এম এ আজিজ : পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ যে গাছের ওপর বেড়ে ওঠে, শেষ পর্যন্ত সেই গাছ অনেক সময় আশ্রিত গাছের কারণে প্রয়োজনীয় পুষ্টি আহরণ করতে হিমশিম খায়। বাংলাদেশের রাজনীতিতেও এমনটা দেখা যাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধ, গণতন্ত্র এবং অসাম্প্রদায়িক আদর্শের ভিত্তিতে প্রধানত বাম ও আধা বামপন্থি ১৩টি দল নিয়ে ২০০৪ সালে আওয়ামী লীগ ১৪-দলীয় জোট গঠন করে। পরে এতে আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টি, তরীকত ফেডারেশনসহ আরও কয়েকটি দল যুক্ত হয়। অন্যদিকে, ২০০৮ সালে এরশাদের নেতৃত্বাধীন জাতীয় পার্টিকে নিয়ে গড়ে তোলা হয় মহাজোট।
নির্বাচনে আওয়ামী লীগের এ শরিক দলগুলো নৌকা প্রতীক নিয়েই নির্বাচন করতে নাছোড়বান্দা ভাব দেখাচ্ছে। কারণ, তাদের সদস্য ও সমর্থকের সংখ্যা দিন দিন এমন পর্যায়ে নেমেছে যে, দলগুলোর প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করতে হলে একদিকে তাদের আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক দিতে হবে এবং সেই সঙ্গে স্বতন্ত্র, ডামি, বিদ্রোহী প্রার্থীদের সরিয়ে দিয়ে নির্বাচনী মাঠ পরিষ্কার করতে হবে। শরিকদের এসব আবদার রক্ষা করতে গিয়ে আওয়ামী লীগকে বেশ ঝামেলাই পোহাতে হচ্ছে।
প্রকাশ্যে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের অ্যান্টি ভোট বেশি। তাই আমরা এককভাবে নির্বাচন করলে নীরব বিপ্লব ঘটে যেতে পারে।’ কিন্তু তিনি কি হিসাব করেছেন, আওয়ামী লীগের ডামি, স্বতন্ত্র, বিদ্রোহীসহ জোট ও মহাজোট একপক্ষীয়! তাদের পক্ষের যারাই নির্বাচনে থাকুক না কেন, ভোট তাদের মধ্যেই ভাগাভাগি হবে। অন্যদিকে, নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি ও তার মিত্র দলগুলোর ভোটাররা এ নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রেই যেতে পারবে না অথবা যাবে না। কেউ গেলেও, কোনোভাবেই সে আওয়ামী লীগের পক্ষের কাউকে ভোট দেবে না। অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও মনে করে, এসব সমর্থকবিহীন দল ঐক্য, জোট বা মহাজোটের নামে তাদের অধিকার কেড়ে নিচ্ছে। সুতরাং তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগের সঙ্গী দলের প্রার্থীদের ভোট দেবে না। তাহলে নীরব বিপ্লবের জায়গাটা কোথায়?
যখন ১৪-দলীয় জোট গঠন করা হয়েছিল, তখন এ জোটের ছোট দলগুলোর যেমন পরিচিতি ছিল, তেমনি তাদের শীর্ষ নেতাদের রাজনীতির অতীত রেকর্ডও সংগ্রামী ছিল। কিন্তু বর্তমানে ১৪ দলের ১৩টি দলসহ মহাজোটের জাতীয় পার্টিও অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। এর প্রধান কারণ– দলগুলো নিজেদের সাংগঠনিক শক্তির ওপর গুরুত্ব না দিয়ে তাৎক্ষণিক আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য জোটের বড় দল আওয়ামী লীগের ওপর সবকিছুতে নির্ভরশীল হয়ে পড়া।
বিএনপির নেতৃত্বেও ২০-দলীয় একটি জোট ছিল। এই জোট অনেক আগেই ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এই ২০-দলীয় জোটের জামায়াতে ইসলামী ছাড়া অধিকাংশ দল সাংগঠনিক অবস্থা যথেষ্ট দুর্বল হওয়ায় বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারছে না। অন্যদিকে, ১২-দলীয় জোট থেকে বেরিয়ে কল্যাণ পার্টি ও বাংলাদেশ মুসলিম লীগ এবং সমমনা জোট থেকে বেরিয়ে মাইনরিটি জনতা পার্টি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে।
২০১৪ ও ’১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে সরকারি দলের প্রধান দুর্বলতা ছিল ভোট কারচুপি; ১৫৩টি সংসদীয় আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ী হওয়া এবং বিএনপি ও তার মিত্ররা নির্বাচনে না থাকায় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়া এবং বিশ্বের কাছে তা অংশগ্রহণমূলক না হওয়া। এই দুর্বলতাগুলো এড়াতে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে সরকারি দল কয়েকটি কিংস পার্টি, আওয়ামী লীগের শরিক দলগুলো ও মহাজোটের অংশীদার জাতীয় পার্টিকে নিয়ে নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক করার প্রয়াস চালাচ্ছে। একই সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়া কেউ যাতে বিজয়ী হতে না পারে সে জন্য সরকারি দল থেকে প্রতিটি সংসদীয় আসনে ডামি, স্বতন্ত্র ও বিদ্রোহী প্রার্থী রাখা হয়েছে।
সরকার মনে করে, জনগণ বা ভোটার অংশগ্রহণ করলেই নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে। কিন্তু আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে, যে নির্বাচনে সর্বোচ্চ সংখ্যক রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করে, যে দলগুলোর অনেক ভোটার রয়েছে এবং যে দলগুলোর জয়ের সম্ভাবনা রয়েছে, সেই রাজনৈতিক দলগুলো যদি স্বাধীনভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে, তাহলে তাকেই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলা যাবে। নির্বাচন হলো একটি আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচন করে। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের সরকার গঠন করে। তাদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করার জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণকারীদের ক্ষমতা প্রদান করে।
তাহলে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে কি নির্বাচন বলা যায়? এটাকে বলা যেতে পারে ‘ভাগবাটোয়ারার নির্বাচন’ বা ‘বিরোধী দল গঠন ব্যবস্থাপনা’। অর্থাৎ নির্বাচনের আগেই নিশ্চিতভাবে বলা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করতে যাচ্ছে। এখন সংসদে বিরোধী দল কে হবে– সেটারই ব্যবস্থাপনা করা হচ্ছে। এখানে জনগণ বা ভোটারদের গুরুত্ব নেই বললেই চলে।
এসব ভাগবাটোয়ারার আয়োজনে সংঘাত-সহিংসতা এড়িয়ে কীভাবে নির্বাচন হবে? বিএনপি ও তার মিত্রদের নির্বাচনের বাইরে রেখে, বিএনপির শীর্ষ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার, মামলা, জেল, জুলুম, পুলিশসহ রাষ্ট্রের প্রশাসন ও আদালতকে নিয়ন্ত্রণে রেখেই বা কীভাবে ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করা যায়, সেটাই দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
এম এ আজিজ: সাংবাদিক ও কলাম লেখক