ফারুক ওয়াসিফ: আমরা নতুন বছরে পা রাখলাম। পেছন ফিরে ২০২৩ সালের দিকে তাকালে এ বছরটিকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন? বাংলাদেশের অর্থনৈতিক জীবন কেমন কাটল?
সমকাল: সেগুলো কী?
হোসেন জিল্লুর: বৈশ্বিক সংকটে অর্থনীতির ঝুঁকির কথা বললাম। আরেকটা হলো, গোষ্ঠীস্বার্থে দুর্নীতিগ্রস্ত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা। এটাকেও প্রতিনিয়ত মোকাবিলা করে এগোতে হচ্ছে। যাদের সুযোগটা দরকার, তারা পাবে না। পাবে ক্ষমতার সঙ্গে জড়িতরা। সে জন্য বোঝা আরও বাড়বে। যাতায়াত খরচ, বাসা ভাড়া, স্বাস্থ্য, শিক্ষার খরচ যা-ই বলি, বোঝা কিন্তু কমছে না; বাড়ছে। দুর্নীতিও আমাদের জন্য এক ধরনের বোঝা। চাঁদা, বখরা, হয়রানি ইত্যাদিও এর অংশ। গোষ্ঠীস্বার্থ এবং অব্যবস্থাপনা না থাকলে আমরা যে কোনো ঝুঁকি মোকাবিলা করে অন্য স্তরে চলে যেতে পারতাম।
সমকাল: আপনি বৈশ্বিক ঝুঁকির কথা বলছিলেন। ইউক্রেন যুদ্ধ কিংবা কভিডের পর বিশ্ববাজারে তেল ও খাদ্যদ্রব্যের দাম কমলেও বাংলাদেশে উল্টো চিত্র দেখা গেল। এখানে এমন কোনো পণ্য নেই, যেগুলোর দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি হয়নি। এটা কি স্বাভাবিক ঘটনা, নাকি উদ্দেশ্যমূলকভাবে কোনো গোষ্ঠীকে লাভবান করা?
হোসেন জিল্লুর: আসলে সুনির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে লাভবান করার জন্যই এমনটা হচ্ছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ে অনেক নাটক দেখেছি। সর্বোচ্চ দায়িত্বপ্রাপ্ত যারা, তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ে এমন সব ব্যাখ্যা দেন তাতে বোঝা যায়, তারা বিষয়টি নিয়ে তেমন বিব্রত নন। ২০২৩ সালে সবচেয়ে দুঃখজনক যে ঘটনা দেখলাম– যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত, তারা এগুলোকে সমস্যা হিসেবে দেখছেন না। লিপস্টিকের বিক্রি বেড়ে যাওয়া নিয়ে একজন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী সিদ্ধান্ত টেনে বলেছেন যে, মানুষের অবস্থার অনেক উন্নতি হয়েছে। এ অবস্থায় আমাদের মতো অর্থনীতিবিদের আসলে বেকার হয়ে যাওয়াই ভালো। কারণ যারা অর্থনীতি চালাচ্ছেন, তাদের মাথায় অর্থনীতির যে সূচকগুলো কাজ করছে, সেগুলো অর্থনীতির সঙ্গে সংযুক্ত নয়। বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বিব্রতকর বিষয় হলো, ক্ষমতায় যারা আছেন, তারা সার্বিকভাবে বিষয়টি যেভাবে মূল্যায়ন করছেন এবং সাধারণ মানুষ যেভাবে দৈনন্দিন জীবনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তারা কিন্তু ধরেই নিয়েছেন, এটা এভাবেই হবে এবং এটাই ঠিক। তারা অন্য কোনো বিবেচনা মাথায় নিচ্ছেন না।
সমকাল: লুণ্ঠনজীবীরা ছাড়া সব শ্রেণি-পেশার মানুষই সংকটে আছে। এই সংকট মোকাবিলায় সরকারের অর্থনৈতিক কৌশলকে আপনি কীভাবে ব্যাখ্যা করবেন?
হোসেন জিল্লুর: সম্প্রতি বিবিএসের জরিপে পারিবারিক আয়-ব্যয়ের একটা হিসাব বেরিয়েছে। সেখানকার একটি তথ্য আমার কাছে চমকপ্রদ মনে হয়েছে। ২০১৬ থেকে ২০২২ সালের হিসাবের মধ্যে একটা টেবিল ছিল আয়ের খাত। মজুরি এবং বেতনের ওই খাতটা শুধু দরিদ্ররা নয়, মধ্যবিত্তের জন্যও সমান। দেখা গেছে, ছয় বছরের মধ্যে এই খাতে আয় ১০ শতাংশ কমেছে। বিবিএসের এই জরিপে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ৫ শতাংশ ধনীর হাতেই ৩০ শতাংশ আয়। ১০ শতাংশ পরিবারের হাতে ৪০ শতাংশ এবং ২০ শতাংশ পরিবারের হাতে ৫৫ শতাংশ আয়। ৫ শতাংশ পরিবারের ৩০ শতাংশ আয়, আর নিচের ৫০ শতাংশ পরিবারের আয় ১৮ শতাংশ। তার মানে, আমরা প্রবৃদ্ধির যে কৌশলে এগোচ্ছি, সেটাও সাধারণ মানুষের জন্য ঝুঁকি। কারণ ওই কৌশলে কার্যকর কর্মসংস্থান ও ন্যায্য মজুরির বিষয়কে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। চা শ্রমিকদের কথা বলি বা গার্মেন্ট শ্রমিকদের কথা বলি– অন্যত্রও একই অবস্থা। তার মানে সরকারের প্রবৃদ্ধির কৌশল অন্তর্ভুক্তিমূলক অথর্নীতি থেকে বহু দূরে। এখানে কর্মসংস্থান এবং ন্যায্য মজুরিকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে না। এই প্রবণতাও আমাদের এক ধরনের বোঝা। উৎপাদনশীল শ্রমিক হওয়ার শর্তগুলো অর্থাৎ শিক্ষার খরচ কমানো, আবাসন খরচ কমানো, যাতায়াত খরচ ইত্যাদি যে কমানো দরকার, সেগুলো সরকারের অগ্রাধিকারে নেই।
সমকাল: এই বৈষম্য কতটা স্বাভাবিক?
হোসেন জিল্লুর: এটা অস্বাভাবিক। একটা পর্যায় পর্যন্ত বৈষম্য মেনে নেওয়া যায়। বেশি পরিশ্রমের কারণে কিংবা বেশি উদ্ভাবনী শক্তি বা বাজার ভালো বোঝার কারণে কারও আয় ভালো হতে পারে। কিন্তু শুরুর ৫ শতাংশ পরিবারের আয়ের তুলনায় যে বৈষম্য দেখা যাচ্ছে, তা কখনও সৎ আয়ের ফলে সম্ভব নয়। আরেকটি বিষয় হলো, অর্থনৈতিক অনৈতিক সুযোগ। অর্থাৎ অর্থ পাচার। নির্বাচনী হলফনামা থেকে আমরা যেটা দেখেছি। এক মন্ত্রীর আয়ের উপাখ্যান প্রকাশ হলো। এগুলো বর্তমান সময়েরই চিত্র। যখন সার্বিকভাবে অথনীতি ঝুঁকির মুখে, তখন দুর্নীতি অন্য পর্যায়ে গেছে। যেন নিয়মটাই হয়েছে দুর্নীতির জন্য। আরেকটি বিষয় হলো, নিয়ম কাগজ-কলমে থাকলেও বাস্তবায়ন হচ্ছে না। যখন টিকে থাকার জন্য সাধারণ মানুষ প্রচণ্ড পরিশ্রম করছে, সেখানে আরেকটি ছোট গোষ্ঠী রাষ্টীয় সুযোগ-সুবিধা থাকার কারণে বিশাল সম্পদের অধিকারী হচ্ছে। অনেক জায়গায় রাষ্ট্রীয় অনেক সুযোগ-সুবিধা আছে; কিন্তু গুটিকতক সেই সুযোগ নিচ্ছে। আরেকটি হলো, সরাসরি লুণ্ঠন। যেমন চর দখলের মতো সরাসরি ব্যাংক দখল।
সমকাল: ২০২৪-এ যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেখানে তো তারাই ক্ষমতায় আসছেন। তারা যদি আসেন তবে এভাবেই কি চলবে?
হোসেন জিল্লুর: হ্যাঁ, এখন পর্যন্ত তেমনটাই ঘটতে যাচ্ছে। যা হোক, আমি তিনটি বিষয়ের কথা বলছিলাম যে, ঝুঁকি মোকাবিলা করে সাধারণ মানুষের টিকে থাকার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা। আরেকটি হচ্ছে গোষ্ঠীস্বার্থের অনুকূলে ক্ষমতার বলয়ে থেকে সুবিধা পাওয়ার ব্যবস্থাপনা। তবে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে যারা আছেন, তারা যেন সামাজিক সূচকগুলো একেবারে আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে না দেন। যারা আমলাতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছেন, তারা চোখ সম্পূর্ণ বন্ধ রাখলে সমস্যা। তাই তারা কিছুটা চোখ খুলে রাখেন। যার ফলে তারা ২০২৩ সালের প্রথম দিকে সিদ্ধান্ত নিলেন, আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেবেন। এর পরও সার্বিকভাবে মূল্যস্ফীতি কমলো না। আসলে তাদের উদ্দেশ্য মূল্যস্ফীতি কমানো ছিল না। ছিল ডলার সংকট মোকাবিলা করা। আমলাতান্ত্রিক দায়িত্বপ্রাপ্তরা অর্থনৈতিক অবস্থা যাতে ধসে না পড়ে, সে জন্য পদক্ষেপ নিতে গিয়ে বৃহত্তর অর্থনীতির কোনো ক্ষতি করলেন কিনা, খেয়াল করেন না।
আরেকভাবে অর্থনীতির চিন্তা করুন, আমাদের এখন বিনিয়োগ কোথায় আছে? বৃহৎ অবকাঠামোই শুধু বিনিয়োগের জায়গা নয়, মানবসম্পদ একটা বিনিয়োগের গুরুত্বপূর্ণ জায়গা, যেমন শিক্ষা খাত। কৌশলগত বিনিয়োগের কথা যদি বলি, সেটাও নেই। উৎপাদনশীল শ্রমে বিনিয়োগ দরকার। আমরা এখনও সস্তা শ্রমের অর্থনীতিতে আটকে থাকছি। আমাদের দেশীয় নীতিনির্ধারকরা সস্তা শ্রমের গার্মেন্টস সেক্টর ও সস্তা শ্রমের রেমিট্যান্স সেক্টর– এই দুটির বাইরে যেতে পারছেন না। কারণ তখন আমাদের বিনিয়োগের ধরন পাল্টাতে হবে। নতুন প্রবৃদ্ধির চালক খোঁজার যে বিষয় রয়েছে, সেটাও হচ্ছে না। বরং অর্থনৈতিক অবিচারই এই দেশের নীতি হয়ে গেছে।
সমকাল: তার মানে, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সংকট?
হোসেন জিল্লুর: আমাদের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার কথা বলি, শিক্ষার ব্যবস্থাপনা বলি, স্বাস্থ্যের ব্যবস্থাপনা বলি, সার্বিকভাবে বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা আমলাতান্ত্রিক। আগে তো ছিল ফাইলের লালফিতা। এখন ডিজিটাল যুগেও লালফিতার মানসিকতা সম্পূর্ণভাবে বহাল।
সমকাল: আমাদের যে পপুলেশন ডিভিডেন্ড ছিল, সেটা কাজে লাগাতে পারছি না। মধ্যম আয়ের অর্থনীতি হওয়ার পথে ছিলাম আমরা। এখন আপনি যে অবিচারের অর্থনীতির কথা বললেন, সেটা যদি চলমান থাকে তবে ভবিষ্যৎটা কী?
হোসেন জিল্লুর: অবিচারের অর্থনীতি অব্যাহত থাকার অবধারিত পরিণতি, যেটাকে আমরা বলি– মধ্যম আয়ের ট্র্যাপ। মানে আমরা এক ধরনের আয়ের মধ্যে ঝুলে থাকব। মধ্যম আয়ের ট্র্যাপের কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। সেখানে সম্ভাবনাময় জায়গায় যাওয়ার কথা বললেও কার্যকরভাবে যাওয়া যায় না। সেখানে বৈষম্য অনেক বেড়ে যায়; সেখানে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতিতে বিশেষ নজর থাকে না, বিশেষ করে কর্মসংস্থান ইত্যাদি অনানুষ্ঠানিক খাতেই চলতে থাকে। সেখানে আয় বাড়ার প্রবণতা ধীর হতে থাকে, বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পেতে থাকে, বৃহৎ অংশ অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতায় থাকে।
সমকাল: তার মানে সেখানে মধ্যবিত্তও থাকতে পারে?
হোসেন জিল্লুর: সেখানে মধ্যবিত্ত এমনকি অর্থনৈতিক নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে পড়া ধনীদের একটা অংশও থাকতে পারে। ২০২৩ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আমি একটি আর্টিকেল লিখেছিলাম, মধ্যম আয়ের স্বপ্ন দেখার যে সক্ষমতা আমরা অর্জন করেছি, সেখানে সবাই কৃতিত্বের দাবিদার। বর্তমান সরকারও দাবিদার; কিন্তু বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হচ্ছে মধ্যম আয়ের স্বপ্নের গণতন্ত্রায়ন করা। কিন্তু সেটা হয়নি। কারণ স্বপ্নটা একজন সবার হয়ে দেখলে হবে না, সবাইকে নিয়ে দেখতে হবে।
সমকাল: কিন্তু জবাবদিহি ছাড়া তা কীভাবে সম্ভব?
হোসেন জিল্লুর: তার জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার পরিবর্তন দরকার। জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় প্রত্যাবর্তন দরকার। এখন জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা নির্বাসনে আছে, তার প্রত্যাবর্তন জরুরি। সেটা হলেই অনেক কিছুর জট খুলতে থাকবে। এখন গণতন্ত্রায়নের অনুপস্থিতিতে কী হচ্ছে? তরুণরা নিজেদের ভবিষ্যৎ কোথায় রাখছে? তারা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে, দেশে নিজেদের ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছে না। তরুণ প্রজন্ম এখানে আস্থা পাচ্ছে না। মধ্যম আয়ের স্বপ্নের মধ্যে তিনটি উপাদান রাখতে হবে– সমৃদ্ধি, নিরাপত্তা ও সম্মান। কারণ এই ট্র্যাপের মধ্যে জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার অনুপস্থিতিতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বিনীত ও উচ্ছৃঙ্খল হয়ে ওঠে। সম্মানও নির্বাসনে যায়। কোনোমতে বেঁচেবর্তে থাকা, মুখ লুকিয়ে থাকার অবস্থা। সুতরাং সম্মান, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি– এই তিনটি মিলে স্বপ্নটা চিন্তা করতে হবে। জবাবদিহিমূলক রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনার অভাবে আমরা শুধু একপেশে সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখছি। সম্মানের স্বপ্নও দেখতে পাচ্ছি না, নিরাপত্তার স্বপ্নও দেখতে পাচ্ছি না। আমরা আটকে গেছি। এ কারণে আগামীতেও অবিচারের অর্থনীতি চলমান থাকার আশঙ্কা থেকে যায়।
সমকাল