মানসিক রোগের চিকিৎসার নামে একজন সিনিয়র সহকারি এএসপিকে পিটিয়ে হত্যার অভিযোগ উঠেছে ঢাকার একটি বেসরকারি হাসাপাতালের বিরুদ্ধে। সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) আনিসুল করিমকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে গেলে সেখানে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ পরিবারের সদস্যদের। এই ঘটনায় হাসপাতালটির মালিকসহ ১১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
রাজধানীর আদাবরের মাইন্ড এইড নামের এ হাসপাতালটিতে মঙ্গলবার (১০ নভেম্বর) তালাও ঝুলিয়ে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ। একজন পুলিশ সদস্যকে পিটিয়ে হত্যার পর জানা গেল মানসিক রোগীর চিকিৎসার জন্য প্রতিষ্ঠিত এ হাসপাতালের অনুমোদন বা বৈধ কোন কাগজপত্র নেই। মনে হচ্ছে বিষয়ে খোঁজ নেয়ার জন্য কোন কর্তৃপক্ষ নেই বাংলাদেশে। কোথায়ও কাউকে পিটিয়ে হত্যা বা অন্য কোন উপায়ে নির্যাতনের ঘটনা ভাইরাল হলেই কেবল খোঁজ নেওয়ার তাগিদ অনুভবন করা হয়। যেমনটি দেখা গিয়েছে, উত্তরায় রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক শাহেদ করিম গ্রেফতার হওয়ার পর। শাহেদ করিম গ্রেফতার হওয়ার আগে ওই হাসপাতালকে করোনা টেষ্টের অনুমোদন দিয়েছিল স্বাস্থ্য অধিদফতর। কিন্তু শাহেদ গ্রেফহার হওয়ার পর জানা গেল ওই হাসপাতালেরও অনুমোদন নেই। সবকিছুই খোঁজ নেওয়া হয় কোন ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরে কেন, এ প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের।
এএসপি আমিনুল করিম (৩৫) বরিশাল মহানগর ট্রাফিক পুলিশের সহকারী কমিশনার। তাঁর মানসিক রোগ দেখা দিলে চিকিৎসার জন্য সোমবার (০৯ নভেম্বর) আদাবরের মাইন্ড এইড নামের হাসপাতালে যায় পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু চিকিৎসার বদলে সেখানে তাকে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে জানিয়েছে পুলিশ।
এ ঘটনায় আনিসুলের বাবা ফাইজ্জুদ্দিন আহমেদ মোট ১৫ জনকে আসামি করে আদাবর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেছেন। পুলিশ জানিয়েছে, মারপিটে সরাসরি জড়িত থাকায় হাসপাতালের ১০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তাদেরকে সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে ঢাকা মহানগর চীফ জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালত।
ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ জানিয়েছেন, মামলার অন্যতম আসামি ডা. নিয়াজ মোর্শেদকে মঙ্গলবার গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
ডিসি হারুণ বলেন, গ্রেপ্তারকৃত এই ডাক্তার মাইন্ড এইড হাসপাতালের একজন পরিচালক। অসুস্থতার কারণে বর্তমানে তিনি নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
পুলিশ জানায়, গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের মধ্যে আরিফ মাহমুদ জয় এবং রেদোয়ান সাব্বির ওই হাসপাতালের অন্যতম শেয়ার হোল্ডার।
ডা. নিয়াজ মোর্শেদ ছাড়াও আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাখাওয়াত হোসেন, সাজ্জাদ আমিন ও ফাতেমা খাতুন ময়নাকে মামলায় আসামি করা হয়েছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পরিদর্শক (অপারেশন্স) ফারুক মোল্লা জানান, আসামিদের মধ্যে আব্দুল্লাহ আল মামুন এবং ফাতেমা খাতুন ময়নাও চিকিৎসক। তাদের ‘পৃষ্ঠপোষকতায়’ এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে মামলার অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে।
যেভাবে হত্যা করা হয়:
রাজধানীর আদাবরে মাইন্ড এইড হাসপাতালে সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার আনিসুল করিম শিপন হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সিসিটিভির ফুটেজ পর্যালোচনার পর তার মৃত্যুকে ‘হত্যা’ বলছে পুলিশ। সিসিটিভি ফুটেজে মারপিটের ঘটনা ধরা পড়েছে।
মঙ্গলবার দুপুরে নিজ কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বলেন, এএসপি আনিসকে মারধরের ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনা করে দুই ধাপে মোট ১১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই ঘটনার সঙ্গে হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ, ব্যবস্থাপনায় জড়িত সকলের বিরুদ্ধে আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, আরিফ মাহমুদ জয় (৩৫) হাসপাতালে মার্কেটিং ম্যানেজার, রেদোয়ান সাব্বির (২৩) কো-অর্ডিনেটর, মো. মাসুদ (৩৭) কিচেন শেফ, জোবায়ের হোসেন (১৯) ওয়ার্ড বয়, তানভীর হাসান (১৮) ফার্মাসিস্ট, তানিফ মোল্লা (২০) ওয়ার্ড বয়, সজীব চৌধুরী (২০) ওয়ার্ড বয়, অসীম চন্দ্র পাল (২৪) ওয়ার্ড বয়, লিটন আহাম্মদ (১৮) ওয়ার্ড বয় এবং সাইফুল ইসলাম পলাশ (৩৫) ওয়ার্ড বয়।
ডিসি হারুণ বলেন, সোমবার (৯ নভেম্বর) বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ৩১তম বিসিএসের পলিশ ক্যাডারের সদস্য আনিসুল করিমকে চিকিৎসা করানোর জন্য তার পরিবারের সদস্যরা আদাবর থানাধীন বায়তুল আমান হাউজিং সোসাইটির ২ নম্বর সড়কের ২৮১ নম্বর বাড়িতে অবস্থিত গরহফ অরফ চংুপযরধঃৎু ্ উব অফফরপঃরড়হ ঐড়ংঢ়রহধষ ঢাকায় নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে যাওয়ার পর তিনি হাসপাতালের একটি রুমে নাস্তা করেন। কিছুক্ষণ পর ওয়াশরুমে যেতে চান তিনি। ১১টা ৩৫ মিনিটের দিকে হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয় তাকে ওয়াশরুমে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে হাসপাতালের দোতলায় নিয়ে যান। তখন তার বোন উম্মে সালমা সঙ্গে যেতে চাইলে আরিফ মাহমুদ জয় ও রেদোয়ান সাব্বির তাকে বাধা দেন এবং কলাপসিবল গেট আটকে দেন।
আধা ঘন্টার মধ্যেই আনুমানিক ১২টার দিকে আসামি আরিফ মাহমুদ জয় নিচে এসে তার বোনকে ওপরে যাওয়ার জন্য ডাক দেন। তার বোনসহ পরিবারের লোকজন ওপরে গিয়ে আনিসুল করিমকে একটি রুমের ফ্লোরে নিস্তেজ অবস্থায় শোয়া দেখতে পান। পরে পরিবারের সদস্যরা একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে তাকে দ্রুত জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউটে নিয়ে যায়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক পরীক্ষা করে আনিসুল করিমকে দুপুর ১২টা ৫৮ মিনিটে মৃত ঘোষণা করেন। এই ঘটনায় আনিসুল করিমের বাবা বাদী হয়ে আদাবর থানায় হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নম্বর ৯।
হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ এরই মধ্যে ভাইরাল হয়েছে।
ডিসি হারুন বলেন, হাসপাতালের ভিডিও ফুটেজ পর্যালোচনায় দেখা যায়, বেলা আনুমানিক ১১টা ৪৫ মিনিটে আসামিরা আনিসুল করিমকে হাসপাতালের দোতলার একটি রুমে মারতে মারতে ঢুকায়। তাকে রুমের ফ্লোরে জোরপূর্বক উপুড় করে ৩-৪ জন হাঁটু দিয়ে পিঠের ওপর চেপে বসে। কয়েকজন পিঠমোড়া করে ওড়না দিয়ে তার দুই হাত বাঁধে। কয়েকজন কনুই দিয়ে ঘাড়ের পেছনে ও মাথায় আঘাত করে।
একজন মাথার ওপরে চেপে বসে এবং আসামিরা সকলে মিলে পিঠ, ঘাড়সহ শরীরের বিভিন্নস্থানে উপর্যুপরি কিল-ঘুষি মারে। ফলে আনিসুল করিম নিস্তেজ হয়ে পড়েন। পরিকল্পিতভাবে মারপিট করে তাকে হত্যা করা হয়েছে।
ডিসির হারুন বলেন, এটি একটি হত্যাকাণ্ড। সরকারি মানসিক হাসপাতালে ভর্তির কিছু পরেই আনিসুলকে ওই নিরাময় কেন্দ্রে নেওয়া হয়।
এর পেছনে দালালদের সংশ্লিষ্টতার আভাস দিয়ে ডিসি হারুন বলেন, ওই হাসপাতালের বৈধ কোনো কাগজপত্র নেই। অবৈধভাবে তারা বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে রোগী ভাগিয়ে নেয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব বিষয় তদন্ত করা হচ্ছে।
হাসপাতালে পুলিশের তালা:
মঙ্গলবার বিকালে ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ডা. আহসানুল হক আদাবরের মাইন্ড এইড সাইকিয়াট্রি অ্যান্ড ডি-অ্যাডিকটেড হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। পরে পুলিশ ওই হাসপাতালে তালা লাগিয়ে দেয়।
ওই হাসপাতালে যে ১৬ জন রোগী ছিলেন, আনিসুলের মৃত্যুর ঘটনার পর সোমবারই তারা অন্য চিকিৎসা কেন্দ্রে চলে যান।
হাসপাতাল পরিদর্শন শেষে ডিসি হারুণ বলেন, এটি একটি অবৈধ হাসপাতাল। কোনো অনুমোদন নেই। তাছাড়া পুরো হাসপাতাল ঘুরে একটি জেলখানা মনে হয়েছে। যেখানে নির্যাতন করা হয়েছে, সেটি একটি বদ্ধ ঘর। বাতাস বের হওয়ারও রাস্তা নেই।
সিভিল সার্জন মঈনুল আহসান বলেন, মাইন্ড এইড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ গত ফেব্রুয়ারি মাসে অনুমোদনের জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু প্রয়োজনীয় কাগজপত্র, ব্যবস্থা, জনবল, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা না থাকায় তাদের অনুমোদন দেওয়া হয়নি। যে ঘরে পুলিশ কর্মকর্তাকে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে, সেটি একটি সাউন্ড প্রুফ কক্ষ। মানসিক রোগের চিকিৎসার জন্য এ ধরনের কক্ষের তো প্রয়োজন নেই। তারা কেন ওই বিশেষ কক্ষটি তৈরি করেছিল, তা তারাই ভালো বলতে পারবে।
পুলিশের সাবেক ওসি মুক্তিযোদ্ধা ফাইজ্জুদ্দিন আহমেদের ছেলে আনিসুল সোমবারই বরিশাল থেকে গাজীপুরে তাদের বাড়িতে যান। মানসিকভাবে অসুস্থ থাকায় চিকিৎসার জন্য তাকে আদাবরের ওই হাসপাতালে নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা।
তার বড় ভাই রেজাউল করিম বলেন, পারিবারিক ও পেশাগত কারণে একটা মানসিক চাপ ছিল আমার ভাইয়ের উপর। সে কারণে তাকে ডাক্তার দেখাতে নেওয়া হয়। শুনেছিলাম ওই হাসপাতালটার পরিবেশ তুলনামূলক ভালো।… কয়েজন ভালো ডাক্তার নাকি বসেন, সেজন্যই সেখানে গেছি।
হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজারসহ ১০ জন রিমান্ডে:
শিপন হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় গ্রেফতার হাসপাতালের মার্কেটিং ম্যানেজার আরিফ মাহমুদ জয়সহ ১০ জনের ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন আদালত।
মঙ্গলবার গ্রেফতার ১০ জনকে ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য প্রত্যেককে ১০ দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদাবর থানার পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ ফারুক মোল্লা। শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম শহিদুল ইসলাম প্রত্যেকের সাত দিন করে রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রিমান্ড আবেদনে বলা হয়, আসামিরা হাসপাতালে বাবুর্চি, ওয়ার্ডবয়, মার্কেটিং অফিসার ও কো-অর্ডিনেটর হিসেবে কর্মরত। মামলার এজাহারে বর্ণিত ১১-১৫ নম্বর ক্রমিকে আসামিরা অনুমোদন ছাড়া হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠা করে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণার মাধ্যমে চিকিৎসার নামে অবৈধ অর্থ অর্জন করে আসছিল।
এতে আরও বলা হয়, এই মামলার ভিকটিম আনিসুল করিমকে উন্নত চিকিৎসার আশায় মামলার বাদী গত ৯ নভেম্বর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে হাসপাতালে নিয়ে আসেন। মানসিক চিকিৎসা দিতে পারেন এমন কোনো ডাক্তার হাসপাতালে কর্তব্যরত ছিলেন না। আসামিরা চিকিৎসা দেয়ার অজুহাতে ভিকটিমকে বলপ্রয়োগ করে হাসপাতালের দোতলায় স্থাপিত একটি অবজারভেশন কক্ষে নিয়ে যায়। আসামিরা ভিকটিমকে মারতে মারতে অবজারভেশন কক্ষে ঢোকায়। তার ঘাড়, পিঠ ও মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে উপর্যুপরি আঘাত করে রুমের মধ্যে উপুড় করে ফেলে দেয়। কয়েকজন ভিকটিম পিঠে চড়ে বসে, কয়েকজন মাথার ওপর আঘাত করে, কয়েকজন দুই হাত পিঠমোড়া করে ওড়না দিয়ে বাঁধে।
আসামিদের এমন অমানসিক নির্যাতনে ভিকটিম আনিসুল করিমের মৃত্যু হয়। এজাহারনামীয় ১১-১৫ নম্বর ক্রমিকে বর্ণিত আসামিরা পলাতক। তাদের বর্তমান অবস্থান নির্ণয়পূর্বক গ্রেফতারের স্বার্থে পুলিশ হেফাজতে এনে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন।
আনিসুল করিম শিপন ৩১তম বিসিএসে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পান। সর্বশেষ তিনি বরিশাল মহানগর পুলিশে কর্মরত ছিলেন। তার বাড়ি গাজীপুরের কাপাসিয়ায়। তিনি এক সন্তানের জনক। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অনুপ্রাণবিজ্ঞান বিভাগের ৩৩ ব্যাচের ছাত্র ছিলেন এই পুলিশ কর্মকর্তা।
সিসিটিভি ক্যামেরায় বন্দি এএসপিকে পিটিয়ে হত্যার দৃশ্য—–