Manabzamin
এম এম মাসুদ
২৮ আগস্ট ২০২৩
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি আগামী নভেম্বর মাসে পাওয়া যাবে বলে আশা করছে সরকার। তবে দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ের আগে শর্তের অগ্রগতি মূল্যায়ন করছে আইএমএফ স্টাফ মিশন। এর আগে গত ফেব্রুয়ারিতে ঋণের প্রথম কিস্তি হিসেবে ৪৭ কোটি ৬২ লাখ ডলার পায় বাংলাদেশ। এদিকে ধারাবাহিক কমতে থাকা রিজার্ভ এখন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) নির্ধারিত মানদণ্ডের নিচে নেমে গেছে। এতে সংস্থাটি থেকে নেয়া ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি নিয়ে শঙ্কাও আছে।
তবে বাংলাদেশ ব্যাাংক মনে করে, ঋণের দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ যথাসময়ে পাওয়া যাবে বলে আইএমএফ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কারণ ঋণ পেতে এখন শর্তগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সব শর্তই নির্দিষ্ট সময়ে বাস্তবায়ন করার কথা তাদেরকে বলা হয়েছে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের প্রতিনিধিদল আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছে। বৈঠকে আইএমএফের প্রতিনিধিদল ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি যথাসময়ে ছাড়ের বিষয়ে নিশ্চয়তা দিয়েছে। আগামী ২০২৬ সাল পর্যন্ত সাড়ে ৩ বছরে ৭টি কিস্তিতে ঋণের পুরো অর্থ ছাড় করা হবে। সেই হিসেবে বাংলাদেশের জন্য আইএমএফের এই ঋণের আরও ৬ কিস্তি বাকি রয়েছে।
জানা গেছে, দ্বিতীয় কিস্তির অর্থ পাওয়ার বিষয়ে শর্তের বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করতে আইএমএফের একটি টিম অক্টোবরে বাংলাদেশে আসবে। তারা ফিরে গিয়ে প্রতিবেদন দিলেই দ্বিতীয় কিস্তি ছাড় হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আইএমএফের ঋণের কিস্তি ছাড় পাওয়ার শর্ত হিসেবে রিজার্ভ ২৪ বিলিয়ন ডলারের উপরে থাকতে হবে। কিন্তু রিজার্ভ নির্ধারিত সীমার নিচে থাকায় দ্বিতীয় কিস্তি ছাড়ে সমস্যা হতে পারে। একই ধরনের মতামত দিচ্ছেন অর্থনীতিবিদরা। তারা বলছেন, শুধু রিজার্ভ নয়; আইএমএফের দেয়া অনেক শর্তই মানতে বেগ পেতে হচ্ছে। এক্ষেত্রে অধিকাংশ শর্ত অপূর্ণ থেকে গেলে ঋণের কিস্তি আটকে যেতে পারে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) স্টাফ ভিজিট চলমান রয়েছে। আর সংস্থাটির ঋণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে তাই ঋণের ব্যবহার এবং এর অগ্রগতি নিয়েও আলোচনা করা হচ্ছে। তাদের মতে, আইএমএফের ৩৮টি শর্তের বেশির ভাগ পূরণ হয়েছে। কিছু শর্ত বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জ থাকলেও তা মোকাবিলায় যথেষ্ট উদ্যোগ রয়েছে সরকারের। এ কারণে আশা করা হচ্ছে, নভেম্বরে আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তি পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ইতিমধ্যে সংস্থাটির পক্ষ থেকে ইতিবাচক আভাস দেয়া হয়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, ঋণ প্রদানে সংস্থাটির শর্ত পরিপালনে সরকার আন্তরিক। এ কারণে বেশির ভাগ শর্ত পূরণ হয়েছে। যেসব শর্ত পূরণে চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো নিয়ে আমরা তাদের সঙ্গে বিশদ আলোচনা ও করণীয় নির্ধারণ করবো। এ কারণে নভেম্বরে ঋণের দ্বিতীয় কিস্তি বেশ ভালোভাবেই পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, সাম্প্রতিক পাস হওয়া বেশ কিছু বিদেশি ঋণের কিস্তি শিগগিরই চলে আসবে। এতে রিজার্ভ বৃদ্ধি পেয়ে সন্তোষজনক অবস্থানে পৌঁছবে। তবে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের প্রধান খাত রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের নিম্নমুখী প্রবণতার পাশাপাশি প্রয়োজন মেটাতে নিয়মিত ডলার বিক্রি করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে রিজার্ভ ধরে রাখা কঠিন হবে বলে মত অর্থনীতিবিদদের।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক বলেন, আইএমএফ প্রতিনিধিদল তাদের শিডিউল সফরের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সফর করছে। আমরা আমাদের নেয়া সব বিষয় তাদের সামনে তুলে ধরেছি। তারা আমাদের নেয়া পদক্ষেপের বিষয়ে দ্বিমত করেনি। আইএমএফ মিশন দল আগামী অক্টোবরে আবারো বাংলাদেশ সফরে আসবে, তখন এ বিষয়ে জানা যেতে পারে। কারণ সেটিই হবে মূল মিটিং।
বাংলাদেশকে দেয়া আইএমএফের ঋণের অর্থ ব্যবহারের অগ্রগতি সংক্রান্ত যে আলোচনা হওয়ার বিষয় রয়েছে, তার মধ্যে ডলারের বিনিময় হার একটিতে নিয়ে আসা, ঋণ সুদহার বাজারমুখী করা ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গণনার পদ্ধতি ঠিক করা। ইতিমধ্যেই এগুলো করা হয়েছে। রিজার্ভ বাড়াতে রেমিট্যান্স ও বৈদেশিক ঋণ বাড়ানোর উদ্যোগও নেয়া হয়েছে।
এ ছাড়া বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে ভর্তুকি কমানো, আর্থিক খাত সংস্কারে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন, মূল্যস্ফীতির লাগাম টানতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানো, ভ্যাট ও ট্যাক্স আদায় বাড়াতে এনবিআরের কার্যক্রমকে অটোমেশন করাসহ মোটা দাগে বেশকিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত বুধবার পর্যন্ত আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৩.১৬ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৩১৬ কোটি ডলার। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাব মতে, রিজার্ভ রয়েছে ২৯.৩২ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৯৩২ কোটি ডলার। গত জুন পর্যন্ত তা ২৪.৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্তু এটা করা সম্ভব হয়নি।
জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ঋণের অর্থ পেতে ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক বাজারদরের সঙ্গে সমন্বয় করে সারের দাম, জ্বালানি তেলের মূল্য বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু আইএমএফের দেয়া শর্ত অনুযায়ী, পিছিয়ে আছে রাজস্ব আহরণ ও নিট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড়ার ক্ষেত্রে। তাদের দেয়া শর্ত অনুযায়ী, ডলারের একক রেট নির্ধারণ করতে হবে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে মুদ্রানীতির ভূমিকা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, জ্বালানিতে ভর্তুকি কমানো, ব্যাংক ঋণের সুদহারের সীমা তুলে দেয়া, ঋণের যথাযথ ব্যবহার, খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমানো, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে কার্যকরী পরিবর্তন এবং এসব প্রতিষ্ঠানের পর্ষদের ক্ষমতার অপব্যবহার রোধ করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। রিজার্ভ ছাড়াও ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে ঋণের শর্ত হিসেবে আর্থিক, রাজস্ব ও প্রশাসনিক খাতের সংস্কারের ঘোষণা কতোটা থাকছে, সেটিও জানতে চাওয়া হয়েছে।
সংস্কারের লক্ষ্যে চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরু থেকে ব্যাংকের ঋণে বেঁধে দেয়া ৯ শতাংশ সুদহার তুলে দিয়ে ইন্টারেস্ট রেট করিডোরের মাধ্যমে স্মার্ট সুদের হার নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, এখন পর্যন্ত যে পরিমাণ নিট বৈদেশিক রিজার্ভ থাকার কথা, বাংলাদেশ ব্যাংক তা করে দেখাতে পারেনি এবং জিডিপি’র অনুপাতে ০.৫ শতাংশ রাজস্ব আদায় বাড়ানোর উপযুক্ত কর্মপরিকল্পনা এনবিআর আইএমএফের সামনে তুলে ধরতে পারেনি। ফলে রিভিউয়ে খুব সহজেই বাংলাদেশ পার পাবে এমন সহজ নয়। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা পূরণ নিয়েও আইএমএফের মিশন অখুশি বলে মনে হচ্ছে। এসব সমাধানে বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতি বদলাতে হবে।
এদিকে দ্বিতীয় কিস্তি আগামী নভেম্বরে দেয়া হবে। ঋণের তৃতীয় ও চতুর্থ কিস্তি ছাড়ের আগে সেপ্টেম্বর ও ২০২৪ সালের এপ্রিল-মে মাসে আরও দুটি রিভিউ করবে আইএমএফ। এ ছাড়া সফরকালে এবার আইএমএফের প্রতিনিধিদলটি অর্থনীতিতে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রভাব পর্যালোচনা করবে এবং সরকারের চাহিদা ব্যবস্থাপনার পদক্ষেপের ফলে জ্বালানি আমদানি কতোটা কমেছে, তা-ও পর্যালোচনা করবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, সব শর্ত পূরণ না হলে যে ঋণের পরবর্তী কিস্তি পাওয়া যাবে না তা নয়। দেখতে হবে, আমরা ঋণ কর্মসূচির সঠিক পথে রয়েছি কিনা। আমরা এখনো সঠিক পথেই আছি। আগে-পরে আইএমএফ ঋণ কর্মসূচির সব মানদণ্ডেই পৌঁছাতে পারবো।