আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণ কর্মসূচির শর্তের ছকে আগামী ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটের অঙ্ক কষছে সরকার। ঋণের শর্তে আইএমএফ যা যা করতে বলেছে, অর্থমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর বাজেট বক্তব্যে সেগুলোর বেশির ভাগ বাস্তবায়নের ঘোষণা থাকবে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
সরকার আগে নিজের মতো করেই বাজেট প্রণয়ন করত। তবে গত বছরের ৩০ জানুয়ারি আইএমএফ ঋণ অনুমোদনের পর চলতি বাজেটে সংস্থাটির শর্তের প্রতিফলন দেখা যায়। আগামী বাজেটে তা আরও স্পষ্ট হচ্ছে। আগামী ৬ জুন সংসদে ‘সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে অঙ্গীকার’ শীর্ষক নতুন বাজেট উপস্থাপন হবে। তাতে আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের ঘোষণা থাকবে। ঘোষিত মুদ্রানীতিতেও আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেখা গেছে।
আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির অন্যতম শর্ত হলো, আগামী অর্থবছরে কর-জিডিপির অনুপাত শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বাড়াতে হবে। রাজস্ব বাড়ানোর ক্ষেত্রে করের আওতা সম্প্রসারণ, কর প্রশাসনের সংস্কার ও আদায় প্রক্রিয়া স্বয়ংক্রিয়করণের পাশাপাশি কর অব্যাহতি ও শুল্ক-কর ছাড় আগামী তিন অর্থবছরের মধ্যে শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। এনবিআর এই প্রথম আগামী বাজেটে কর অব্যাহতি ও শুল্ক-কর ছাড় কমিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর কৌশল গ্রহণ করেছে।
এর অংশ হিসেবে শূন্য শুল্কের অর্ধশতাধিক পণ্যে আগামী অর্থবছর থেকে ১ শতাংশ হারে আমদানি শুল্ক আরোপ হতে পারে। বর্তমানে বেশ কিছু পণ্য আমদানিতে শুল্ক নেই। এ ধরনের পণ্যের সংখ্যা ৩২৯। এ তালিকায় আছে খাদ্যপণ্য, সার, গ্যাস, ওষুধশিল্পের কাঁচামাল, কৃষি উপকরণ ইত্যাদি। আগামী বাজেটে ওই তালিকার ১৫-২০ শতাংশ পণ্য আমদানিতে ন্যূনতম ১ শতাংশ হারে শুল্ক আরোপ হতে পারে। যেসব পণ্যে ১ শতাংশ আমদানি শুল্ক বসানোর চিন্তা করা হচ্ছে, তার প্রাথমিক তালিকায় আছে গম, ভুট্টা, সরিষাবীজ, তুলাবীজ, বিভিন্ন শাকসবজির বীজ, কয়লা, জিপসাম, ভিটামিন, পেনিসিলিন, ইনসুলিন, বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক, প্লাস্টিক কয়েল, পেপার বোর্ড, স্টিলজাতীয় পণ্য, শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি-যন্ত্রাংশ ইত্যাদি।
এদিকে কিছু শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে রেফারেল বা বিশেষায়িত হাসপাতাল শুল্কছাড় সুবিধায় ১ শতাংশ শুল্কে মেডিকেল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির সুযোগ পাচ্ছে। আগামী বাজেটে ২০০টিরও বেশি মেডিকেল যন্ত্র ও সরঞ্জাম আমদানির ক্ষেত্রে তা বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। একই সঙ্গে বর্তমানে কর অব্যাহতি অথবা করছাড় সুবিধা পাওয়া স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত কিছু ইলেকট্রনিকস পণ্যের ওপর মূল্য সংযোজন কর (মূসক বা ভ্যাট) বাড়ানো হতে পারে। তরল পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাস সিলিন্ডারের মতো পণ্যেও বাড়তে পারে ভ্যাট। তবে তথ্য ও প্রযুক্তি খাতে কর অব্যাহতি না বাড়াতে আইএমএফের পরামর্শ থাকলেও এ খাতে আরও কয়েক বছর কর অব্যাহতি থাকতে পারে।
নতুন ভ্যাট আইনে একটি স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাট হার (১৫ শতাংশ) ছিল। তবে নানা কারণে সেটি ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। এ জন্য একাধিক হারে ভ্যাট আদায় হচ্ছে। আগামী বাজেটে এ হার যৌক্তিক করা হবে। এ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় পণ্যে ভ্যাট হার বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে এনবিআরের। ২০২৬ সাল নাগাদ পর্যায়ক্রমে সব পণ্য ও সেবার ওপর স্ট্যান্ডার্ড ভ্যাট হার আরোপ হবে।
রাজস্ব বাড়ানোর অন্যান্য কৌশল
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি সত্ত্বেও বাড়তি আয়কর আদায়ের লক্ষ্যে নতুন বাজেটে করমুক্ত আয়ের সীমা বাড়ছে না। এ ছাড়া পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে ৪০ লাখ টাকার বেশি মুনাফার ওপর ‘ক্যাপিটাল গেইন’ কর আরোপের সিদ্ধান্ত আসতে পারে। এ হার হতে পারে ১৫ শতাংশ। বিত্তশালীদের কাছ থেকেও বাড়তি কর আদায়ের পদক্ষেপ থাকছে বাজেটে। ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের সর্বোচ্চ করহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হচ্ছে। কমিউনিটি সেন্টার ভাড়া নিতে গেলেও রিটার্ন জমার সনদ প্রদান বাধ্যতামূলক হতে পারে।
আসন্ন বাজেটে সিগারেটের সম্পূরক শুল্ক ও মোবাইল ফোনে কথা বলা বা ইন্টারনেটের ওপর সম্পূরক শুল্ক বাড়ানোর ঘোষণা আসতে পারে। এসব ক্ষেত্রে আরও ৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক যোগ হতে পারে। বর্তমানে অ্যামিউজমেন্ট পার্ক ও থিম পার্কে প্রবেশে এবং রাইডে চড়তে সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট দিতে হয়। এটি বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করার পরিকল্পনা রয়েছে। কোমল পানীয়, কার্বোনেটেড বেভারেজ, এনার্জি ড্রিংকস, ফলের জুস, আমসত্ত্বের ওপর ভ্যাট ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হতে পারে। এ ছাড়া কার্বোনেটেড বেভারেজের ওপর ন্যূনতম কর আরও ২ শতাংশ বাড়িয়ে ৫ শতাংশ হতে পারে।
আইএমএফের আরও একটি বড় শর্ত হচ্ছে, সঠিক বাজেট ব্যবস্থাপনার স্বার্থে বিশেষ করে জ্বালানি ও বিদ্যুতে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে হবে। ভর্তুকি কমানোর ওই টাকায় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি সম্প্রসারণের পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। সরকার ভর্তুকি তুলে নিতে ইতোমধ্যে জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় করছে। পাশাপাশি আগামী অর্থবছরও চারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকার বর্তমানে বিদ্যুতে মাসে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দিচ্ছে। নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হলে আগামী অর্থবছরের শেষের দিকে এই ভর্তুকি মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকায় নেমে আসবে। একইভাবে আগামী তিন অর্থবছরের মধ্যে এ খাতে ভর্তুকি শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার মতো সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
তারপরও আগামী অর্থবছরের বাজেটে ভর্তুকি ও প্রণোদনায় বরাদ্দ প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ২০ হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা রাখা হতে পারে। এর মধ্যে শুধু বিদ্যুৎ খাতের জন্যই বরাদ্দ থাকছে ৪০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫ হাজার কোটি টাকা বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, পরিকল্পনা অনুযায়ী নতুন অর্থবছরে বিদ্যুতে এই টাকা প্রয়োজন হবে না, তবে চলতি অর্থবছরের বকেয়া পরিশোধে বাড়তি ভর্তুকি রাখা হচ্ছে। এ ছাড়া রপ্তানিতে প্রণোদনা কমানোর লক্ষ্যে আইএমএফের পরামর্শ ও অর্থ বিভাগের সিদ্ধান্ত শেষে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। নতুন বাজেটে প্রণোদনা আরও কমতে পারে।
আইএমএফের পরামর্শে ও বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আগামী বাজেট অনেকটা সংকোচনমূলক হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাজেট ঘাটতি কমিয়ে আনা এবং সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ ঋণাত্মক পর্যায়ে নামিয়ে আনার উদ্যোগ থাকবে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ৭ লাখ ৯৬ হাজার ৯০০ কোটি টাকা ব্যয়ের ফর্দ সাজিয়ে বাজেট চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এটি চলতি বাজেটের তুলনায় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ বেশি। এর আগের অর্থবছরগুলোতে সাধারণত পূর্ববর্তী বছরের তুলনায় ১২ থেকে ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ধরে বাজেট দেওয়া হয়েছে।
নতুন অর্থবছরে ৫ লাখ ৪১ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সরকার। এর মধ্যে এনবিআরকে আদায় করতে হবে ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের চেয়ে ৫০ হাজার কোটি টাকা বেশি।
ঘাটতি মেটাতে পৌনে ৩ লাখ কোটি টাকা দেশি-বিদেশি উৎস থেকে ঋণ গ্রহণের পরিকল্পনা রয়েছে আগামী বাজেটে। তবে এবারই সঞ্চয়পত্রের পুরোনো বিনিয়োগ ম্যাচিউরড হওয়ায় সরকার যে পরিমাণ ঋণ ফেরত দেবে, তার চেয়ে ৫০ কোটি টাকার কম সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিকল্পনা করছে সরকার। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরের বাজেটে সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ নেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা মাইনাস (ঋণাত্মক) ৫০ কোটি টাকা প্রাক্কলন করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলেছেন
সাবেক অর্থ সচিব ও কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল (সিএজি) মোহাম্মদ মুসলিম চৌধুরী সমকালকে বলেন, ‘আইএমএফ মোটা দাগে যেসব শর্ত দিয়েছে, তা সার্বিকভাবে অর্থনীতির জন্য ভালো। এসব সংস্কারের উদ্যোগ নিজেদের তাগিদে অনেক আগে থেকেই ক্রমান্বয়ে নেওয়া উচিত ছিল। কিন্তু অর্থনীতি যখন সংকটের মধ্যে তখন সব উদ্যোগ একসঙ্গে বাস্তবায়ন করতে গিয়ে হিতে বিপরীত হতে পারে। ঊর্ধ্ব মূল্যস্ফীতি পরিস্থিতিতে কোনো পণ্যে শুল্ক বাড়ানো হলে তার প্রভাবে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় চাপ তৈরি করবে।’ আইএমএফের শর্ত বাস্তবায়নে শিথিল হওয়ার সুযোগ রয়েছে কিনা– এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী এ সুযোগ কম। তাই আইএমএফের ঋণ কর্মসূচিতে যাওয়ার আগেই এ বিষয়ে আরও পর্যালোচনার দরকার ছিল।’
সম্প্রতি রাজধানীর এফডিসিতে এক অনুষ্ঠানে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে আইএমএফ খুব বেশি জানে, এটি বিশ্বাস করার কারণ নেই। তা ছাড়া আইএমএফ সব দেশে গিয়ে একই ফর্মুলা দেয়। কিন্তু সব দেশের জন্য এক নীতি প্রযোজ্য নয়। তাই আইএমএফের পরামর্শ দেশ ও জনগণের স্বার্থ বিবেচনা করে গ্রহণ করতে হবে।’
ভোক্তাদের সংগঠন ‘কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’ (ক্যাব)-এর সহ-সভাপতি এস এম নাজের হোসেন সমকালকে বলেন, ‘ধনী-গরিব সবার ওপর একই প্রভাব ফেলবে– এমন পরোক্ষ কর বাড়ানো জনগণের প্রতি অবিচার; যা একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য গ্রহণযোগ্য নয়। আমরা মনে করি, সক্ষমতা ভিত্তির কর হওয়া উচিত। তাই এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আরও বেশি সতর্ক হওয়া উচিত। শুধু আইএমএফের ঋণের শর্ত বাস্তবায়নের জন্য এসব উদ্যোগ নেওয়া হলে মানুষের মধ্যে অসন্তোষ বাড়বে।’
samakal