অস্থির সময়ে চ্যালেঞ্জের বাজেট

নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ‘তিন শূন্যের পৃথিবী’ তত্ত্বকে গুরুত্ব দিয়ে ২০২৫-২০২৬ অর্থবছরের বাজেট পেশ করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। গতকাল সোমবার দুপুরে সম্প্রচার মাধ্যমে এ বাজেট পেশ করা হয়।
নতুন বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা কম। বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা। নতুন বাজেটে প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৫ দশমিক ৫ ভাগ, মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ ভাগ। পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি এপ্রিল ২০২৫-এ কমে ৯.১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। চলতি জুনের মধ্যেই তা ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়েছে বাজেটে।
প্রস্তাবিত বাজেটের আয়ের উৎস হিসেবে রাজস্ব খাত থেকে প্রত্যাশা ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। বাকি অর্থের উৎস হিসেবে বিদেশি অনুদান থেকে ৫ হাজার কোটি টাকা, বৈদেশিক ঋণ ৯৬ হাজার কোটি টাকা, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে ঋণ ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ধরা হয়েছে।
বাজেটে সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে জনপ্রশাসন খাতে, যা মোট বাজেটের ২৩ দশমিক ৫ ভাগ। ঋণের সুদ পরিশোধে খরচ হবে ১৫ দশমিক চার ভাগ, শিক্ষা ও প্রযুক্তিতে ১৪ ভাগ, কৃষিতে ৫ দশমিক ৯ ভাগ, সামাজিক নিরাপত্তা ও কল্যাণে ৫ দশমিক ৭, স্থানীয় সরকার ও পল্লী উন্নয়নে ৫ দশমিক ৭ ভাগ, স্বাস্থ্যে ৫ দশমিক ৩ ভাগ, প্রতিরক্ষায় ৫ দশমিক ২, জনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তায় ৪ দশমিক ৩, পরিবহন ও যোগাযোগ খাতে ৯ শতাংশ, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে ২ দশমিক ৯, গৃহায়নে শূন্য দশমিক ৭ ভাগ, বিনোদন, সংস্কৃতি ও ধর্ম খাতে শূন্য দশমিক ৮, শিল্প ও অর্থনৈতিক সার্ভিসে শূন্য দশমিক ৫ এবং বিবিধ খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে মোট খরচের ১ দশমিক ১ ভাগ।
অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেছেন, সরকার ৩ শূন্যের ওপর ভিত্তি করে সমাজ গঠনের জন্য কাজ করছে। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো— শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য কার্বন নীতির ওপর ভিত্তি করে এমন একটি সমাজ গড়ে তোলা যেখানে প্রত্যেকেরই একটি সুন্দর জীবন থাকবে এবং বৈষম্যের দুষ্টচক্র থেকে তারা মুক্ত থাকবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ফ্যাসিস্ট হাসিনার পলায়নের পর দায়িত্ব পাওয়া ড. ইউনূস সরকারের বাজেট অস্থির সময়ে একটি চ্যালেঞ্জের বাজেট। সরকারের কয়েক মাস কেটেছে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অস্থিরতায়। বিভিন্ন ইস্যুতে দূরত্ব বেড়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। মসৃণ অর্থনীতির জন্য সহযোগিতার যে প্রত্যাশা সরকারের ছিল, সেটি পায়নি ইউনূস সরকার। সামনে এই চ্যালেঞ্জ আরো বড় হয়ে দেখা দেবে, এই শঙ্কা সবার।
বিগত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে হাসিনার আমলে আর্থিক খাত প্রায় ধসে পড়েছিল বলে বাজেট বক্তব্যে তুলে ধরেছেন অর্থ উপদেষ্টা। ফ্রি স্টাইলে লুটপাট ও অর্থ পাচার করার লক্ষ্যে হাসিনা সরকার দেশীয় উৎস ও বিদেশ থেকে বিপুল ঋণ করেছিল। সেই ঋণের ভার এখন এই সরকারের ঘাড়ে। নতুন বাজেটে এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি সফলতা পায়নি। সামনের বছরেও গতি খুব একটা ফিরবে বলে মনে করছেন না অর্থনীতিবিদরা। রাজস্ব আদায়েও সফলতা নেই। মূল্যস্ফীতি এই সরকারের জন্য কিছুটা স্বস্তি এনেছে বাজার সিন্ডিকেট ভেঙে ফেলার কারণে। অর্থনীতিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছেন রেমিট্যান্স যোদ্ধারা। সামনে তাদের সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে সংকট কাটানোর একটি রাস্তা খোলা থাকবে। তবে বিনিয়োগের হাল নাজুক। ফলে চ্যালেঞ্জ নিয়ে আগামী পহেলা জুলাই যাত্রা শুরু হবে নতুন অর্থবছরের।
চ্যালেঞ্জ হলেও, এবারের বাজেট বক্তৃতা শুধু আর্থিক পরিকল্পনা নয়— এটি এক অর্থনৈতিক রূপান্তরের দিকনির্দেশনা। ‘বৈষম্যহীন ও টেকসই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ার প্রত্যয়’ নিয়ে ঘোষিত এই বাজেটে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনা—দুর্নীতি ও বৈষম্যমুক্ত একটি উন্নত সমাজ গঠনের প্রতিশ্রুতি স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে।
অর্থ উপদেষ্টা তার বাজেট বক্তৃতার শুরুতেই স্মরণ করেন মহান মুক্তিযুদ্ধের শহীদ ও ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট বিপ্লবের আত্মোৎসর্গকারীদের। তাদের আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ড. সালেহউদ্দিন বলেন, ‘তাদের স্বপ্ন পূরণে অন্তর্বর্তী সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ তিনি বলেন, গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের পর দায়িত্ব গ্রহণ করে অন্তর্বর্তী সরকার একটি বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের কাজে হাত দেয়। মাত্র দশ মাসের ব্যবধানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, আইনশৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, শিল্পোৎপাদন স্বাভাবিকীকরণ এবং ব্যাংকিং খাতে স্থিতিশীলতা আনার ক্ষেত্রে সরকারের অর্জন উল্লেখযোগ্য।
বাজেট বক্তৃতায় জানানো হয়, সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেওয়ার ফলে নীতি সুদের হার বেড়ে ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। একই সঙ্গে ব্যয় সংকোচন নীতির ফলে সরকার ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়েছে। যার সুফলে ডিসেম্বর ২০২৪-এর ১০.৮৯ শতাংশ পয়েন্ট-টু-পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি এপ্রিল ২০২৫-এ কমে ৯.১৭ শতাংশে নেমে এসেছে। জুনের মধ্যে তা ৮ শতাংশে নামিয়ে আনার প্রত্যাশা ব্যক্ত করা হয়।
বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ২৭.৪ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়ায় বাজারভিত্তিক মুদ্রাবিনিময় হার চালু করা হয়েছে বলে জানান অর্থউপদেষ্টা। খাদ্যশস্যে ঘাটতি মোকাবিলায় ৯ লাখ টন চাল ও ৭ লাখ টন গম আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কৃষি ভর্তুকি অব্যাহত রাখা হয়েছে। একই সঙ্গে বিদ্যুতের দাম আপাতত না বাড়ানোর ঘোষণা দিয়ে সরকার ১০ শতাংশ ব্যয় কমিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতকে দক্ষ করতে পদক্ষেপ নিয়েছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
খেলাপি ঋণের প্রকৃত চিত্র উন্মোচনে অ্যাসেট কোয়ালিটি রিভিউ চালু করা হয়েছে বলে জানান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, জুন ২০২৩-এ যেখানে খেলাপি ঋণ ছিল ১০.১১ শতাংশ, তা ডিসেম্বর ২০২৪-এ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২০.২০ শতাংশে। সরকার আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী লোন ক্লাসিফিকেশন ও প্রভিশনিং চালু করেছে।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নির্মূলে অন্তর্বর্তী সরকার ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, যেগুলোর সুপারিশ ইতোমধ্যে জমা পড়েছে। দুদক সংস্কার, ভূমি আইন ডিজিটালাইজেশন, অবাধ নির্বাচন, বিচার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার রূপান্তরে নানা পদক্ষেপ হাতে নেওয়া হয়েছে।
চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের রাজস্ব আহরণ ও ব্যয়ের ধীরগতির কারণে বাজেট সংশোধন করে রাজস্ব আয় ২৩ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৫ লাখ ১৮ হাজার কোটি টাকা এবং ব্যয় ৫৩ হাজার কোটি টাকা কমিয়ে ৭ লাখ ৪৪ হাজার কোটি টাকা করা হয়েছে। ফলে বাজেট ঘাটতি কমে দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৪.১ শতাংশ।
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের আকার ধরা হয়েছে ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা হলেও তা জিডিপির মাত্র ৩.৬ শতাংশ।
এবারের বাজেটে শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষায় ৩৫ হাজার ৪০৩ কোটি, মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষায় ৪৭ হাজার ৫৬৩ কোটি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষায় ১২ হাজার ৬৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে।
স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪১ হাজার ৯০৮ কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের তুলনায় কিছুটা বেশি। কর্মসংস্থান ও তরুণ উদ্যোক্তা তৈরিতে ১০০ কোটি টাকার বিশেষ তহবিল গঠনের প্রস্তাব এসেছে। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
সামাজিক নিরাপত্তায় বরাদ্দ বাড়িয়ে ১ লাখ ১৬ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা করা হয়েছে। বৃদ্ধ, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতাসহ বিভিন্ন ভাতার হার বৃদ্ধি পেয়েছে।
বিদ্যুৎ খাতে বিশেষ উদ্যোগ হিসেবে ২০১০ সালের বিশেষ আইন বাতিল করে স্বচ্ছতা বৃদ্ধির পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে ২০৪০ সালের মধ্যে ৩০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
সবশেষে, স্থানীয় সরকার, প্রযুক্তি, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, বৈদেশিক কর্মসংস্থানসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে উন্নয়নমূলক কার্যক্রমের পরিকল্পনাও বাজেটে তুলে ধরা হয়েছে।
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার সরলীকরণ, স্বচ্ছতা এবং করদাতাবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টির লক্ষ্যে একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর সংস্কার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাজেট বক্তৃতায় অর্থ উপদেষ্টা বলেন, এ বছর রাজস্ব ব্যবস্থাকে আরো গতিশীল ও সমতাভিত্তিক করতে বিদ্যমান কর কাঠামোর অসামঞ্জস্যতা দূর করার পাশাপাশি কর জাল সম্প্রসারণ ও করদাতাদের উৎসাহ প্রদানে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।
২০২৬-২৭ ও ২০২৭-২৮ করবর্ষে সম্পদ সারচার্জের বিদ্যমান হার অপরিবর্তিত থাকছে। তবে এবার ন্যূনতম করের ভিত্তিতে নয়, বরং নিয়মিত করযোগ্য আয়ের ওপর নির্ধারিত করহার অনুসরণ করে সম্পদ সারচার্জ নির্ধারণের বিধান করা হয়েছে। এতে করব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পাবে বলে সরকারের প্রত্যাশা।
কর পরিপালন উৎসাহিত করতে এবার বেশকিছু সুবিধা যুক্ত করা হয়েছে। ন্যূনতম কর প্রদানে করদাতার যে অতিরিক্ত অর্থ প্রদান করতে হয়, তা পরবর্তী করবর্ষে সমন্বয়ের সুযোগ রাখা হয়েছে। কৃষি উৎপাদনে উৎসাহ দিতে কৃষি আয় করমুক্ত সীমা বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে বেসরকারি চাকরিজীবীদের করযোগ্য আয় নির্ধারণে সর্বোচ্চ বাদযোগ্য অঙ্কও বাড়িয়ে পাঁচ লাখ টাকা করা হয়েছে। চাকরিরত কর্মচারীদের জন্য কিডনি, লিভার, হার্ট, ক্যানসার ও মস্তিষ্কে অস্ত্রোপচারসহ গুরুতর চিকিৎসা ব্যয়ে প্রাপ্ত অর্থ করমুক্ত রাখা হয়েছে। এছাড়া জাতীয় পেনশন স্কিমের আওতায় প্রাপ্ত সুবিধাভোগীদের আয়ের ওপরও কর ছাড়ের বিধান রয়েছে।
পুঁজিবাজারে দেশি-বিদেশি লাভজনক কোম্পানির অংশগ্রহণ বাড়াতে তালিকাভুক্ত এবং তালিকাবহির্ভূত কোম্পানির করহারের ব্যবধান ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতে বড় প্রতিষ্ঠানগুলো পুঁজিবাজারে আসতে উৎসাহিত হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। একইসাথে সিকিউরিটিজ লেনদেনে ব্রোকারেজ হাউজের উৎসে কর ০.০৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ০.০৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা বাজারে লেনদেনের পরিমাণ বাড়াতে সহায়ক হবে।
কর কাঠামোর অসামঞ্জস্যতা দূর করতে একাধিক উৎসে কর হার হ্রাস করা হয়েছে। ঠিকাদারি কাজে করহার ৫ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগে সর্বোচ্চ ৭ শতাংশ ছিল। জমি রেজিস্ট্রেশনে মূলধনি মুনাফার ওপর করহার এলাকাভেদে কমিয়ে ৬ শতাংশ, ৪ শতাংশ ও ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। পরিবেশবান্ধব রিসাইক্লিং শিল্পে উৎসে কর হ্রাস করে ১ দশমিক ৫ শতাংশ এবং গ্যাস বিতরণ কোম্পানির জন্য ০.৬ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া ইন্টারনেট সেবায় কর হার কমিয়ে ৫ শতাংশ এবং বিদ্যুৎ ক্রয়ে ৪ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে। মোবাইল অপারেটরদের টার্নওভার করও কমিয়ে ১.৫ শতাংশ করা হয়েছে।
কর পরিপালন প্রক্রিয়া সহজ করতে এবার রিটার্ন দাখিলে কিছু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এসেছে। এতিমখানা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ও অনাথ আশ্রমগুলোকে রিটার্ন দাখিল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। উৎসে কর কর্তনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রতি মাসের পরিবর্তে তিন মাস অন্তর রিটার্ন দাখিলের সুযোগ দেওয়া হয়েছে। জমি হস্তান্তরের অতিরিক্ত অর্থের ওপর কর দিতে হবে যথাযথ দালিলিক প্রমাণের ভিত্তিতে। পাশাপাশি স্বনির্ধারণী রিটার্নের অডিট পদ্ধতি সহজ করা হয়েছে এবং ১২টি সেবার জন্য শুধু টিআইএন নম্বর দিলেই চলবে—রিটার্ন দাখিলের প্রমাণ দিতে হবে না।
এছাড়া কর অব্যাহতি যৌক্তিকীকরণে নেওয়া পদক্ষেপগুলোর মধ্যে রয়েছে—যেসব খাতের কর অব্যাহতির মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ জুনে শেষ হবে, সেগুলোর মেয়াদ আর বাড়ানো হয়নি। দীর্ঘদিন ধরে যেসব খাত হ্রাসকৃত হারে কর প্রদান করছিল, সেইসব সুবিধাও বাতিল করা হয়েছে। তবে প্রান্তিক খামারিদের জন্য আয় করমুক্ত সীমা পাঁচ লাখ টাকায় নির্ধারণ করা হয়েছে।
একইসঙ্গে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করেও যারা দেশে আয় করছে অথচ বিদেশে অর্থ পাচার করছে, তাদের জন্য কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এখন থেকে এসব আয়ের ওপর প্রযোজ্য কর ও জরিমানা আদায়ের বিধান চালু করা হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা জানান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) প্রথমবারের মতো ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রত্যক্ষ কর ব্যয়ের হিসাব প্রকাশ করেছে। এতে দেখা যায়, ওই বছর কর ব্যয় দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭ হাজার ১৩৩ কোটি টাকা।
বাজেট বক্তৃতার একপর্যায়ে অর্থ উপদেষ্টা জানান, এই সংস্কারের মাধ্যমে একদিকে যেমন রাজস্ব আহরণ বাড়বে, তেমনি অন্যদিকে করদাতাদের ভোগান্তি কমবে। দেশের রাজস্ব ব্যবস্থাকে আধুনিক, স্বচ্ছ ও টেকসই করতে নেওয়া এসব পদক্ষেপ আগামী দিনে জাতীয় অর্থনীতিকে আরো শক্ত ভিত্তিতে দাঁড় করাতে সহায়ক হবে।
নতুন বছরে রাজস্ব আয়
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরে মোট ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের প্রস্তাব করেন ড. সালেহউদ্দিন। তিনি জানান, এটি হবে জিডিপির ৯.০ শতাংশ। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের মাধ্যমে আসবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
নতুন বছরে ব্যয়
আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য মোট ৭ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়, যা জিডিপির ১২ দশমিক ৭ শতাংশ। এর মধ্যে পরিচালনসহ অন্যান্য খাতে মোট ৫ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা এবং বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে ২ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব করেন উপদেষ্টা।
প্রস্তাবিত বাজেট ঘাটতি ও অর্থায়ন
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। প্রস্তাবিত বাজেটে মোট ঘাটতির মধ্যে ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এবং ১ লাখ ১ হাজার কোটি টাকা বৈদেশিক উৎস থেকে নির্বাহ করার প্রস্তাব করা হয়। আগামী অর্থবছরে সুদ পরিশোধ বাবদ মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ১ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা।
চ্যালেঞ্জের নতুন বাজেট
রাজস্ব আদায়ে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে সরকার। বিনিয়োগ মন্দা, সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) বাস্তবায়নে বড় ধরনের ধীরগতি, অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আহরণে বড় ধরনের ঘাটতির মুখে রয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। এর মধ্যে এনবিআর বিলুপ্ত করে দুটি পৃথক বিভাগ গঠনে জারি করা অধ্যাদেশকে কেন্দ্র করে এনবিআর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আন্দোলেনের কারণেও চলতি বছরের রাজস্ব আদায়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশংকা রয়েছে। এরই মধ্যে আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে এনবিআরের মাধ্যমে আদায় করা হবে ৪ লাখ ৯৯ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় এ লক্ষ্য অর্জন একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
চলতি অর্থ বছরের (২০২৪-২৫) শুরুতে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছিল ৪ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু অর্থবছরের মাঝপথে কাটছাঁট করে সে লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ৪ লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকায়। গত এপ্রিল পর্যন্ত রাজস্ব আদায় হয়েছে ২ লাখ ৭৮ হাজার ২৪২ কোটি টাকা। এ হিসাবে লক্ষ্য পূরণে বাকি দুই মাসে আদায় করতে হবে ১ লাখ ৮৫ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সংশোধিত লক্ষ্যের ৩৭ শতাংশের বেশি আদায় করতে হবে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে। এমন পরিস্থিতিতেই আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) জন্য বাজেটে এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা সংশোধিত আকারের তুলনায় ৭ দশমিক ৬৬ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কারণে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিও ধীরগতিতে রয়েছে। চলতি অর্থবছরের (২০২৪-২৫) সাময়িক হিসাবে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধি কমে ৩ দশমিক ৯৭ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আগের বছরের চূড়ান্ত হিসাবে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৪ দশমিক ২২ শতাংশ। আগামী ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ৫ দশমিক ৫ শতাংশ রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির সবচেয়ে বড় চালিকাশক্তি কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরেও সবচেয়ে কম হয়েছে। এর আগের অর্থবছরগুলোতেও কৃষির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ধীরগতির। সাময়িক হিসাব অনুযায়ী, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে কৃষি খাতের প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ। আগের অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ৩০ শতাংশ। সাময়িক হিসাবে, কৃষি খাতের প্রবৃদ্ধির হার ১ দশমিক ৫১ শতাংশীয় পয়েন্ট হ্রাস পেয়েছে।
তবে শিল্পখাতের প্রবৃদ্ধি গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বেড়েছে। সাময়িক হিসাবে, চলতি অর্থবছরে শিল্প খাতের প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে শিল্প খাতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। সাময়িক হিসাবে, সেবা খাতের প্রাক্কলিত প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৫১ শতাংশ। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের চূড়ান্ত হিসাবে সেবা খাতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৫ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ।
চলতি অর্থবছরে জিডিপির আকার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৬২ বিলিয়ন ডলার, বাংলাদেশি মুদ্রায় এর আকার দাঁড়িয়েছে ৫৫ লাখ ৫২ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরে (২০২৩-২৪) জিডিপির আকার ছিল ৪৫০ বিলিয়ন ডলার, দেশীয় মুদ্রায় যা ছিল ৫০ লাখ ২ হাজার ৬৫৪ কোটি টাকা।
চলতি অর্থবছরের শুরুর দিকে মূল্যস্ফীতি খুব বেশি থাকলেও শেষের দিকে এসে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে। এপ্রিলে গড় মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ১৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটেও মূল্যস্ফীতির লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশ।
গতি নেই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে
অর্থবছর শেষ হতে চললেও গতি নেই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে। অর্থবছরের ১০ মাস পেরোলেও খরচ অগ্রগতি মাত্র ৪১ শতাংশ। গত অর্থবছরের চেয়ে এবার উন্নয়নে প্রায় ৩২ হাজার কোটি টাকা খরচ কম হয়েছে। এপ্রিলে খরচ হয়েছে মাত্র সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা। অর্থবছরের শেষ দুই মাসে এক লাখ ৩২ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা খরচের টার্গেট রয়েছে, যা অসম্ভব মনে করছেন সংশিষ্টরা। তারা বলছেন, দুই মাসে সরকারের যেমন এত টাকা দেওয়ারও সামর্থ্য নেই, তেমন খরচেরও সামর্থ্য নেই।
যদিও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, জুলাই অভ্যুত্থানে হাসিনা সরকারের পতনের পর অনেক ঠিকাদাররা পালিয়ে গেছেন। ফলে অনেক সাইটে কাজ হচ্ছে না, ধস নেমেছে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে।
গতকাল জুলাই-এপ্রিল পর্যন্ত ১০ মাসের এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য ওয়েবসাইটে প্রকাশ করেছে পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি)। তাতে দেখা যায়, ১০ মাসে এডিপি বাস্তবায়ন হয়েছে ৪১ দশমিক ৩১ শতাংশ। এদিকে ১০ মাসে ৯৩ হাজার ৪২৪ কোটি টাকা অর্থছাড় হয়েছে, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরের পর সর্বনিম্ন। গত অর্থবছরে ১ লাখ ২৫ হাজার ৩১৫ কোটি টাকা ছাড় হয়েছিল এই সময়ে। গত এপ্রিল মাসে অর্থছাড় হয়েছে মাত্র ১০ হাজার ৫৩০ কোটি টাকা। যেখানে আগের অর্থবছরের এপ্রিল মাসে ছাড় হয়েছিল ১৭ হাজার ৭০৩ কোটি টাকা।
বড় ঋণের বড় বোঝা
শেখ হাসিনার আমলে দেশি-বিদেশি উৎস থেকে দেদার ঋণ নিয়েছিল সরকার। এই ঋণের পরিমাণ সাড়ে ১৮ লাখ কোটি টাকা। কিছু প্রকল্পে বড় অঙ্কের স্বল্পমেয়াদি ঋণ নেওয়ায় দ্রুত সুদ ও কিস্তি পরিশোধের চাপ তৈরি হয়েছে, যা সরকারের ব্যয়ের সক্ষমতা কমিয়ে দিয়েছে। নতুন বাজেটে ঋণ পরিশোধের চাপ আরো বাড়বে।
অর্থ মন্ত্রণালয় থেকেও নতুন বাজেটকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখানো হয়েছে। তাদের সামষ্টিক অর্থনীতি নীতি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প প্রশাসন কর্তৃক শুল্কারোপের নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা করতে হবে। রাজস্ব-জিডিপি অনুপাতের নিম্নহারকেও চ্যালেঞ্জ ধরা হচ্ছে। বিদেশি বিনিয়োগের ধীরগতির কথাও তুলে ধরেছেন তারা। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের পর বাংলাদেশ হঠাৎ বিপদের মুখে পড়তে পারে, যা আগামী বাজেটেই মোকাবিলা করতে হবে।