রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) আওতাধীন এলাকায় সোয়া ৫ লাখ বহুতল ভবন রয়েছে। এর মধ্যে সোয়া ৩ লাখ ভবনেরই কোনো অনুমোদন নেই। এসব ভবন কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ইমারত নির্মাণ আইন থাকলেও প্রয়োগ নেই। গেল পাঁচ বছরে মামলা হয়েছে মাত্র ১২টি। এর মধ্যে তদন্তাধীন দুটি আর বিচারাধীন ১০টি মামলা রয়েছে। বিচার শেষ হয়নি একটিরও।
ইমারত নির্মাণ আইনের ৩(ক) ধারায় বলা হয়েছে, ভবন নির্মাণ যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে সে উদ্দেশ্য ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা যাবে না। অর্থাৎ আবাসিক বাড়ির জন্য ভবন নির্মাণের অনুমতি নিলে ওই ভবনকে অন্য কোনো কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
এতে আরও বলা হয়েছে, আইন ও বিধিমালার ব্যত্যয় করে কেউ ভবন নির্মাণ করলে সরকারের উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ সেটি ভেঙে ফেলার বা অপসারণের নির্দেশ দিতে পারবে। আবার উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ স্ব-উদ্যোগে অবৈধ ইমারত ভেঙে ফেলতে বা অপসারণ করতে পারবে। অবৈধভাবে কোনো জায়গা দখল করে ইমারত নির্মাণ করলে তাও ভেঙে ফেলতে পারবে কর্তৃপক্ষ। ভোগদখলকারীকে উচ্ছেদও করতে পারবে। আইন অমান্যকারীকে কোনোরকম পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ গ্রেফতার করতে পারবে।
রাজউকের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনার (ড্যাপ) জরিপের তথ্যমতে, রাজউক এলাকায় প্রায় ২১ লাখ ৪৫ হাজার ভবন রয়েছে। এর মধ্যে বহুতল ভবন রয়েছে ৫ লাখ ১৭ হাজার। এসব ভবনের মধ্যে মাত্র ২ লাখের অনুমোদন রয়েছে। বাকি প্রায় ৩ লাখ ১৭ হাজার ভবনের কোনো অনুমোদন নেই। পাশাপাশি ১৬ লাখের বেশি সেমিপাকা ভবনও অবৈধ।
আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৯ সাল থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ইমারত আইনে মাত্র ১২টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে দক্ষিণখান থানায় ৫টি, কোতোয়ালি থানায় ২টি, বংশালে ১টি, যাত্রাবাড়ীতে ১টি, শ্যামপুরে ১টি, সূত্রাপুরে ১টি, কদমতলীতে ১টি মামলা হয়েছে।
রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে ২০২২ সালের ২৭ জুলাই দুটি ৪ তলা ভবনের কাজ চলাকালে মালিকপক্ষকে রাজউক অনুমোদিত নকশা দেখাতে বলা হয়। এতে ব্যর্থ হলে নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে ভবনের মালিক মো. মাসুম, রাশেদা বেগম রানী ও কাজী আতাউর রহমান লিটুর বিরুদ্ধে ইমারত পরিদর্শক হাসান মিয়া মামলা করেন। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন রয়েছে। একই বছরের ৭ আগস্ট ইমারত পরিদর্শক মোহাম্মদ পারভেজ পরিদর্শনে গিয়ে দেখেন, দক্ষিণখান থানার বাসিন্দা মো. ইউনুছ কাজী বসবাসরত তিনতলা ভবনের নিচতলায় গ্যারেজের পরিবর্তে ৩টি দোকান নির্মাণ করেছেন। রাজউক অনুমোদিত নকশা দেখাতে ব্যর্থ হলে তার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। এ মামলা তদন্ত করে ২০২৩ সালের ২২ এপ্রিল আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়েছে। মামলার চার্জ গঠন বিষয়ে শুনানির জন্য আগামী ২২ এপ্রিল দিন ধার্য রয়েছে।
এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী খুরশিদ আলম খান যুগান্তরকে বলেন, ১২টি মামলার মধ্যে যদি একটি মামলারও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতো তাহলে একটা উদাহরণ হতো। সরকারকে এ বিষয়ে আরও কঠোর হতে হবে। তিনি বলেন, ভবনে দুর্ঘটনার পর মানুষ মারা যায়, আহত হয়। আইওয়াশ করার জন্য একটা মামলা হয়। পরে মামলাগুলো আর আলোর মুখ দেখে না। সার্বিকভাবে এসব ক্ষেত্রে নজরদারির অভাব রয়েছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সভাপতি নগরবিদ আদিল মোহাম্মদ খান যুগান্তরকে বলেন, ইমারত আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবেই ঢাকা মহানগরীতে অনুমোদনহীন, অবৈধ এবং জলাধার ভরাট করে ভবন নির্মাণ হয়েছে। এক্ষেত্রে আইনের কার্যকর প্রয়োগে রাজউকের উদাসীনতা ও গাফিলতি রয়েছে। ইমারত আইনের প্রয়োগ ছাড়া বাসযোগ্য ঢাকা মহানগরী গড়া সম্ভব নয়।
রাজউকের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. আশরাফুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, রাজউকের দৃষ্টিতে যেসব ভবন অনুমোদনহীন, দেখা গেছে সেসব ভবন ইউপি, পৌরসভা অনুমতি দিয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর সরকার একটা নির্দেশনা দিয়েছে যে, যেখানে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ আছে সেখানে উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ অনুমোদন দেবে। অথচ বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়, পৌরসভা অনুমোদন দিচ্ছে। অথচ তাদের কোনো অথরাইজড অফিসার নেই। আমরা পর্যবেক্ষণে গেলে ভবন মালিকরা কোনো না কোনো প্রতিষ্ঠানের অনুমোদনপত্র দেখায়। অনেক ক্ষেত্রে হাইকোর্টের শরণাপন্ন হয়ে আদালত থেকেও একটা নিষেধাজ্ঞা নিয়ে আসে। এ ধরনের প্রায় পাঁচ হাজার মামলা পেন্ডিং রয়েছে। এ বিষয়গুলো সুরাহা না হলে তো আইনি প্রক্রিয়ায় যেতে পারি না।
jugantor