিত করা হয়। সাথে সাথে আল্লাহ তায়ালা এ বিধান সংস্কার করে দেন। সব রকম পানাহার ও স্ত্রী-ব্যবহারের সময়সীমা সুবহে সাদিক পর্যন্ত বর্ধিত করে দেয়া হয়। এখানে শিক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে- যার জন্য আইন প্রণীত করা হয়, তার আইন পালনের সক্ষমতার প্রতি অবশ্যই খেয়াল করতে হবে। গায়ের জোরে ক্ষমতার দাপটে আইন চাপিয়ে দিলেই কেবল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না।

আইনের যথাযথ যৌক্তিকতা ও উপযুক্ততা থাকা সত্ত্বেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে, এর দ্বারা জনগণের মাঝে যেন বিভ্রান্তি ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি না হয়। যেমন কুরাইশরা যখন কাবাঘর ভেঙে পুনর্নির্মাণ করে, তখন হালাল অর্থের অভাবে কাবার অংশ হাতিমকে হজরত ইবরাহিম আ: কর্তৃক স্থাপিত পূর্ণ ভিত্তির ওপর রাখা সম্ভব হয়নি। এটা কাবাঘরের বাইরে থেকে যায়। রাসূলুল্লাহ সা:-এর ঐকান্তিক মনোবাসনা ছিল, কাবাকে ভেঙে পুনর্নির্মাণ করা ও হাতিমকে মূল কাবার ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা। কিন্তু তিনি তাঁর নিষ্কলুষ দূরদর্শিতা দিয়ে অনুভব করেছিলেন, যদি কাবাকে ভেঙে পুনরায় নির্মাণ করা হয়, তাহলে বিশাল বড় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এ জন্য তিনি কাবাকে কুরাইশ কর্তৃক নির্মিত অবস্থাতেই রেখে দেন এবং তাতে কোনো পরিবর্তন করেননি। কাবাঘর ভেঙে হাতিমকে অন্তর্ভুক্ত করে পুনর্নির্মাণ করা যৌক্তিক ছিল। তারপরও বিভেদ ও বিশৃঙ্খলা এড়াতে রাসূলুল্লাহ সা: ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তা বাস্তবায়ন করেননি।

আইন জারির আগে খেয়াল রাখা দরকার, যাদের জন্য আইন জারি করা হচ্ছে, তাদের মাঝে এটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে কি না। আইন পালন করা সম্ভব কি না, তার প্রতি খেয়াল না রেখে আইন জারি, বাস্তবায়ন ও প্রয়োগের চেষ্টা করলে আইনের শাসন নয়, বরং দুঃশাসনের রাজ কায়েম হয়। সর্বত্র বিশৃঙ্খলা ও অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়। সমাজে ওপর-নিচ ভেদাভেদ তৈরি হয়। আইন ভঙ্গ করা ও বিদ্রোহের মনোভাব সৃষ্টি হয়। জাতীয় স্বার্থ বা সর্বজনীনতার দিকে লক্ষ না রেখে অনেক সময় শুধু নিজের চিন্তা, আদর্শ ও প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য আইন জারি করা হয়। ফলে আইনটি অনিবার্যরূপে প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে। জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র বিশেষের প্রতি লক্ষ রেখে আইন, নীতি ও প্রজ্ঞাপন জারি করা উচিত। কোনো কিছুই যেন কারো সাধ্যাতীত এবং মতাদর্শবিরোধী না হয়।

আমরা খুব ভালো করে দেখতে পাচ্ছি, এ দেশে এ নীতির কোনো তোয়াক্কা করা হচ্ছে না। অনেকগুলো উদাহরণের মধ্যে একটি উদাহরণ দিচ্ছি। লকডাউনের সময় গাড়ি বন্ধ রেখে কাজে যোগ দিতে বলা হলো। কিভাবে যোগ দেবে তার প্রতি খেয়াল রাখা হলো না। ফলে চরম অমানবিকতার নির্মম চিত্র আমাদের সবাইকে দেখতে হয়েছে। আইনের বাস্তবায়ন নিয়ে মাঝে মধ্যে আমরা সাধারণ ভুক্তভোগী মানুষের সাথে প্রশাসনের কঠিন যুদ্ধ দেখি। তখন প্রশ্ন জাগে আইনের জন্যই কী মানুষ, নাকি মানুষের জন্য আইন? বাল্যবিয়ের বিরুদ্ধে যেভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে মনে হয় দেশে ওই একটিই শুধু বেআইনি কাজ। আমরা নিজেদের মুসলমান দাবি করি, কিন্তু আমরা পবিত্র কুরআন থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না। আমরা নিজেদের আশেকে রাসূল দাবি করি, কিন্তু রাসূলের মহান জীবনাদর্শ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করি না। ব্যক্তি, পরিবার, সংস্থা, সংগঠন এমনকি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকেও মাঝে মাঝে এমন আইন বা নির্দেশনা জারি করা হয়, যা ক্ষোভ, দ্রোহ ও চরম অসন্তোষের জন্ম দেয়।
আল্লাহ মানুষকে পথ দেখানোর জন্য কোনো ফেরেশতা পাঠাননি। তিনি মানুষকে পথ দেখানোর জন্য মানুষের মধ্য থেকেই নির্বাচিত মানুষকে পাঠিয়েছেন। এ সমাজের হর্তাকর্তারাও মানুষ। কিন্তু মানুষ হয়েও তারা কখনো কখনো রোবটের মতো অনুভূতিহীন অমানবিক হয়ে যান। ফলে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা স্বপ্নই থেকে যায়। যাবতীয় আইন, নীতি, নির্দেশনা ও প্রজ্ঞাপন জারির ক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল করতে হবে, মানুষ আইনের জন্য নয়, বরং আইন মানুষের জন্য। তবেই ভেদাভেদহীন সুখী সমৃদ্ধ পারস্পরিক সহমর্মিতার সমাজ ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে।

লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক