দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকে (অক্টোবর-ডিসেম্বর) ৩ দশমিক ৭৮ শতাংশে নেমে আসে। তবে নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে অর্থাৎ অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশিত ছিল। যদিও এ প্রান্তিকের প্রথম দুই মাসের প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে দেশের ব্যাংক খাতের প্রায় সব মাধ্যমেই কমে এসেছে অর্থের লেনদেন। স্থিতিশীল হয়নি তারল্য পরিস্থিতিও। গত তিন মাস মূল্যস্ফীতির হারও ছিল সাড়ে ৯ শতাংশের ওপর। মার্চে আবার বেড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতিও। এসব লক্ষণ বিবেচনায় অর্থবছরের তৃতীয় প্রান্তিকেও দেশের অর্থনীতির শ্লথতা কাটেনি বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উচ্চ দ্রব্যমূল্যের কারণে ভোগ কমিয়ে দিয়েছেন ভোক্তা। ফলে চাহিদা কমায় অর্থনীতিতে মন্দা ভাব বিরাজ করছে। তাছাড়া নির্বাচন-পরবর্তী সময়েও ডলার সংকট, মূল্যস্ফীতি এবং আর্থিক খাতের উন্নতি হয়নি। এখনো অনিশ্চয়তায় অর্থনৈতিক এজেন্টরা। তাই বিনিয়োগ না বাড়ায় গতি পায়নি দেশের অর্থনীতি। এসব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে উঠতে আরো দুই-এক বছর সময় লেগে যেতে পারে বলেও মনে করছেন তারা।
বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট অর্থনৈতিক স্থবিরতার প্রধান কারণ। নির্বাচনের পরও এসব সমস্যার কোনো উন্নতি হয়নি। বরং আমদানি নিয়ন্ত্রণ এবং ডলার সংকটে শিল্প কার্যক্রম কমে গেছে। অথচ শিল্পই ছিল প্রবৃদ্ধির চালিকাশক্তি। তাই দ্বিতীয় প্রান্তিকের মতো তৃতীয় প্রান্তিকেও প্রবৃদ্ধি কমে আসবে। আর মূল্যস্ফীতির কারণে সাধারণ মানুষের প্রকৃত মজুরিও কমে গেছে। ১২ মাস ধরে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে রয়েছে। এসব সমস্যার সমাধান না হলে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে কীভাবে?’
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, দেশের মোট ব্যাংক লেনদেনের প্রায় অর্ধেক এখনো চেকনির্ভর। গত জানুয়ারিতে ব্যাংকগুলোয় এর মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ২ লাখ ৭ হাজার ৫৬৩ কোটি টাকা। কিন্তু ফেব্রুয়ারিতে তা কমে ১ লাখ ৮১ হাজার ৯৮ কোটি টাকায় নেমেছে। তবে চেকের মাধ্যমে কমলে ইএফটির মাধ্যমে লেনদেন বাড়ার কথা। অথচ এ মাধ্যমেও লেনদেন কমেছে ৬ শতাংশের বেশি। জানুয়ারিতে ইএফটির মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ৮২ হাজার ২৮৫ কোটি টাকার। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৭৬ হাজার ৮৯৭ কোটি টাকায়।
ব্যাংক লেনদেনের একটি বড় অংশই হয় মধ্যবিত্ত ও চাকরিজীবীদের মাধ্যমে। কিন্তু ক্রয়ক্ষমতা কমে আসায় তারা কোনো রকম দিন কাটাচ্ছেন বলে মনে করছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতি ও বিনিময় হারের দোদুল্যমান অবস্থা বিরাজ করছে। দেশের অর্থনীতি বেশকিছু চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। বহু বছর ধরে বিনিয়োগ ঘাটতি। তাই মানুষের কর্মসংস্থান ও লেনদেন বাড়ছে না। আর বিনিয়োগ না বাড়লে অর্থনীতি গতি পায় না। আমদানি নিয়ন্ত্রণের ফলে মূলধনি যন্ত্রপাতি এবং কাঁচামালও কম আসছে। তাই শিগগিরই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না। অর্থনীতিতে গতি ফিরতে আরো দুই-এক বছর সময় লাগতে পারে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি প্রায় ৩৭ শতাংশ লেনদেন কমেছে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে। জানুয়ারিতে এ মাধ্যমে লেনদেন হয় ২ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে কার্ডভিত্তিক এ লেনদেন নেমে আসে ১ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকায়। লেনদেন কমেছে ডেবিট কার্ডেও।
অর্থনৈতিক শ্লথতা তথা প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার এ প্রবণতাটি বহাল থাকবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নির্বাচনের পরও স্বাভাবিক ব্যবসা পরিবেশের জন্য কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আসেনি। সুদহার বাড়ায় বিনিয়োগ কমেছে। ফলে কর্মসংস্থান ও উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে। সরবরাহ কমায় মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আবার সরকারের ব্যাংক মার্জারের কার্যক্রম আমানতকারীদের মধ্যে শঙ্কা তৈরি করেছে। তারা বেসরকারি ব্যাংক থেকে টাকা উঠিয়ে নিচ্ছে। এতে ব্যাংকের তারল্য সংকট আরো বাড়ছে। ব্যবসাবান্ধব নীতি গ্রহণ না করে বরং খেলাপিদের নানা সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এসব কাজ অর্থনীতিতে ভালো সংকেত দেয় না। সরকারের মেগা প্রকল্পে কাজের গতিও কমেছে। সব মিলিয়ে আগামী প্রান্তিকেও প্রবৃদ্ধি কম হতে পারে।’
দেশে মূল্যস্ফীতির পারদ চড়ছে গত বছর থেকেই। গত ১২ মাসে মূল্যস্ফীতির গড় হার ছিল ৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য অনুযায়ী, মার্চে দেশের গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ। খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার ৯ দশমিক ৮৭ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। উচ্চ এ মূল্যস্ফীতির কারণেই অভ্যন্তরীণ বাজারে সব ধরনের পণ্যের ভোগ কমে গেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
নির্বাচন হলেও অর্থনৈতিক এজেন্টদের মধ্যে এখনো অনিশ্চয়তা কাটেনি বলে মনে করছেন সাবেক সচিব ও অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক এজেন্টরা টাকা ধরে রাখছে। আবার ঈদ ছাড়া রেমিট্যান্সও বাড়ছে না।’
কভিড-পরবর্তী সময়ে দেশের ব্যাংক খাতে ইন্টারনেট ব্যাংকিং বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। তবে গত ফেব্রুয়ারিতে এ মাধ্যমেও লেনদেন কমেছে ২ দশমিক ৪৮ শতাংশ। বছরের এ দ্বিতীয় মাসে ইন্টারনেট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ৯৩ হাজার ৮২২ কোটি টাকা। জানুয়ারিতে যা ছিল ৯৬ হাজার ২০৫ কোটি। শুধু এমএফএসে লেনদেন নেতিবাচক ধারায় যায়নি। এ মাধ্যমে লেনদেন বেড়েছে দশমিক ৪৯ শতাংশ। তবে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের লেনদেন কমেছে ৬ শতাংশের বেশি। গত জানুয়ারিতে এজেন্টদের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছিল ৭৩ হাজার ৯৮৩ কোটি টাকা। ফেব্রুয়ারিতে তা কমে দাঁড়ায় ৬৯ হাজার ২৯৫ কোটি টাকায়।
এ বিষয়ে সাবেক মন্ত্রী ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এমএ মান্নান এমপি বণিক বার্তাকে বলেন, ‘সার্বিক অর্থনীতিতে মন্দা ভাব বা সংকোচনমূলক অবস্থা বিরাজ করছে। এটার মূল কারণ দ্রব্যমূল্যের চাপে ভোক্তারা ভোগ কমিয়েছে, ফলে চাহিদা বাড়ছে না। এতে পণ্যও সেভাবে আসছে না। তবে আগামীতে বৈশ্বিক কোনো বড় ধরনের সমস্যা না হলে এপ্রিল-মে মাসে অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াবে। কারণ মাঠে বোরোর ভালো পরিমাণ ফসল রয়েছে। ঈদের সময় রেমিট্যান্সও বাড়বে। আর দুই-এক প্রান্তিকে প্রবৃদ্ধি একটু কম-বেশি হতেই পারে। এটা আপ-ডাউন করবে এটাই স্বাভাবিক।’
Bonik barta