অশান্ত সময়
বিশ্বের যেকোনো দেশের দিকে দৃকপাত করলে প্রথমেই যে চিত্র ভেসে ওঠে, তা হলো বিভক্তি ও অশান্তি। প্রতিটি রাষ্ট্রই যেন শতধাবিভক্ত। এই বিভক্তি কখনো কখনো এমন পর্যায়ে যাচ্ছে যখন সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ছে। এর মাশুল দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।
অনুসন্ধানকারীরা জানতে চান, এই সঙ্ঘাত কেন এবং এর মূলে কে? তারা জবাব পাচ্ছেন, তবে তাও সত্যিকারের চিত্র তুলে ধরতে ব্যর্থ হচ্ছে। কিন্তু এই অশান্তির পথ ক্রমেই এগিয়ে চলছে।
তবে অনুসন্ধানকারীরা তাদের চিত্রে পেয়েছেন প্রধানত তিন ধরনের কর্মকাণ্ড। এগুলো হলো- সন্ত্রাস, খবরদারি ও মানবাধিকার খর্ব করা। তারা দেখেছেন, সমাজে নিরপরাধীরাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এর জন্য দায়ী বলে গণ্য এবং শিকার হচ্ছেন।
তাহলে সন্ত্রাস কারা করছে? উল্লিখিত অনুসন্ধানে বিস্ময়ের সাথে লক্ষ করা গেছে, এর মূলে আছেন ক্ষমতাবানরা। তারা এ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ে বা এটাকে নিয়ন্ত্রণ করে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধার করার জন্য সুপরিচিত। বিখ্যাত পশ্চিমা অনুসন্ধানীরা একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, সন্ত্রাস কখনোই সম্ভব নয় রাষ্ট্রের একাংশের সহায়তা ছাড়া। তারা দেখিয়েছেন- সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য যে সংগঠন, অর্থ ও যোগাযোগব্যবস্থার প্রয়োজন, তার নিয়ন্ত্রণ অথবা প্রস্তুতকরণের ব্যবস্থা প্রধানত রাষ্ট্রেরই থাকে। তারা ‘রাষ্ট্র’ বলতে এর নিয়ন্ত্রক বা প্রদায়কদের বুঝিয়েছেন। এখন শাসক ও ক্ষমতাবানদের প্রধান অস্ত্র খবরদারি, যা অতীত থেকে চলে আসছে। দেখা যায়, তারা তাদের প্রজাদের সব তথ্য জানার জন্য ব্যবস্থা নিত। এমনও দেখা গেছে, তারা এর জন্য বিশেষ অশ্বারোহী খবর সংগ্রহকারী নিযুক্ত করত। কথিত আছে, এই ঢাকা শহরের রাস্তা প্রশস্ত হওয়ার মূলে ছিল অশ্বারোহী খবরদাতার প্রয়োজন। এটা নাকি এসেছিল প্যারিসের ক্ষমতাবানদের প্রশস্ত রাস্তা তৈরি করার ধারণা থেকে। সেখানে অশ্বারোহীদের জন্য বিশেষ রাস্তা ছিল যেখান দিয়ে ঘোড়সওয়ার কর্মচারীরা খবর নিয়ে রাজা ও মোসাহেবদের দিত।
এই খবরদারির এবং অনুপ্রবেশের আকার এখন এত ব্যাপক যে, তা সাধারণ মানুষের ধারণার বাইরে। যেমন, কোনো ব্যক্তি শুধু মোবাইল নিয়ে বাড়ি থেকে বেরোলেন। ক্ষমতাবানরা ইচ্ছা করলেই সে ব্যক্তি কোথায় এবং কী কথা বলছে তা জানতে পারেন। তবে এ অবস্থা এখন সীমিত অনুসন্ধানকারীদের মাঝে। তাদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তি অনুসন্ধান পর্যায়ে এবং তারা নিজেরাই অভিভূত যে, প্রযুক্তি এমন সুবিধা এনে দিতে পারে। এ সুবিধার জন্য প্রাচীনকাল থেকে মানুষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কেউ কেউ আধ্যাত্মিক ক্ষমতা লাভ করেছেন বলে দাবি করে অনেক অনুসারীর সৃষ্টি করতেন এবং এখনো করছেন।
বর্তমান বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও রাশিয়া এই ব্যবস্থা ব্যবহার করার ক্ষেত্রে শীর্ষে। এরা প্রতিনিয়ত নতুন প্রযুক্তি ও পন্থার উন্মেষ ঘটাচ্ছে। আগেই বলা হয়েছে, মোবাইলে ব্যবহৃত সিমে এমন ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে, যা দিয়ে এর প্রস্তুতকারী এবং তাদের সহযোগী রাষ্ট্রীয় বা গোষ্ঠীগত ক্ষমতাবানরা সব কিছু জানতে সক্ষম। এর কেউ কেউ দাবি করেছেন ‘এক-এগারো’র ঘটনার মূলে তারাই। পশ্চিমা প্রযুক্তিসমৃদ্ধ দেশগুলো তাদের সাম্রাজ্য বিস্তার ও সংরক্ষণে এই প্রযুক্তি বারবার ব্যবহার করেছে।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো- মুক্ত গণতান্ত্রিক দেশ বলে পরিচিত পশ্চিমা দেশগুলোতে এর ব্যবহার ব্যাপক। বিশেষ করে অভিবাসীদের বেলায় এর ব্যবহার ব্যাপক। প্রচার কর্মকাণ্ডকে বিশেষ সুবিধা দেয় এই প্রযুক্তি। ক্ষমতাবানরা ও রাষ্ট্র এ জন্য প্রচারমাধ্যমকে নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করে থাকে প্রকাশ্যে বা পরোক্ষভাবে। তাদের প্রধান লক্ষ্য থাকে সত্য ও সঠিক তথ্য যেন নিজেদের স্বার্থকে ব্যাহত না করে। প্রয়োজনে তারা তা বিকৃত করে জনগণের কাছে পৌঁছিয়ে দেন। রাজনীতিতে এর প্রয়োগ দেখা যায় ব্যাপকভাবে।
এখন এর প্রয়োগ হচ্ছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে। যেখানে বা যে দেশে এর ব্যবহার চলছে, সেখানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে জনগণের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা বা অধিকার বলে কিছু নেই। এর মাঝে ‘উন্নত’ দেশ বলে পরিচিত দেশগুলোতে এটা ব্যাপক। যেমন সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ঘোষণা করেছে- ২০২০ সালের মধ্যে প্রতিটি মানুষের তথ্য তাদের জানতে হবে। এ জন্য ৮৬ বিলিয়ন ডলারের বাজেট প্রকাশ করা হয়েছে। শুধু কল্পনাই করা যায় এর ব্যাপকতা। এ ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণের নামে নানা সংস্থারও সৃষ্টি হচ্ছে; যেমন আইএসএস। এটা নির্মূল করার নামে ইরাক-আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যে যে হত্যাকাণ্ড-সঙ্ঘাত-সংঘর্ষ চলছে, তা অবিশ্বাস্য। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে গত দেড় যুগ ধরে যে হত্যাকাণ্ড চলছে, তার পরও গণতন্ত্রের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। এমনকি কোনো কোনো দেশে নির্বাচনের পরই এমন কর্মকাণ্ড শুরু হয়ে যায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে।
এর সুযোগ নিচ্ছে পশ্চিমা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো। তারা প্রতিদিন খবরদারির ব্যবস্থা তৈরি করে তা সব অগণতান্ত্রিক দেশে ছড়িয়ে দিচ্ছে, এসব ব্যবহার করছে। ফলে প্রতিবাদকে সহজেই নস্যাৎ করে দিতে পারছে। এরা ক্ষমতায় আসীনও হচ্ছে। কখনো কখনো বিচারব্যবস্থাও এদের সামনে অসহায়। যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি) এফবিআই (ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন) প্রধানত অসুন্ধানের জন্য দায়ী থাকলেও তারা প্রায়ই শক্তি বা এমন প্রযুক্তিসমৃদ্ধ ব্যবস্থা ব্যবহার করে, যার সামনে সাধারণ মানুষ কোনো বিচার পায় না বলে অনেক অনুসন্ধানে এসেছে। যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রযুক্তিসমৃদ্ধ কৌশল বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ অনুসরণ করছে; বিশেষ করে যে দেশগুলো স্বৈরশাসনের অধীনে।
তাই খবরদারির সব ব্যবস্থাকে প্রায়ই ‘স্বাধীনতাবিরোধী অস্ত্র’ বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। স্বৈরশাসিত দেশগুলোতে এগুলো ক্ষমতাবানদের অত্যন্ত প্রিয়। এর ভয়াবহতার এক চমৎকার চিত্র সর্বপ্রথম আঁকেন এডওয়ার্ড স্নোডেন ২০১৩ সালে তার এক লেখায়। এই লেখা স্বাভাবিকভাবেই সারা বিশ্বের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক সহায়ক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিখ্যাত প্রাইভেট ইন্টারন্যাশনাল তাদের ২০০৭ সালের এক নিরীক্ষা চালায় ৪৭টি দেশে। তারা দেখতে পায়, প্রতিটি দেশেই সরকার ক্রমান্বয়ে আড়িপাতা বৃদ্ধি করে চলেছে। আমেরিকান সিভিল লিবার্টিজ ইউনিয়ন (এসিএলইউ) ২০০৭ সেপ্টেম্বর তাদের প্রথম রিপোর্টে বলেছিল, ‘আমরা এখন সম্ভবত খবরদারি সমাজে চলে যাচ্ছি।’ এরপর সাম্প্রতিক রিপোর্টে তারা বলেছে, ‘এই খবরদারির সীমানা সাধারণ মানুষের নেই।’
‘রিপোর্টার্স উইদআউট বর্ডার’ বলে বিখ্যাত অনুসন্ধানী সংস্থা তাদের প্রথম রিপোর্টটি ২০১৩ সালে প্রকাশ করে। তারা দেখতে পায়, ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ সব দেশেই হচ্ছে। তবে চীনসহ পাঁচটি দেশ এর নেতৃত্বে। এই খবরদারি শুধু টেলিফোনে আড়িপাতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয় বলে তারা উল্লেখ করেছে। তাদের প্রযুক্তির নাম ডিপ প্যাকেট টেকনোলজি, যা দিয়ে সব আইপি ঠিকানা অতি সহজেই নির্ণয় করা যায়। চীনের এই আড়িপাতা প্রযুক্তিগুলোর নাম দেয়া হয়েছে ‘গ্রেট ফায়ার ওয়াল অব চায়না’। বিশেষ কোনো ইন্টারনেটভিত্তিক বা টেলিফোনভিত্তিক কথাবার্তা এই প্রযুক্তিকে এড়িয়ে চলতে পারে না। তারা ইচ্ছা করলেই যেকোনো মেসেজ প্রণেতার সব তথ্য এক নিমেষেই জেনে যেতে পারে। যেমন, বিখ্যাত স্কাইপি ইন্টারনেট প্লাটফর্মকে গভীরভাবে অবলোকন করা হয় ওপেননেট ইনিশিয়েটিভ (ওএনআই) চালু করা হয়েছিল বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ইন্টারনেট কেমন করে ব্যবহার করছে তা দেখার জন্য। তারা দেখতে পায় সরকারি গভীর অবলোকন। ফলে তারা ২০১৪ সালে তাদের কর্মকাণ্ডের উপসংহার টানে এ কথা বলে- সব তথ্য সরকারি নিয়ন্ত্রণে আছে। তবে তাদের এই রিপোর্টের তথ্য সবসময় পাওয়া যাবে বলে ঘোষণা করে।
আসলে আন্তর্জাতিক ও ব্যক্তিগত তথ্য আদান-প্রদানে ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা সারা বিশ্বের মানুষকে আকৃষ্ট করে। সরকারগুলোও চাইছিল এমন একটি স্রোত যেখান থেকে বেশির ভাগ তথ্য পাওয়া যাবে। তাই তারা নানা প্রযুক্তি নির্মাণে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বলাবাহুল্য, চীন-রাশিয়া-আমেরিকা-ব্রিটেনসহ প্রযুক্তিসমৃদ্ধ সব দেশ এই নির্মাণের দৌড়ে রয়েছে। যারা যতখানি সাফল্য অর্জন করতে পেরেছে, তারা ততখানি নিয়ন্ত্রণের অধিকারী।
তবে সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো, এই প্রযুক্তি সন্ত্রাসেরও অন্যতম বাহন হয়ে পড়েছে। সন্ত্রাসের ব্যাপকতা সৃষ্টি করেছে এই প্রযুক্তি। আর ঢাকা পড়ে যাচ্ছে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত অধিকার। জাতিসঙ্ঘে মানবাধিকার নিশ্চিত করার জন্য নানা আইন এবং নীতি এখন এই প্রযুক্তির কারণে যেমন সফল প্রয়োগ করা সম্ভব, ঠিক একইভাবে সেসব আইন এড়িয়ে চলাও সম্ভব হচ্ছে।
প্রযুক্তি যেমন সাধারণ মানুষের জীবনধারাকে সুন্দরভাবে উপভোগ করার সুযোগ দিয়েছে, এটা আবার জীবনের ধারাকে ব্যাহত করছে। তাই এ জন্য সবার আগে প্রয়োজন, সতর্কতা। কারণ প্রযুক্তিকে আর এড়িয়ে চলা সম্ভব নয়। এটাও সত্য, প্রযুক্তি নিজে নিজে উদ্ভূত হয়নি। মানুষ এটা তৈরি করেছে। কিন্তু এর ব্যবহার করতে গিয়ে মানুষ একে নিয়ন্ত্রণ করতে ভুলে গেছে। এখনই সতর্ক না হলে হয়তোবা সেই কথিত মহাধ্বংস আসবে এই প্রযুক্তির মাঝ দিয়েই।