অর্থনীতি প্রথম চার মাসে উন্নয়ন ব্যয় কমেছে ১০ হাজার কোটি টাকা

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর অপ্রয়োজনীয় উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থছাড় কমিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাবও পড়েছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতেও (এডিপি)। চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই-অক্টোবরে এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। এ সময় অর্থছাড়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা; যা ২০২৩-২৪ অর্থবছরের তুলনায় ৯ হাজার ৭১৪ কোটি ৯ লাখ টাকা কম। বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) তথ্যে এ চিত্র উঠে এসেছে

আইএমইডির কর্মকর্তারা জানান, জুলাই-আগস্টের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রভাবে এডিপি বাস্তবায়ন ব্যাহত হয়ে পড়ে। দেশি-বিদেশি অনেক প্রকল্পের ঠিকাদার প্রকল্প এলাকায় না থাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন থমকে যায়। এ ছাড়া নতুন করে এডিপি অর্থছাড়ও কম হয়েছে। সরকার শুধু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অর্থ ছাড় করছে। অন্যদিকে সরকার পাইপলাইনে থাকা প্রস্তাবিত প্রকল্পের পাশাপাশি চলমান প্রকল্পও নতুন করে পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এগুলোর মধ্যে চলমান অনেক প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাবও আটকে গেছে।

আইএমইডির তথ্য অনুসারে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের অক্টোবর মাসে উন্নয়ন ব্যয় হয়েছে ৮ হাজার ৭৬২ কোট ৮৭ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ১১ হাজার ৮২ কোটি ৭০ লাখ টাকা। অর্থাৎ ২০২৩ সালের অক্টোবর মাসের তুলনায় ২০২৪ সালে ২ হাজার ৩১৯ কোটি টাকা উন্নয়ন ব্যয় কমেছে।

পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাস জুলাই-অক্টোবরে গত ৮ অর্থবছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অর্থ ছাড় হয়েছে এবং গত এক যুগের মধ্যে সর্বনিম্ন এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে। কাটছাঁটের এই সময়েও বড় বরাদ্দ পেয়েছে এলজিইডি ও সড়ক বিভাগ। বরাবরের মতোই উন্নয়নে পিছিয়ে রয়েছে জনগুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাত।

আইএমইডির তথ্যমতে, গত চার মাসে এডিপি বাস্তবায়িত হয়েছে ৭ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর চেয়ে কম এডিপি বাস্তবায়নের তথ্য সংস্থাটির কাছের পাওয়া যায়নি। সেই হিসাবেই গত এক যুগে এত কম এডিপি বাস্তবায়িত হয়নি। এদিকে চার মাসে ২১ হাজার ৯৭৮ কোটি টাকা অর্থ ছাড় হয়েছে; যা ২০১৭-১৮ অর্থবছরের পর সর্বনিম্ন। গত অর্থবছরে ৩১ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা ছাড় হয়েছিল এই সময়ে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ছাড় হয়েছিল ৩২ হাজার ৩৫৮ কোটি টাকা।

পরিকল্পনা কমিশনের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, নানা কারণে উন্নয়ন প্রকল্পে অর্থছাড় কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। কোন প্রকল্প বেশি প্রয়োজনীয়, কোনটি কম, তা যাচাই-বাছাই চলছে। প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, দেশের অর্থনীতি সংকটের মধ্যে আছে। রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি হচ্ছে। ফলে সরকারকে ব্যয় কমাতে হবে। চলতি অর্থবছরের বাজেটে অপচয়মূলক ব্যয় কমানোর অনেক সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের সামনে খরচ কমানোর বড় জায়গা হচ্ছে এডিপি।

পরিকল্পনা কমিশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এডিপি বাস্তবায়ন বর্তমানে শুরুর পর্যায়ে রয়েছে। এ ক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বাদ দিয়ে এডিপি বড় ধরনের কাটছাঁট করলে তেমন কোনো অর্থের অপচয় হবে না। চলতি অর্থবছরে এডিপির আওতায় ১ হাজার ৩২৬টি প্রকল্প আছে। এসবের মধ্যে অনেকগুলো ২০২৩ সালে অন্তর্ভুক্ত হলেও এখন পর্যন্ত কোনো ব্যয় দেখা যায়নি।

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, রাজনৈতিক বা প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলো পুনরায় বিবেচনা করা উচিত। কারণ, সরকার আর্থিক সংকটে আছে, রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি রয়েছে। সরকারকে ব্যয় কমাতে হবে। ব্যয় কমানোর বড় জায়গা এডিপি। প্রকল্পের গুরুত্ব বিবেচনায় বরাদ্দ দিতে হবে। কারণ, এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন অনেক এগিয়েছে। যেসব মেগা প্রকল্পের অগ্রগতি ভালো, সেগুলো শেষ করা ভালো হবে। তবে যেসব মেগা প্রকল্পের কাজ শুরু হয়নি বা প্রাথমিক ধাপে আছে, সেগুলো বাদ দেওয়া ভালো হবে।

চলতি অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সবচেয়ে বেশি ৫ হাজার ২৮০ কোটি টাকা অর্থ খরচ করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। এরপর সর্বোচ্চ খরচ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ, ৩ হাজার ৫২০ কোটি টাকা। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ খরচ করেছে ১ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা খরচ করেছে ১ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা। ১ হাজার ৩৭৭ কোটি টাকা খরচ করেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। এক টাকাও খরচ করতে পারেনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন ও বিচার বিভাগ।

তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ এবং স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগের কাজের গতি বাড়েনি। বড় মন্ত্রণালয়ের মধ্যে সবচেয়ে কম খরচ করেছে এই দুটি বিভাগ। চার মাসে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ খরচ করেছে মাত্র ২ দশমিক ৪২ শতাংশ বা ২৬৯ কোটি টাকা। আর স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবারকল্যাণ বিভাগ খরচ করেছে মাত্র শূন্য দশমিক শূন্য ৪ শতাংশ বা ২ কোটি টাকা। এ ছাড়া কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ খরচ করেছে ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ আর মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগ খরচ করেছে ৬ দশমিক ৭৯ শতাংশ।

ajker patrika