অভিন্ন নদীর পানিবণ্টন নিয়ে আশার আলো নেই

বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উপস্থিতিতে ঢাকা ও নয়াদিল্লি ১০টি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে

মো. তৌহিদ হোসেন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের পর যে প্রশ্নটি সবচেয়ে আলোচিত, এই সফরের মাধ্যমে আমরা কী পেলাম? এ ব্যাপারে আমার মত হচ্ছে, শীর্ষ পর্যায়ের এ রকম একটি সফরে হঠাৎ করে কোনো প্রাপ্তিযোগ প্রত্যাশা করা উচিত নয়। বড় কোনো প্রাপ্তির বিষয় যদি থাকে, তাহলে সেটা আগেই স্পষ্ট হয়ে যায় এবং সে অনুযায়ী প্রত্যাশারও সৃষ্টি হয়।

১৯৯৬ সালে যখন প্রধানমন্ত্রী ভারত সফরে যান, সবাই তখন জানতেন যে সফরকালে গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সই হবে। কারণ, সে সফরের আগে বিভিন্ন পর্যায়ে প্রচুর দৌড়ঝাঁপ হচ্ছিল, দরাদরি চলছিল দিল্লিতে, ঢাকায়। ঢাকা সফরে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। এবারের সফরের আগে আমরা কি এ ধরনের কোনো কার্যকলাপ দেখেছি? প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে তাই দ্বিপক্ষীয় কোনো সমস্যার জট খুলবে, এমন কোনো প্রত্যাশা ছিল, তা আমার মনে হয় না।

তারপরও দেখা যাক প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তি কিছু আছে কি না। রাজশাহী ও কলকাতার মধ্যে ট্রেন চলাচল চালু হবে, সরাসরি বাস হবে চট্টগ্রাম থেকে কলকাতা। ভারতের সহকারী হাইকমিশন হবে রংপুরে। বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরের মানুষকে তাই আর রাজশাহীতে যেতে হবে না ভিসার জন্য।

ভারতীয় গ্রিডের মাধ্যমে ৪০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ আমদানি করা যাবে নেপাল থেকে। খুবই সামান্য পরিমাণ, তবু শুরু তো হলো। চিকিৎসা নিতে যাঁরা ভারতে যাবেন, তাঁদের জন্য ই-ভিসা চালু হবে। পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ এখন ছোটখাটো চিকিৎসার জন্য সহজেই কলকাতায় যেতে পারবেন। প্রাপ্তিযোগ ঘটবে কলকাতার হাসপাতালগুলোর, যেগুলোর সেবার মান বাংলাদেশের চেয়ে কোনোভাবেই উঁচু নয়।

একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে গেদে-দর্শনা থেকে হলদিবাড়ি-চিলাহাটি হয়ে দলগাঁও পর্যন্ত সরাসরি ভারতীয় মালবাহী ট্রেন চলাচলের। এটি একটি ব্যস্ত রুট এবং বর্তমান অবকাঠামো এই অতিরিক্ত চাপ নিতে পারবে কি না সন্দেহ। এই রুটে রেল অবকাঠামো উন্নয়নের প্রয়োজন হতে পারে। তা করতে চূড়ান্ত বিচারে অর্থায়ন কে করবে, এটা একটা প্রশ্ন থেকে যাবে।

এসব বিষয়ের বাইরে প্রকৃত বড় ইস্যু হচ্ছে অভিন্ন নদীর পানি। গঙ্গার পানি চুক্তির মেয়াদ দুই বছর পর শেষ হচ্ছে। সিদ্ধান্ত হয়েছে যে এই চুক্তি নবায়নের জন্য যৌথ কারিগরি কমিটি আলোচনা শুরু করবে। এখানে দুটো বিষয় আছে।

প্রথমত, আমাদের এই আশা করার কোনো কারণ আছে কি যে ১৯৯৬ সালের চুক্তির চেয়ে ভালো কিছু আমরা পেতে পারি? আমার মনে হয়, সে সম্ভাবনা একেবারেই নেই, বরং ভারত আরও বেশি পানি প্রত্যাহার চাইতে পারে। কাজেই আমাদের অবস্থান হতে হবে বিদ্যমান শর্তে আগামী ৩০ বা ৫০ বছরের জন্য চুক্তিটি নবায়ন করা। যদি ভারত-পাকিস্তানের সিন্ধু চুক্তি বা মিসর-সুদানের নীল নদ চুক্তির মতো চিরস্থায়ী ব্যবস্থা করা যায়, তাহলে তো আরও ভালো।

গঙ্গা চুক্তির ১০ নম্বর শর্তে ৫ বছর অন্তর দ্বিপক্ষীয় পর্যালোচনা এবং প্রয়োজনে সমন্বয়ের বিধান আছে। যদিও তেমন কোনো সমন্বয়ের প্রয়োজন হয়নি। অর্থাৎ দুই পক্ষের সন্তুষ্টিতেই চুক্তিটি পালিত হয়ে আসছে। সে ক্ষেত্রে তো এর দীর্ঘমেয়াদি নবায়নে কোনো আপত্তি থাকার কথা নয়।

এর মধ্যে ২৪ জুন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা কঠোর ভাষায় প্রধানমন্ত্রী মোদিকে পত্র লিখে জানিয়েছেন যে তিস্তার পানি বাংলাদেশকে দেওয়া যাবে না। ফারাক্কা চুক্তি নিয়েও তিনি আপত্তি তুলেছেন। ফারাক্কার অর্ধেক পানি ভাগীরথীর মতো ছোট একটি শাখায় প্রবাহিত করে বাকি অর্ধেক রাখা হয়েছে নদীর মূল ধারার জন্য। এরপরও এই চুক্তি নবায়নে মমতার আপত্তি বড় কোনো বাধার সৃষ্টি করে কি না, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে।

দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে ফারাক্কায় পানিপ্রবাহ বৃদ্ধি। চুক্তির ৮ নম্বর শর্তে প্রবাহের অপ্রতুলতার বিষয়ে দুই পক্ষ একমত হয় এবং প্রবাহ বৃদ্ধির জন্য পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতার অঙ্গীকার করে।

দুঃখজনকভাবে গত ২৮ বছরে এ নিয়ে কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। সংযোগ খালের অযৌক্তিক প্রস্তাব থেকে ভারতের সরে আসার পর প্রবাহ বৃদ্ধির একমাত্র বিকল্প হচ্ছে উজানে জলাধার নির্মাণ করে বর্ষার পানি ধরে রাখা। ভারতে বা নেপালে এই জলাধার হতে হবে। চুক্তি নবায়নের পাশাপাশি যৌথ কারিগরি কমিটিতে বিষয়টি নিয়ে অবিলম্বে আলোচনা শুরু করা দরকার বাংলাদেশের পক্ষ থেকে।

তিস্তার বিষয়টি আরও জটিল। গত ১০ বছরের অভিজ্ঞতা ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাম্প্রতিক চিঠি মিলিয়ে দেখলে তিস্তার পানিবণ্টন নিয়ে আশাবাদী হওয়ার কোনো সুযোগ দেখতে পাচ্ছি না। এর পরিপ্রেক্ষিতে নদী খনন করে বাঁধ দিয়ে জলাধার সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলাদেশ সমস্যার আংশিক সমাধান করতে চেয়েছিল চীনের সহায়তায়।

মে মাসে যখন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব ঢাকায় এলেন, তাঁর সঙ্গে সাক্ষাতের পর আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, প্রস্তাবিত প্রকল্পে ভারত অর্থায়ন করতে চায়। এ বিষয়ে আমি শুধু আমাদের সাবেক পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্য তুলে ধরতে চাই। তিনি বলেন, ভারতের আমলাতন্ত্রের কারণে তাদের সহায়তায় এ প্রকল্প করতে গেলে সহজে তা বাস্তবায়িত হবে না। পক্ষান্তরে চীনাদের সহায়তায় প্রকল্পের ত্বরিত বাস্তবায়ন সম্ভব।

প্রধানমন্ত্রীর সফরে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তিস্তা নদী সংরক্ষণ ও ব্যবস্থাপনা প্রকল্প’ বিষয়ে ভারতের একটি কারিগরি প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করবে। পানিবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত তাঁর প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেন, এতে শুধু কালক্ষেপণই হবে। আর এ ধরনের কোনো দীর্ঘমেয়াদি বিষয়ের আগে অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য স্বল্প মেয়াদে পানিবণ্টনের চুক্তি থাকা প্রয়োজন।

২৫ জুন সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে তিস্তা প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারতের সহায়তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চীনের সহায়তায় প্রকল্প বাস্তবায়নের আর কোনো সুযোগ থাকছে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়।

অবস্থাটা তাহলে দাঁড়াচ্ছে এ রকম, শুষ্ক মৌসুমে তিস্তায় কোনো পানি ছাড়বে না ভারত। আংশিক সমাধানের যে পরিকল্পনা বাংলাদেশ নিচ্ছিল, তা-ও ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা অনির্দিষ্টকালের জন্য।

বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের যে বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষুব্ধ, তা হচ্ছে সীমান্তে বিএসএফের নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের হত্যা। আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতে গেছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীও হয়তো আসবেন এরপর। দুই দেশের নেতারাই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নবতর উচ্চতায় পৌঁছানোর কথা বলবেন। সীমান্তে হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার অঙ্গীকারও হয়তো ব্যক্ত করবেন তাঁরা, যেমন করেছেন অতীতে। কিন্তু এই সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য ঘটনা অচিরেই বন্ধ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা আমি দেখতে পাচ্ছি না।

 মো. তৌহিদ হোসেন সাবেক পররাষ্ট্রসচিব

prothom alo

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here