অস্থিমজ্জায় সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগ

 আমার দেশ
১৬ এপ্রিল ২০২৩

মাহমুদুর রহমান

মাহমুদুর রহমান

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে সর্বদাই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দিলেও স্বাধীনতার পর থেকেই ভারতীয় নিয়ন্ত্রণপুষ্ট দেশটির মিডিয়া এই সত্য আড়ালের সর্বাত্বক চেষ্টা করে গেছে। সত্তরের দশকে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের গ্রামবাংলায় সশস্ত্র ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং শ্রমিক লীগের সন্ত্রাসের হাত থেকে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা তো বটেই, এমন কি সাধারণ, অরাজনৈতিক পরিবারের নারীরাও নিরাপদ ছিলেন না। আজকের মতই তখনও আওয়ামী প্রশাসন সরকার দলীয় সন্ত্রাসীদের সকল ধরনের নিরাপত্তা দিত। জনগণের নিরাপত্তা প্রদানের পরিবর্তে তৎকালিন একনায়ক, বর্তমান ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা শেখ মুজিব উল্টো জনগণের উপর “লাল ঘোড়া” চালিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ক্ষমতা থেকে শেখ মুজিবের একদলীয় স্বৈরাচারের রক্তাক্ত উৎখাত পর্যন্ত মানুষের উপর জুলুমের অবসান ঘটে নাই।

এই যে সরকারবিরোধী আন্দোলনে বাসে আগুন দিয়ে মানুষ খুনের অভিযোগে বিএনপিকে নিয়মিতভাবে অভিযুক্ত করা হয়ে থাকে তার সূচনাও বাংলাদেশে ২০০৪ সালের ৫ জুন আওয়ামী লীগের হাত ধরেই হয়েছে। সেদিন চারদলীয় সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের হরতাল চলছিল। শেরাটন হোটেলের সামনে সেদিন ভোরে বিআরটিসির একটি বাসে গান পাউডার দিয়ে আগুন লাগিয়ে নারী-পুরুষ-শিশুসহ নয় জনকে হত্যা করা হয়। নিহত দুই বছরের শিশুটির নাম ছিল মীম। পরবর্তীতে গোপন স্থানে এক এগারো সরকারের জিজ্ঞাসাবাদে আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতা এবং শেখ হাসিনার মামাতো ভাই শেখ সেলিম ইঙ্গিত করেছিলেন যে, সেই আগুন সন্ত্রাসের হুকুমমদাতা ছিলেন স্বয়ং শেখ হাসিনা। তার তরফ থেকেই যুবলীগকে হত্যাকান্ড চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। গোপন যায়গায় দেওয়া শেখ সেলিমের জবানবন্দি এখনও ইউটিউবে খুঁজলে পাওয়া যাবে। বাসে আগুন দিয়ে নিরীহ, অসহায় যাত্রিদের হত্যার দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালিন প্রতিরক্ষা সেক্রেটারি ডোনাল্ড রামসফেল্ড ঢাকায় অবস্থান করছিলেন।

এবার আসুন ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরের লগিবৈঠার দিনেদুপুরের নারকীয় হত্যার দিনে। শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে সেদিন লগিবৈঠা নিয়ে আওয়ামী লীগের হাজার হাজার সন্ত্রাসী বাহিনী রাজধানীর বুকে ঝাপিয়ে পড়েছিল। তারা কেবল নির্মমভাবে পিটিয়ে প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক কর্মীকে হত্যাই করেনি, লাশের বুকের উপর চড়ে শ্মশানের পিশাচের মত নাচানাচি করেছে। আমার মনে আছে টেলিভিশনে সেই দৃশ্য পরিবার নিয়ে দেখা সম্ভব হয় নাই। আমাদের টেলিভিশন বন্ধ করে উঠে যেতে হয়েছিল। রাষ্ট্র হিসেবে এটা বাংলাদেশের ব্যর্থতা যে, আজ পর্যন্ত এমন ঘৃন্য মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করা সম্ভব হয় নাই। সেদিনের চিহ্নিত খুনিরাই ২০১৩ সালে তথাকথিত গণজাগরণে শাহবাগীদের নেতৃত্ব দিয়েছিল। আমাদের দেশ পত্রিকায় লাশের উপর নৃত্যরত শাহবাগী নেতৃবৃন্দের ছবি প্রকাশিতও হয়েছিল। ২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর শাপলা চত্বরে ঘুমন্ত আলেমদের উপর গণহত্যাতেও পুলিশ-বিজিবি-র‍্যাবের সাথে পুলিশের পোষাকে আওয়ামী একাধিক সংগঠনের খুনিরা অংশ নিয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে।  প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবরারকে সারা রাত ধরে পিটিয়ে হত্যা, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ও ইডেন কলেজে ছাত্রীদের উপর অবর্ণনীয় নির্যাতন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজসহ অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের ধরে ধরে সারারাত নির্যাতন, এ সবই আওয়ামী স্যাডিস্টদের বিকৃত চরিত্রের বহি:প্রকাশ। এই বর্বর আওয়ামী চরিত্রের সাথে যোগ হয়েছে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুদের হিন্দুত্ববাদি অংশের সংখ্যাগুরু মুসলমানদের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃনার মিশ্রণ। এই অংশটি পুরোপুরি আওয়ামী লীগের সাথে মিশে গেছে। ফলে পত্রপত্রিকায় ধর্ষকামিদের মধ্যে আমরা প্রচুর হিন্দু নাম দেখতে পাই। বাংলাদেশে কোনদিন গণতন্ত্র ফিরে এসে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগের সকল সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের বিচার হবে বলে আশা রাখছি।

গত মাসখানেক ধরে ঢাকায় প্রায় প্রতিদিন কোন না কোন স্থাপনায় রহস্যজনক আগুন লাগছে। এগুলোর অধিকাংশই ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান। এই সব আগুনে অনেক মানুষ মারা গেছেন। সম্পদের বিপুল ক্ষতি হয়েছে। তো এই সব আগুন নিয়ে গতকাল ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী একটি অযাচিত এবং বিতর্কিত মন্তব্য করেছেন। তিনি এগুলোকে ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে এর পিছনে বিএনপি-জামাতের হাত আছে কিনা তদন্ত করতে বলেছেন। একজন ভয়ংকর, খুনি, ফ্যাসিস্ট প্রধানমন্ত্রী যখন এ জাতীয় নির্দেশ দেন তখন তদন্তকারীদের তার সন্দেহ সঠিক প্রমাণ করাটা অবশ্যকরণীয় হয়ে দাঁড়ায়। কার ঘাড়ে কটা মাথা যে এখন বলবে, না এই কাজ বিএনপিজামাতের নেতাকর্মীরা করে নাই? অতএব, দল দু’টির অন্তত মধ্যম সারির নেতাকর্মীদের এখন বাড়তি পুলিশি হয়রানির মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমি প্রবীণ মানুষ তো, তার উপর এক সময়ের পুরো দস্তুর প্রকৌশলী বর্তমানে মূলত: ইতিহাস নিয়েই চর্চা করি। বর্তমান প্রজন্ম শেখ মুজিব আমলের অনাচারের অনেক কিছুই জানে না। সোশ্যাল মিডিয়া নিয়ন্ত্রত যুগে তাদের জানার আগ্রহও তেমন একটা আছে বলেও মনে হয় না। তারা কেবল জানে, শেখ মুজিবকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করতে হবে।

যাই হোক, ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত দেখা গেল, বাংলাদেশের সব পাটকল এবং সুতা ও কাপড়ের মিলে ঠিক আজকের মতই প্রতিদিন রহস্যজনক আগুন লাগছে। তখন কিন্তু, দেশে কোন বিএনপি নাই। দলটির জন্মই হয় নাই। জামাতে ইসলামী থাকলেও তারা প্রাণভয়ে যেখানে পারছে পালাচ্ছে। আলেম-ওলামা ও ইসলামপন্থিদের গ্রামগঞ্জে ধরে ধরে হত্যা করা হচ্ছে। কাদের সিদ্দিকী তো খোদ ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মানুষ মেরে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় স্থান পেয়ে গেলেন। (The New York Times, 4 Tortured, Slain at Dhaka Rally, Dec. 20, 1971, www.nytimes.com ) তিনি শেখ মুজিবের পতনের অল্প কদিন আগে টাঙ্গাইলের গভর্নরও হয়েছিলেন। ক্ষমতার পালাবদল হলে কাদের সিদ্দিকী ভারতে পালিয়ে গিয়ে “র” এর সহযোগীতায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার চেষ্টাও করেছিলেন। আওয়ামী লীগ দলটির জিনের (Gene) সঙ্গেই সন্ত্রাস ওতপ্রোতভাবে জড়িত। যাক সে প্রসঙ্গ।

তাহলে আগুন লাগিয়ে সদ্যস্বাধীন দেশের অর্থনীতি কারা ধ্বংস করছিল? প্রকৃত ঘটনা ছিল যে, স্বাধীনতার পর ওই সমস্ত মিলকারখানা আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরাই দখল করে নিয়েছিল। অধিকাংশ মিলই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানীদের। তারা সকলে ভারতীয় সেনাবাহিনী এবং মুক্তি বাহিনীর হাতে ঢাকা পতনের আগেই পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে গেছিল। আওয়ামী দখলদাররা মিলগুলোর কোটি কোটি টাকার মালামাল এবং যন্ত্রপাতি বেঁচে দিয়ে লুটপাটের প্রমাণ লোপাট করতেই আগুন লাগাতো। আর এই সব আত্মবিধ্বংসী কাজে প্রতিবেশি ভারতের পূর্ণ সমর্থন ছিল যাতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হতে না পারে। বাংলাদেশের পাটকল ধ্বংস হয়ে গেলে স্বাভাবিকভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে পাটজাত দ্রব্যের একমাত্র প্রতিযোগী হিসেবে ভারতেরই সব চাইতে লাভবান হওয়ার সুযোগ ছিল। আওয়ামী সন্ত্রাসী বাহিনী মিলের দখল নেয়ার আগে ভারতীয় সেনাবাহিনীও সেই সব মিলে একচোট লুটপাট চালিয়েছিল। সেই লুটপাটের প্রতিবাদ করতে গিয়েই মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলকে ভারতীয় বাহিনী গ্রেফতার করেছিল। বাংলাদেশ সরকার পরবর্তীতে তাকে চাকরীচ্যূত করে।(অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা, মেজর এম এ জলিল, ইতিহাস পরিষদ, প্রথম প্রকাশ, অক্টোবর ১৯৮৮) সেই সময় সাধারণ জনগণের মধ্যে এমন সন্দেহও ছিল যে, ভারতের গোয়েন্দারাই আগুন লাগানোতে সহযোগিতা করতো।

শেখ হাসিনা উপরোল্লিখিত সকল ঘটনাই জানেন। আর এটাও জানেন যে, এখনকার আগুন লাগার ঘটনাসমূহ যদি তার পিতার আমলের মত নাশকতা হয়ে থাকে তাহলে সেগুলোতেও তার দলের লোকেরাই লাভবান হচ্ছে। এখানে উল্লেখ্য, পুরোনো ঢাকার যে এলাকাতে প্রধানত: আগুন লাগছে সেখানকার “সিলেক্টেড মেয়র” শেখ হাসিনার অত্যন্ত স্নেহধণ্য ভাতিজা শেখ তাপস। তিনি দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। ২০০৯ সালে বিডিআর হত্যার অন্যতম কুশিলবের আগুনের সকল রহস্য জানার কথা। সুতরাং, এই সব আগুনের পিছনেও আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের ভূমিকা অনেকটাই দৃশ্যমান। শেখ হাসিনা বিএনপি-জামাতের বিরুদ্ধে আগাম বায়বীয় অভিযোগের আঙ্গুল তুলে দলীয় অপরাধ আড়াল করতে চাচ্ছেন মাত্র। বাংলাদেশের জনগণ আজও যদি ১৫ বছর ধরে ঘাড়ের উপর চেপে থাকা সিন্দবাদের দৈত্যের সহজ চালগুলো ধরতে না পারে তাহলে সেই নির্বুদ্ধিতার কোন চিকিৎসা নাই। পবিত্র রমজান মাসে প্রত্যাশা, মহান আল্লাহতায়ালা বাংলাদেশের জনগণকে ফ্যাসিস্ট হাসিনা এবং সন্ত্রাসী আওয়ামী লীগ থেকে নাজাত প্রদান করুন।

সম্পাদক, আমার দেশ
১৬/০৪/২০২৩