আহসান এইচ মনসুর। ছবি: মোস্তাফিজুর রহমান
জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
“আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন। ৮ শতাংশের নিচে, অবিশ্বাস্য! এটা বাড়াতে অসুবিধা কোথায়?”
রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল বা আইএমএফ থেকে ৪ দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার ঋণ পেতে সরকার যেসব শর্ত মেনেছে, সেগুলো পূরণ করা ‘এত সহজ নয়’ বলেই মনে করছেন ওই সংস্থার সাবেক কর্মকর্তা আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলছেন, “বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের শর্তগুলো খুবই মৃদু। সেগুলো পূরণ করতে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। তবে, এটা অতটা সহজ হবে না।
“যেমন- প্রথম দিন থেকে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে হবে। আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত বর্তমানে পৃথিবীর মধ্যে সর্বনিম্ন। ৮ শতাংশের নিচে, অবিশ্বাস্য! এটা বাড়াতে অসুবিধা কোথায়? অবশ্যই আমরা এটা বাড়াতে চাই। সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং সরকারকে এটা করার জন্য সংস্কার করতে হবে।”
বর্তমানে গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক এবং ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা এই অর্থনীতিবিদ রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের আলোচনা অনুষ্ঠান ‘ইনসাইড আউট’ এর সূচনা পর্বে অংশ নেন। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম এবং ফেইসবুকে (https://www.facebook.com/bdnews24) অনুষ্ঠানটি লাইভস্ট্রিম করা হয়। প্রতি রোববার দুপুরে এই আলোচনা অনুষ্ঠানটি দেখা যাবে ইংরেজিতে।
আধা ঘণ্টার এই আলোচনায় বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, সংকট আসলে কতটা, সম্ভাবনাই বা কোথায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, মুদ্রা বিনিময় হার, অর্থপাচার, ব্যাংক ব্যবস্থার ‘দুর্বলতা’, আইএমএফের ঋণের মত নানা প্রসঙ্গ উঠে আসে।
ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ সাড়ে ৯ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশে নিয়ে আসার কথা বলছে আইএমএফ, যা নিয়ে সরকারের সঙ্গে আলাপ-আলোচনায় আছে তারা।
এ বিষয়ে আহসান মনসুর বলেন, “এজন্য সরকারকে সর্বোচ্চ ও আন্তরিক পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকার কি আন্তরিকভাবে এটা করবে? মিডিয়া ও রাজনীতিকদের কাছ থেকে আমি যে বার্তা পাচ্ছি, তাতে মনে হচ্ছে আইএমএফের কর্মসূচির আওতায় আমাদেরকে কিছু ‘করতে হবে না’। এই বার্তা আমরা শুনতে চাই না।”
সরকার যে ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ কমানোর কথা বলছে, সেটি যদি করাই যায়, তাহলে এতদিন আইএমএফের অপেক্ষায় থাকা কেন- এমন প্রশ্নও ছিল ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের কাছে।
জবাবে আহসান মনসুর বলেন, “একই বিষয় আমরা অনেক দিন ধরে বলে আসছি, বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদরা একই পরামর্শ দিয়ে আসছেন। সব গণমাধ্যম একই বিষয় নিয়ে প্রতিবেদন করে যাচ্ছে, প্রতিদিন প্রতি সপ্তাহে।
“এটা নতুন কোনো আবিষ্কার নয়। বিষয় হচ্ছে, আমাদের ব্যাংক এখনও ডাকাতি হচ্ছে, ব্যাংকিং খাত থেকে এখনও টাকা নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”
তিনি বলেন, “যারা ধনী ও ক্ষমতাবান, তারা ব্যাংকের টাকা ফেরত দিচ্ছে না। সমস্যা সেখানে রয়েছে, তবে সেটাকে তুলে ধরা হয়নি এবং এটাকে তুলে জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রতিশ্রুতি নেই। এ কারণে আইএমএফ এসেছে, তারা সরকারকে বলছে, ‘তোমরা এটা করো’। এটা সরকারের স্বার্থেই, আমাদের আর্থিক খাত ও দেশের স্বার্থেই। আমাদের উচিত হবে এটা করা।”
কিছুদিন আগে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নেওয়ার যে প্রবণতা দেখা গিয়েছিল, সে প্রসঙ্গেও ব্র্যাক ব্যাংকের চেয়ারম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয় ‘ইনসাইড আউটে’।
জবাবে তিনি বলেন, “যখন তারা শোনে, ব্যবসায় কোনো পূর্বঅভিজ্ঞতা, কোনো জামানত ছাড়াই একজন উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র ৯৭০ কোটি টাকা ঋণ পেয়েছে এবং এ ধরনের ঋণ ৫-৭ জন ব্যক্তিকে দেওয়া হয়েছে…
“কেবল একটি ব্যাংক থেকে দুই সপ্তাহের মধ্যে ৮ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে, অবশ্যই মানুষ আতঙ্কিত হবে। সুতরাং আপনি জনগণকে দোষ দিতে পারবেন না, তারা সেইফ হ্যাভেনের দিকে যাত্রা করবেই।”
তবে সব ব্যাংক এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি জানিয়ে আহসান মনসুর বলেন, “ব্র্যাক ব্যাংকে আমাদের আমানতে ৩০ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে, কেন? কারণ, মানুষের আস্থা আছে। সুতরাং তারা অন্য ব্যাংক থেকে নিয়ে এক ব্যাংকে বেশি টাকা রাখছে। এর মূল কারণ হচ্ছে সুশাসনের মান।
“সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব হচ্ছে, আইন ও নীতিমালার প্রয়োগ করা হবে। সেসব ব্যাংক, ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা ও বোর্ড– যারা এমন ব্যক্তিকে ৯০০ কোটি টাকা ঋণ দেয়, যারা সাত লাখ টাকা ঋণ পাওয়ারও যোগ্য নয়। কিন্তু জবাবদিহিতাটা কোথায়? এটাই মানুষকে দুশ্চিন্তায় ফেলছে।”
ব্যাংক খাত গত ১৫-২০ বছর ধরে সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে মন্তব্য করে অর্থনীতির এ গবেষক বলেন, “আমরা সরকারকে বলে আসছি এসব বিষয় দেখার জন্য, ব্যাংকিং কমিশন গঠন করার জন্য, পুরো আর্থিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের জন্য কৌশলপত্র প্রণয়নের জন্য, যাতে এটা বাংলাদেশের সাড়ে ৪০০ বিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে সামঞ্জস্য আনতে পারে।
“এটা বড় অর্থনীতি, কিন্তু আমাদের আর্থিক খাত, ব্যাংক, বন্ড প্রভৃতি নড়বড়ে অবস্থায়। এভাবে চলবে না, আমাদের আর্থিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতকে শক্তিশালী করতে হবে।”
‘যদি সন্তানের জন্য স্বস্তি না থাকে, অর্থ পাচার হতেই থাকবে’
বাংলাদেশ থেকে অর্থপাচার নিয়ে ক্রমাগত যে আলোচনা চলছে, তা নিয়েও কথা বলেন আহসান মনসুর। তার দৃষ্টিতে, এর প্রথম কারণ হল দুর্নীতি।
“যদি দুর্নীতি বা চাঁদাবাজি বা লাইসেন্স ছাড়া ব্যবসার মাধ্যমে যদি অর্থ জড়ো করে, তাহলে সেই টাকা এই দেশে থাকবে না।…. এই টাকা চলে যাবে, সে যা কিছু হোক না কেন। এ কারণে আমাদেরকে দুর্নীতির গোড়ার কারণ অনুসন্ধান করতে হবে।”
তিনি বলেন, “দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে, বাংলাদেশ কি পরবর্তী প্রজন্মের জন্য বসবাসের উপযোগী? সন্তানরা দেশে ফিরে আসবে এবং কাজ করবে- বাবা-মা কি এমন নিশ্চয়তা পায়?
“যদি তারা নিশ্চয়তা পায়, তাহলে টাকাটা এখানে রাখবে। যদি তারা স্বস্তি না পায়, তাহলে তাদের সন্তানরা বাইরেই কাজ করবে, সেখানে বসত গড়বে এবং টাকাটাও তাদেরকে অনুসরণ করবে।”
পাকিস্তানের পরিস্থিতি থেকে ‘শিক্ষা জরুরি’
শ্রীলঙ্কার খেলাপি হয়ে যাওয়া এবং পাকিস্তানেরও একই ঝুঁকিতে পড়ার মত পরিস্থিতি এড়াতে বাংলাদেশর করণীয় কী, সেই প্রশ্ন ছিল আহসান মনসুরের কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, “শ্রীলঙ্কার এই অবস্থায় আসার পেছনে আছে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি। বাংলাদেশে কি এসব সমস্যা নেই? আমাদেরও আছে এই গুরুতর সমস্যা।
“পাকিস্তানে গত বছর বিনিময় হার ছিল ১ ডলারে ১১৫ রুপি। মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ শতাংশ। এ বছর কোথায়? ডলারের বিপরীতে রুপি ২৭০ টাকা, মূল্যস্ফীতি ৩১ শতাংশ। বাংলাদেশ কোথায় ছিল? গতবছর ছিল ৬ শতাংশ, এখন ১০ শতাংশ বা কাছাকাছি। আমাদের টাকা ছিল ৮২, এখন ১০৫।
“আমাদের রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন, এখন কমে হয়েছে ৩১ বিলিয়ন, সরকারি হিসাবে। আইএমএফের হিসাবে এটা ২৩ বিলিয়ন ডলার। … যে পথে পাকিস্তান এগিয়েছে, আমরা কেবল এক বছর পেছনে। সুতরাং আমাদেরকে সতর্ক হতে হবে।”
এই গবেষক বলেন, “আমি বলছি না, আমরা পাকিস্তান হয়ে যাব। তবে আমি বলছি যে, আমাদেরকে নীতি প্রণয়নে সতর্ক হতে হবে, সাবধানী হতে হবে, রক্ষণশীল হতে হবে এবং হতে দূরদর্শী, যাতে আমাদেরও একই ধরনের ফলাফল না আসে।“
কৃষি উৎপাদনের কারণে বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা দেখছেন না আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, “দুর্ভিক্ষ, খাদ্য সংকট প্রভৃতির কথা প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যরা বলেছেন। আমি মনে করি এটা অতীতের ব্যাপার, যদি আমরা সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করতে পারি।”
এ প্রসঙ্গে চাহিদার ৯৫ শতাংশ ধান এবং মাংস, মাছ, শাক-সবজি ও ফলের বেশিরভাগ দেশে উৎপাদনের উদাহরণ দেন তিনি।
তবে দামের ক্ষেত্রে ‘সমস্যা রয়ে গেছে’ মন্তব্য করে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক বলেন, “আমি মনে করি কম দামে টিসিবির মাধ্যমে চাল বিক্রি করে এবং এক কোটি মানুষকে খাদ্যপণ্য দিয়ে সরকার এটাকে মোকাবেলা করতে পারবে; এটা সঠিক পথ। তাদেরকে কেবল নিশ্চিত করতে হবে, এই এক কোটি লোক বাস্তবিক অর্থে পাওয়ার যোগ্য কি-না।
“আমনে বাম্পার ফলন হয়েছে। বোরো উৎপাদন আবারও বাম্পার হবে। আশা করি, হাওর এলাকায় বড় রকমের কোনো ক্ষতি হবে না, যেখানে আগাম বন্যার উদ্বেগ রয়েছে। এটার ব্যবস্থাপনা যদি করা যায়, আমরা বাম্পার ফলন পাব। কৃষকরা যদি ঠিক দাম পায়, তাহলে তারা উৎপাদন করবে এবং আমাদের খাওয়াবে।”
মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে
সরকার নিম্নবিত্তের জন্য প্রণোদনার ব্যবস্থা করলেও নিম্ন মধ্যবিত্তের জন্য তেমন কোনো ব্যবস্থাপনা না থাকার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে আহসান মনসুর বলেন, “আমি মনে করি, সরকারের জন্য সবচেয়ে বড় কাজ হবে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা বজায় রাখা, মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনা, সবার জন্য জীবিকার খরচ কমানো। এখন বেতন বাড়িয়ে দিলে লাভ হবে না, কারণ, এটা মূল্যস্ফীতি আরও বাড়িয়ে দিতে পারে।
“সুতরাং ছয় মাস মধ্যবিত্ত ভুগবে। দামের স্থিতিশীলতা এনে মূল্যস্ফীতি স্থায়ীভাবে কমিয়ে আনুন। তখন যদি বেতন বাড়ে ১০ শতাংশের মত, তাহলে তারা এটার সঙ্গে মানিয়ে নেবে।”
মূল্যস্ফীতি কীভাবে কমবে? আহসান মনসুর বলেন, “প্রথমে ডলারের অভাব অবশ্যই মেটাতে হবে। ডলারের বিনিময় হার অবশ্যই স্থিতিশীল করতে হবে।
“আমাদেরকে মুদ্রানীতিও ব্যবহার করতে হবে, কিন্তু আমরা এটা সুনির্দিষ্ট এক জায়গায় রেখে দিয়েছি। যখন পুরো পৃথিবীর সবখানে, যুক্তরাষ্ট্রসহ প্রভৃতি জায়গায় সুদের হার ৪-৫ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে, আপনি কী করছেন? আমরা বাতাসের বিপরীতে যাচ্ছি, এটা বিজয়ের কৌশল নয়, বাতাসের সঙ্গে যাওয়া হচ্ছে বিজয়ের কৌশল।”
দেশের নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে থাকলে কী করতেন?
এই পশ্নে পাঁচটি পদক্ষেপের কথা তুলে ধরেন আহসান মনসুর।
>> কর-জিডিপি অনুপাত বাড়ানোর জন্য কর প্রশাসন, কর নীতি ও কর আদায়ের ক্ষেত্রে মৌলিক সংস্কার;
>> আর্থিক খাত, বিশেষ করে ব্যাংকিং খাতের সমস্যায় বিশেষ মনোযোগ;
>> এই মুহূর্তে প্রবৃদ্ধি নয়, মনোযোগ হবে সামষ্টিক অর্থনীতির স্থিতিশীলতা আনা। যার জন্য শুরুতে ডলারের বাজারে স্থিতিশীলতা আনা। দৃষ্টি দিতে হবে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে সাধারণ মানুষকে স্বস্তি দিতে;
>> সত্যিকার অর্থে চতুর্থ শিল্পবিল্পবের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার মত করে শিক্ষার মান উন্নয়ন’
এবং
>> জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে বেশি মনোযোগ দিতে, যাতে দেশ বসবাসযোগ্য থাকে।
I applaud Dr. Mansur for his very straight forward answers/prescription to the problems presented by the host. Confidence in banking is required through implementation of regulatory controls without fear or favor. Otherwise, capital outflows will continue weakening the confidence in the sector and as a result the economy. Implementation of fair taxation and collection of tax revenue will ensure development and economic stability.
— An additional point that Dr. Mansur and other professional bank management should press for, is the adoption and implementation of deposit insurance program (premium paid by the banks on deposits to an independent quasi-government institution) as in the US and other developed countries. With assurance of the safety of their deposits, consumers will have confidence to keep their small-to-medium savings in banks instead of withdrawing funds. This will greatly enhance liquidity, lending, consumption, and developmental activities. With implementation of such self-financed business oriented policies, non-compliant and non-deposit insurance qualifying banks will face demise due to loss of deposits.