অভিযানের মধ্যেও আসছে ইয়াবা
ইয়াবা চোরাচালানের জন্য আলোচিত শহর টেকনাফ। দামি মোটরসাইকেল আর প্রাইভেট কার নিয়ে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা দাপিয়ে বেড়াতেন এই পর্যটন শহর। তবে গত কয়েক দিনে উপজেলা সদর বেশ ফাঁকা। শুক্রবার ছুটির দিন হওয়ায় দোকানপাটগুলোও ছিল প্রায় বন্ধ। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মাদকবিরোধী সাঁড়াশি অভিযানের মধ্যেও থেমে নেই ইয়াবা চোরাচালান।
শুক্রবার বেলা ১১টায় পৌরসভার পুরাতন বাসস্টেশনে গেলে পানের দোকানদার নবী হোসেন বলেন, অবস্থা খুবই খারাপ, ভোরে এমপি বদির (আবদুর রহমান) বেয়াই আকতার কামাল ক্রসফায়ারে চলে গেছেন। ক্রসের ভয়ে সবাই পালাচ্ছেন, দোকানের বেচাকেনাও কমে গেছে।
পাশের ফল বিক্রেতা ফরহাদ আলম বলেন, ‘কিন্তু ইয়াবা ব্যবসা তো বন্ধ নাই। রোজার মাস বলে আখড়াগুলোতে লুকিয়ে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা।’
বাসস্টেশনের আশপাশের ১০-১২টি আখড়ায় প্রকাশ্যে বিক্রি হতো ইয়াবা, হেরোইন ও গাঁজা। গতকাল দুপুরে গিয়ে দেখা গেছে সব বন্ধ। তবে একটি আখড়ার মালিক বলেন, রোজার মাসে লোকজন আসে না। দিনের বেলায় বন্ধ থাকে, রাতে চলে লুকিয়ে ইয়াবা বিক্রি।
নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগর হয়ে টেকনাফের ৩৪টি পয়েন্ট দিয়ে ঢুকছে ইয়াবা। চলতি মে মাসে ২১ দিনে (৪-২৫ মে) শুধু টেকনাফ থেকে উদ্ধার হয়েছে ২৩ লাখ ১০ হাজার ইয়াবা। এর মধ্যে বিজিবি সাড়ে ৫ লাখ, কোস্টগার্ড সাড়ে ১৪ লাখ, পুলিশ ২ লাখ ৬০ হাজার, র্যাব ৩০ হাজার ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করেছে।
এর আগের (১ জানুয়ারি থেকে ৩ মে পর্যন্ত) সাড়ে চার মাসে টেকনাফ উপকূল থেকে উদ্ধার হয়েছে ১ কোটি ৬০ লাখ ৭৩ হাজার ২১৫ ইয়াবা বড়ি। এ সময় ১২৫ জন পাচারকারীকে আটক করা হলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তালিকাভুক্ত কোনো হোতাই ধরা পড়েনি।
‘ক্রসফায়ার’ আতঙ্ক
অনুসন্ধানে জানা গেছে, আখড়ায় কয়েক প্রকারের ইয়াবা বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ৬৫ টাকায়। মিয়ানমারে ইয়াবার দাম ৭ থেকে ১০ টাকা। তা টেকনাফে বিক্রি হয় ১৫ থেকে ২০ টাকায়। তবে উন্নত মানের হালকা গোলাপি রঙের আর-৭ ইয়াবার দাম একটু বেশি। আর-৭ ইয়াবা মিয়ানমারে ২৫-৩০ টাকা, টেকনাফে ৫০-৬৫ টাকায় বিক্রি হয়। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর জব্দ তালিকায় ইয়াবার মূল্য লেখা হয় ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা।
টেকনাফ পুলিশের তথ্যমতে, উপজেলায় ইয়াবা বিক্রির আখড়া ছিল অর্ধশতাধিক। এখন কয়েকটিতে লুকিয়ে চলে বিক্রি। কারণ ‘ক্রসফায়ার’ আতঙ্ক।
এ প্রসঙ্গে টেকনাফ পৌরসভার প্যানেল মেয়র আবদুল্লাহ মনির প্রথম আলোকে বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চলমান মাদকবিরোধী অভিযানে টেকনাফের সাধারণ মানুষ খুশি। কিন্তু ঘরে ঘরে ক্রসফায়ার আতঙ্ক বিরাজ করছে, এ কারণে পুরো টেকনাফ এখন পুরুষশূন্য হয়ে পড়লেও ইয়াবা চোরাচালান বন্ধ হচ্ছে না। কারণ, মিয়ানমারের সিন্ডিকেট বাকিতেই ইয়াবা চালান পাঠাচ্ছে টেকনাফে।
টেকনাফ মডেল থানার ওসি রনজিত কুমার বড়ুয়া বলেন, ইয়াবাসহ আটক লোকজনকে জিজ্ঞাসাবাদ চালিয়ে পুলিশ জানতে পেরেছে মিয়ানমারের চোরাচালানিরা ইয়াবাবোঝাই নৌকা নিয়ে প্রথমে সেন্ট মার্টিন উপকূলে আসে। তারপর সেখানে বাংলাদেশি চোরাচালানিদের নৌকায় তুলে দেয় ইয়াবা। এরপর গভীর সমুদ্র দিয়ে ওই ইয়াবার চালান টেকনাফসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে খালাস হয়। ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও কয়েকটি সিন্ডিকেট জড়িত।
পুলিশ জানায়, গত বৃহস্পতিবার গভীর রাতে সমুদ্র উপকূল দিয়ে ইয়াবা চালান খালাসের সময় পুলিশ টেকনাফ সদর ইউনিয়নের হাবিরছড়া ঘাট থেকে আড়াই লাখ ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করে। কিন্তু কাউকে ধরতে পারেনি।
গত দুই দিনে পুলিশ কক্সবাজার শহর, মহেশখালী ও টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়ক থেকে তিন ব্যক্তির গুলিবিদ্ধ লাশ উদ্ধার করেছে। জেলা পুলিশ সুপার এ কে এম ইকবাল হোসেন বলেন, নিহত তিন ব্যক্তির বিরুদ্ধে থানায় মাদক, অস্ত্রসহ দ্রুতবিচার আইনে মামলা আছে। ইয়াবা চোরাচালান নিয়ে অন্তঃকোন্দলের জের ধরে প্রতিপক্ষের গুলিতে তাঁরা খুন হয়েছেন। তা ছাড়া পুলিশ গত ১০ দিনে ৪ লাখ ৯৩ হাজার ইয়াবাসহ ১০২ জন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করেছে।