আমদানি খরচের তুলনায় রফতানি ও প্রবাসী আয় না বাড়ায় কমছে বাংলাদেশ ব্যাংকের বিদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ। টাকার অব্যাহত মূল্যপতন ঠেকাতে তাই প্রতিনিয়ত রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করছে সরকার। বাজারের উচ্চ মূল্যস্ফীতিও নিয়ন্ত্রণের বাইরে। দেশের এ অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ৫৪ হাজার কোটি টাকার ‘মেট্রোরেলের লাইন-৫ (দক্ষিণ)’-এর মতো মেগা প্রকল্পটি গ্রহণের যৌক্তিকতা নিয়ে কাজ করছে পরিকল্পনা কমিশন। সম্প্রতি এ বিষয়ে কমিশন একটি পর্যালোচনা সভাও করেছে। রিজার্ভের বর্তমান অবস্থা, টাকার বিপরীতে ডলারের উত্থান, বিদেশী ঋণ পরিশোধের আসন্ন চাপ এবং সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রকল্পটি দুই-এক বছরের জন্য পিছিয়ে দেয়া যায় কিনা সে বিষয়ে আলোচনা হয় বলে বৈঠক সূত্রে জানা গেছে।
তাড়াহুড়ো করে এত বড় প্রকল্প নেয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরাও। আগামী অর্থবছর থেকে বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে। ফলে বড় প্রকল্পের জন্য নতুন করে নেয়া ঋণ অর্থনীতির ওপর বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে বলে তাদের আশঙ্কা। তবে ঋণের ক্ষেত্রে সহজ শর্ত এবং তা পরিশোধে দীর্ঘ সময় নিশ্চিত করা গেলে প্রকল্পটি হাতে নেয়া যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন কেউ কেউ।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘তাড়াহুড়ো করে বড় প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হলে অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। কেননা আগামী অর্থবছর থেকে বার্ষিক বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৪ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।’ তখন এসব বড় প্রকল্প বাড়তি চাপ সৃষ্টি করবে বলে সতর্ক করেন এ অর্থনীতিবিদ।
পাতাল ও উড়াল মিলিয়ে মোট ১৭ দশমিক ২০ কিলোমিটার দীর্ঘ হবে এমআরটি লাইন-৫ (সাউদার্ন রুট)। এর মধ্যে রাজধানীর গাবতলী থেকে আফতাবনগর পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার পাতাল ও আফতাবনগর থেকে দাশেরকান্দি পর্যন্ত চার কিলোমিটার হবে উড়ালপথ। ২০২৪ সালের প্রথম দিকে কাজ শুরু হয়ে ২০৩০ সালের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করার পরিকল্পনা সরকারের। এ রুট নির্মাণে ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৪ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা। এর মধ্যে সরকারি অর্থায়ন ১৫ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা। ৩৯ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা নেয়া হবে প্রকল্প সহায়তা হিসেবে। এ প্রকল্পে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকে ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার বা সাড়ে ২৭ হাজার কোটি টাকা এবং বাকি ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা কোরিয়ান এক্সিম ব্যাংক থেকে নেয়া হবে।
বৈদেশিক ঋণের বিষয়ে সহজ শর্ত এবং পরিশোধে দীর্ঘ সময় নিশ্চিত করার কথা বলছেন অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে অনেক সময় লেগে যায়। তাই আলোচনার মাধ্যমে ঋণের সহজ শর্ত এবং ঋণ পরিশোধের দীর্ঘ সময় নিশ্চিত করতে হবে।’
প্রকল্পসংশ্লিষ্টরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের কারণে মেট্রোরেলের এ পথের নির্মাণকাজ শুরু হতে কিছুটা দেরি হলেও এখনো তা সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। প্রকল্পটির নকশা তৈরিতে এরই মধ্যে সরকার অনেক টাকা ব্যয় করেছে। জানুয়ারিতে ঠিকাদার বাছাই করতে অগ্রিম টেন্ডারিংয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। জমি অধিগ্রহণের জন্য সব নকশাও ঠিক করা হয়েছে।
সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাওয়া প্রকল্পটি থেকে সরকার এ মুহূর্তে পিছিয়ে আসবে না বলেই মনে করছেন প্রকল্প পরিচালক মোহাম্মদ আব্দুল ওহাব। তিনি বলেন, ‘একটি প্রকল্পের মাধ্যমে এরই মধ্যে সম্ভাব্যতা যাচাই এবং পূর্ণাঙ্গ নকশা তৈরি করা হয়েছে। অনেক টাকা ব্যয় করা হয়েছে এতে। তাই নতুন করে প্রকল্পটি শুরু হলে অর্থনৈতিক বিষয়গুলো হয়তো চিন্তা করা হতো। এখন মাঝপথে এসে কাজটি বন্ধ করলে বরং আরো ক্ষতি হবে।’
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, বেশ কয়েকবার পিছিয়ে দেয়ার পর ১১ ডিসেম্বর এমআরটি লাইন-৫ (সাউদার্ন রুট) প্রকল্পটির পর্যালোচনা সভা হয়। এতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি), সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ, মেট্রোরেল এবং পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে প্রকল্পটির বিষয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন তারা। এর মধ্যে পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়। অন্যদিকে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা তাদের কার্যক্রমের অগ্রগতি তুলে ধরে বলেন, ‘মাঝপথে এসে এর কাজ বন্ধ করে দিলে লাভের চেয়ে সরকারের ক্ষতিই বেশি হবে।’
বৈঠকে উপস্থিত থাকা কমপক্ষে ১০ কর্মকর্তার সঙ্গে বণিক বার্তার এ প্রতিবেদকের কথা হয়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে একাধিক কর্মকর্তা জানান, ২০১৫ সালের দিকে যখন প্রকল্পটি প্রণয়ন করা হয় তখন দেশের রিজার্ভ ছিল ৩৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। সরকারের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী চলতি অর্থবছরে রিজার্ভ ৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি থাকার প্রত্যাশা করা হয়েছিল। কিন্তু বিভিন্ন সংকটে তা এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গেছে। এ পরিস্থিতিতে প্রকল্পটিতে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ করা ঠিক হবে কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে সভায়। কারণ এটি থেকে সরাসরি ডলার আয় না হলেও ঋণ পরিশোধ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। তাছাড়া সরকারি অর্থায়নের অংশটিও ঋণ আকারে দেয়া হবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডকে (ডিএমটিসিএল)। অলাভজনক এ প্রকল্পের ঋণ মেট্রো কর্তৃপক্ষ কীভাবে পরিশোধ করবে, সে বিষয়েও সুস্পষ্ট গাইডলাইনের বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে।
তাছাড়া প্রকল্পটির ৭০ শতাংশের বেশি অর্থ ব্যয় হবে যন্ত্রপাতি আমদানিতে। এর বাইরে পরামর্শক ব্যয় রয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকার মতো। বিদেশী পরামর্শকদের সে টাকাও ডলারেই পরিশোধ করতে হবে। তাই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে বৈদেশিক ঋণের বাইরেও ডলারের চাহিদা মেটাতে সরকারকে রিজার্ভে হাত দিতে হবে। এর মধ্যে আবার আগামী বছর থেকে বিদেশী ঋণ পরিশোধের একটি চাপ শুরু হবে। অন্যদিকে ডলারের দাম বাড়লে প্রকল্প ব্যয় আরো বেড়ে যাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তাই মেট্রোরেলের চলমান দুটি প্রকল্প শেষ হওয়ার পর নতুন প্রকল্পটি নেয়া যায় কিনা তা ভেবে দেখতে বলা হয় পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষ থেকে। এ নিয়ে আরো কয়েক দফা বৈঠক হতে পারে বলেও জানাচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
নিজস্ব অর্থ দিয়ে যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হলে বড় চাপ তৈরির আশঙ্কা করছেন বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনও। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘ডলার সংকটে নিজস্ব অর্থ দিয়ে মালামাল আমদানি করা যাবে না। সেক্ষেত্রে প্রকল্পটি পিছিয়ে দেয়া ছাড়া উপায় নেই। কারণ প্রকল্পের অনুমোদন দিয়ে কাজ না এগোলে ব্যয় বাড়তে থাকবে।’ তবে গ্রহণযোগ্য শর্তের মাধ্যমে যথেষ্ট বিদেশী ঋণ থাকলে সমস্যা দেখছেন না এ অর্থনীতিবিদ।
এদিকে প্রকল্প প্রস্তাবের তথ্যমতে, সড়ক পরিবহন এবং মহাসড়ক বিভাগের জন্য চলতি অর্থবছরে এডিপিতে বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৩৪ হাজার কোটি টাকা। যদিও এখন পর্যন্ত পাস হওয়া প্রকল্পের জন্য প্রয়োজন ৩৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ এ বিভাগে মধ্যমেয়াদি বাজেট কাঠামোর চেয়ে বাড়তি ৫ হাজার ১৭৫ কোটি টাকার চাহিদা তৈরি হয়েছে। ফলে এমআরটি লাইন-৫-এর (সাউদার্ন রুট) কাজ শুরু হলে চলমান অন্য প্রকল্পগুলো পর্যাপ্ত বরাদ্দ পাবে না বলে মনে করছেন পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা। মধ্যবর্তী ব্যয়সীমা না মানার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে এ বিষয়ে ‘কথা বলার এখতিয়ার নেই’ জানিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি অর্থ বিভাগের ব্যয় ব্যবস্থাপনা শাখার একজন উপসচিব।
এরআরটি-৫ প্রকল্প পরিচালনার সঙ্গে যুক্ত এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পরিকল্পনা কমিশন থেকে কিছু পর্যবেক্ষণ দেয়া হয়েছে। তারা কিছু বিষয় জানতে চেয়েছে। কিছু বিষয় রিভিউ করতে বলেছে।’
প্রকল্পের কারণে রিজার্ভে চাপ তৈরি হবে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এমনটা হলে তো জ্বালানি আমদানিও বন্ধ থাকত। আর ডলার আয় না হলেও প্রকল্পটির মাধ্যমে গাড়িতে ব্যবহৃত তেলের আমদানি হ্রাস পেয়ে সরকারের ডলার সাশ্রয় হবে। এডিবির সমীক্ষাও বলছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে বছরে ৪১ দশমিক ২২ হাজার টন জ্বালানি সাশ্রয় হবে। আর প্রকল্প এলাকার রাস্তায় প্রায় ১ হাজার ৪৯টি গাড়ির চলাচল কমে যাবে।’
ঋণ পরিশোধের বিষয়ে ওই কর্মকর্তার মত, এ বিষয়টি আসবে ১০ বছর পর। তখন ঋণের টাকা থেকেই সুদ পরিশোধ হয়ে যাবে। ২০২৮ সালে যখন মেট্রোরেল ১৮ ঘণ্টা চলবে তখন পরিচালনা ভর্তুকি কমে আসবে। অপারেশন ব্যয়ের গ্যাপ কমে এলে ঋণ পরিশোধও করা যাবে।
মেট্রোরেলের কাজটি এখনই না করলে পরবর্তী সময়ে বিদেশী ঋণ পাওয়ার নিশ্চয়তা থাকবে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সচিব ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের নকশা ও সম্ভাব্যতা যাচাইসহ অনেক কাজ এগিয়ে গেছে। তাই আমরা প্রকল্পটি চলমান রাখার চিন্তা করছি। ইআরডি থেকে অর্থায়ন পাওয়ার বিষয়টিও প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত করা হয়েছে। তাই সামনে ডিটেইল ডিজাইন এবং প্রকল্প প্রস্তাব বিশ্লেষণ করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
অন্য প্রকল্পের অর্থায়ন কাটছাঁট করে হলেও এ প্রকল্প অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের কথা বলছেন পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘অর্থনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। আমরা ঘুরে দাঁড়াচ্ছি। মূল্যস্ফীতি কমছে। চালের বাজার স্থিতিশীল আছে। বাজারে শীতের শাকসবজি আসছে। আশপাশের অনেক দেশ থেকে আমরা এখন ভালো আছি। কাজেই প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো সমস্যা হবে না।’
বনিক বার্তা