আইনাঙ্গনেও পেশিজীবী : জাতীয় নির্বাচনের রিহার্সাল!

  • রিণ্টু আনোয়ার
  •  ১৮ মার্চ ২০২৩, ২১:২৯

জাতীয় রাজনীতির পথপরিক্রমায় পেশাজীবী সংগঠনগুলোর মধ্যেও এখন পেশির দাপট। তা বিচারাঙ্গনে, আইনজীবীদের সংগঠনেও। দেশের সর্বোচ্চ বিচারালয়ের আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে যা ঘটে গেল তা আগামী দিনের জন্য কঠিন বার্তা। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। কেমন হবে নির্বাচনটি? এ প্রশ্ন যখন দেশের বার্নিং ইস্যু, তখন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে যা ঘটেছে, তা কেবল ন্যক্কারজনক নয়; জাতীয় নির্বাচনের একটি ড্রেস রিহার্সাল কি না, সচেতনদের মধ্যে এ নিয়ে জোর আলোচনা, তীব্র উদ্বেগ। আগের বার ছিল এ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ। এবার যোগ হলো সহিংসতা। দায়িত্বরত সাংবাদিকদেরও পিটিয়ে আধমরা করে দিয়েছে পুলিশ। দেশের বড় দু’দলের আইনজীবীরা ধাক্কাধাক্কি, মারধর, ভাঙচুর কিছুই বাদ দেননি। এরপর আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীদের নিরাপদে রেখে পুলিশ বেধড়ক পেটাল বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের। সাথে সাংবাদিকদেরও। কয়েকজনের পরনের জামাকাপড় ছিঁড়ে ফেলা হয়। বাকি রেখেছে দিগম্বর করা। টানা কয়েকদিন চলে এ অ্যাকশনের জের।

আওয়ামী লীগপন্থী আইনজীবীদের সাদা দল ও বিএনপিপন্থী আইনজীবীদের নীল দলে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবীদের পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনী এ কাণ্ডকীর্তি সাধারণ মানুষের জন্য জাতীয় নির্বাচনী বার্তার মতো। সামরিক শাসনামলেও পেশাজীবী সংগঠনগুলো শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করেছে। এ মানের দলবাজিতে জড়ায়নি তারা। অথচ ‘গণতান্ত্রিক’ আমলে নিজস্বতার অপমৃত্যু ঘটিয়ে তারা কেবল নামেই পেশাজীবী। নিজস্ব নির্বাচনকে পর্যন্ত তারা আওয়ামী লীগ-বিএনপির বিষয় করে ফেলেছেন।

সাংবাদিকদের সংগঠন, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের সংগঠনেরও একই হাল। ব্যবসায়ীদেরও তাই। চলচ্চিত্রের নায়ক-নায়িকাসহ অভিনেতারাও। ঘাট শ্রমিকদের সংগঠনগুলোর অবস্থা এর চেয়ে ভিন্ন নয়। তিন-চার দিন আগে আগামী সংসদ নির্বাচনে সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব পালন বাধাগ্রস্ত না হওয়ার বিষয়ে যাবতীয় ব্যবস্থা রাখার নিশ্চয়তা দিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার। বাস্তবে তার এ অঙ্গীকার-চিত্র কী হবে বা হতে পারে- এর একটি নমুনা মিলেছে তাদের সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচনী সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে।

পরিচয়পত্র ও মাইক্রোফোন এবং ক্যামেরা থাকা সত্তে¡ও তাদেরকে হামলা থেকে একটুও রেহাই দেয়নি পুলিশ; বরং আরেকটু বেশি করেছে। পিটুনির সাথে বোনাস হিসেবে অশ্রাব্য গালিগালাজ। হামলায় আহত সাংবাদিকদের আটকেও রাখা হয়েছে। এটিএন নিউজের জাবেদ আখতার, জাগো নিউজের ফজলুল হক মৃধা, ইনডিপেন্ডেন্ট টিভির জান্নাতুল ফেরদাউস তানভী, বৈশাখী টিভির ইব্রাহীম, মানবজমিনের আব্দুল্লাহ আল মারুফসহ রিপোর্টার-ক্যামেরাপারসনরা পুলিশের নাজেহাল ও গালমন্দের যে অভিজ্ঞতা পেয়েছেন- ভুক্তভোগী হিসেবে তারাই ভালো জানেন। সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সদস্য প্রায় ৯ হাজার।

গড়পড়তা ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন ছয় হাজার। এক দিনে তিন হাজারের জন্য পুলিশ নিয়োগ দেয়া হয় ৫০০ জন। অর্থাৎ প্রতি ছয় জন ভোটারের জন্য একজন পুলিশ মোতায়েন। এ স্টাইলে জাতীয় নির্বাচন করতে হলে সারা দেশে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে ভোট কাস্ট করতে কত পুলিশ দরকার? সারা দেশে ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ধরলে এর অর্ধেক- ছয় কোটি জনগণ ভোটাধিকার প্রয়োগ করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য দরকার এক কোটি। তা বাংলাদেশে সব বাহিনী মিলিয়েও আছে? হিসাবটির মধ্যেও বার্তা কম নয়। পেশাজীবী সংগঠনের নির্বাচনে পরাজয় ঠেকাতে এমন লাঠিতন্ত্র চালালে জাতীয় নির্বাচনে কী না করতে হবে? তার চেয়ে বড় কথা, মানুষ যে অঙ্গনে ন্যায়বিচারের প্রত্যাশায় ঘোরে, যে অঙ্গনটিকে ভরসা হিসেবে সমীহ করে, সেখানেই এ দৃশ্য বড় বেদনার।

পেশাজীবী সংগঠনগুলো পেশাদারিত্ব হারিয়েছে কবেই। পেশার চেয়ে দলীয় রাজনীতিই তাদের কাছে মুখ্য। আইনজীবীরা যেন আরো এগিয়ে। সেই ধারাতেই বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ ও জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেল নামে দু’টি সংগঠনের লড়াই। ঘটনার সূত্রপাত এ নির্বাচন পরিচালনাসংক্রান্ত উপকমিটির আহ্বায়ক, সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরীর পদত্যাগকে কেন্দ্র করে। বর্তমান সভাপতি ও সম্পাদক আলাদা ব্যালটপেপার তৈরি করে যেভাবে বলবেন, সেভাবে কাজ করতে বলায় তিনি পদত্যাগ করেছেন। মোট কথা, তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে। দেরি না করে আওয়ামী লীগ সমর্থিত আইনজীবীরা নির্বাচন পরিচালনা উপকমিটির আরেকজন আহ্বায়ক ঠিক করে ফেলেন। তারা মো: মনিরুজ্জামানকে আহ্বায়ক করতে না করতে বিএনপি-সমর্থিত আইনজীবীরা আহ্বায়ক মনোনীত করেন এ এস এম মোকতার কবির খানকে। এরপর গণ্ডগোল পাকাতে আর সময় লাগেনি। ব্যালটপেপারে সই করা নিয়ে রীতিমতো মাছ বাজারের কাণ্ড। ব্যালটপেপার ছিনিয়ে নেয়া, মিছিল-পাল্টা মিছিল, ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, হাতাহাতি, কিছুই বাকি থাকল না।

পেশাজীবী সংগঠনের আলাদা একটি মর্যাদা রয়েছে। প্রয়োজনও রয়েছে। আমাদের দেশে সামরিক শাসনবিরোধী দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনে সম্মিলিত পেশাজীবী আন্দোলন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং পেশাজীবীদের রাজনীতি-নিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে তখন সাধারণ মানুষের কাছে সে আন্দোলন সহজে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। শিক্ষক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, সাংবাদিকসহ বুদ্ধিবৃত্তির নানা পেশায় নিয়োজিত কর্মীদের আমরা সাধারণত পেশাজীবী হিসেবে বিবেচনা করে থাকি। নিজ নিজ ক্ষেত্রে পেশাগত নানা সমস্যা তাদের প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হয়। সে কারণে পেশাজীবীদের নানা স্তরে গড়ে উঠেছে পেশাভিত্তিক নানা সংগঠন। প্রাথমিক পর্যায়ে এসব সংগঠনের নিজেদের পেশাগত সঙ্কট ও সমস্যা নিয়ে রাজনৈতিক দলের প্রভাবমুক্ত পরিবেশে, অনেকটা অরাজনৈতিক নেতৃত্বের পরিচালনায় আন্দোলন সংগ্রাম করত এবং তাতে বেশ সাফল্য ও মর্যাদা পেশাজীবীরা পেয়েছেন। নব্বই-পরবর্তী সময়ে সরকারে থাকলে দুই বড় দলে সরাসরি বিভক্ত প্রকৌশলী ও চিকিৎসকদের দুই বড় সংগঠন তাদের দুই নির্বাচিত সংস্থা- আইইবি ও বিএমএ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, উচ্চ শিক্ষার সুযোগসহ সব ক্ষেত্রে নেতারা পালন করে চলেছেন একক নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা। নিরীহ, দলনিরপেক্ষ যারা আছেন তারা এ দলবাজির নির্মম ও অসহায় শিকার। এ অশুভ প্রক্রিয়া থেকে পেশাজীবী আন্দোলনকে বের করে আনতে হবে পেশাজীবী ও দেশের স্বার্থে।

বিভিন্ন স্তরের পেশাজীবীর মধ্যে অতীতের পেশাগত স্বচ্ছতা, সততা, আন্তরিকতা, উদারতা ও সাহসিকতার স্থান নিয়েছে দুর্নীতি, সঙ্কীর্ণতা, ভীরুতা ও আত্মপরসর্বস্বতা। অর্থ আর মুনাফার যূপকাষ্ঠে বলি দেয়া হচ্ছে পেশাগত নৈতিকতা ও মানবিক প্রতীতির। অধঃপতিত নেতৃত্বের কারণে পেশাজীবী আন্দোলন আজ দলীয় রাজনীতির বিভক্তির বৃত্তে আটকে পড়েছে। পেশাজীবী আন্দোলনের এ বিভক্তি ও নেতৃত্বের দলবাজি ও সুবিধাবাদিতার কারণে দুর্নীতিবাজ, সুবিধাভোগী, চাটুকারদের সাথে অসম প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ছেন দীর্ঘদিনের পোড়খাওয়া, সৎ, সচেতন, পেশাজীবীদের স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ কর্মী ও নেতারা। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ পেশাজীবী সম্প্রদায়, পিছিয়ে পড়ছে সমাজ, কঠিনতর হচ্ছে প্রকৃত গণতন্ত্রের উত্তরণের সংগ্রাম। পেশাজীবী আন্দোলনের স্বাভাবিক গতিমুখ হলো গণতন্ত্র ও সামাজিক প্রগতিশীলতা।

এসব বিবেচনায় দেশের উন্নয়ন ও সেবামূলক কাজে তাদের অবদান স্বীকার করতেই হবে। তা কৃষি, যোগাযোগ, শিক্ষা, অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, জনকল্যাণ, প্রশাসন, নিরাপত্তা-সব সেক্টরেই। স্বাভাবিকভাবেই পেশাজীবীরা আগে তাদের স্বার্থ দেখবেন। কিন্তু, গত বছর কয়েক ধরে সেখানেও নিখাদ রাজনীতি। চিকিৎসক, প্রকৌশলী, কৃষিবিদ, আমলা, আইনজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষকদের অরাজনীতিক ভাবতে পারলে মানুষের ভালো লাগত। পেশার স্বার্থে পেশাজীবীরা নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সরকারের কাছে দাবিদাওয়া পেশ করার মধ্যে থাকছেন না। কার্যত তাদের সংগঠনগুলো হয়ে পড়েছে রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন। এতে পেশাজীবী সংগঠনগুলোর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য, স্বকীয়তা হারিয়ে গেছে। দেশে এখন পেশাজীবীদের কত সংগঠন আছে, হিসাব পাওয়া কঠিন। তাদের কারোই নিজ নিজ দলের চাওয়ার বাইরে যাওয়ার অবস্থা নেই। বেশির ভাগ পেশাজীবী নেতাই সরকারি চাকরি বা সুবিধাযুক্ত কাজের সাথে জড়িত। নিজেদের সমষ্টিগত সামর্থ্য নিয়ে থাকার অবস্থাও নেই। কমবেশি সবার মধ্যেই এখন ট্রেড ইউনিয়নের প্রবণতা। তা পেশিশক্তিতে রূপ নিয়ে তাদেরও করে তুলেছে পেশিজীবী হিসেবে। সময়ের বিবর্তনে বুদ্ধিবৃত্তিক পেশাগুলোর ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। এসব সংগঠনে দলীয় রাজনীতির প্রত্যক্ষ অনুপ্রবেশ ও বিস্তার ঘটেছে এতটাই যে, পেশা ও পেশাদাররা এখন মূল্যহীন। জ্ঞান, মুক্তবুদ্ধি ও যুক্তি-তর্কচর্চার তীর্থকেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ওপর অতীতে ভরসা করা যেত। এখন আর সেই ভরসাও নেই। সরকার কিংবা ক্ষমতাসীন দল বিব্রত হলে পদ-পদবি-পদকের ক্ষেত্রে বঞ্চিত হওয়ার ঝুঁকি এড়ানোই এখন অগ্রাধিকার। এর অবসান হওয়া চাই। হঠাৎ এখন অবসান সম্ভব নয় সত্য, অন্তত একটু একটু লাগাম টানতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়।

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
rintu108@gmail.com