অনিশ্চিত রাজনীতি, অনির্ধারিত গন্তব্য

  • গোলাম মাওলা রনি
  •  ২৩ আগস্ট ২০২৪, ০৫:৩৮
  • অধ্যাপক ইউনূস – ছবি : সংগৃহীত

    ২০১৪ সাল থেকেই আমাদের মনোবেদনা বেড়ে চলছিল। মনের সাথে চিন্তা-চেতনার রোগবালাই এবং সর্বোপরি শাসক দল আওয়ামী লীগের নানান জুলুম-অত্যাচারে আমাদের শরীরও নানাভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছিল। গত ১০ বছরের বেআইনি শাসন এবং তার আগের পাঁচ বছরের কর্তৃত্বপরায়ণ শাসনের কবলে পড়ে আমরা অনেকে কথা বলতে পারছিলাম না। অনেকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলা-মোকদ্দমার যন্ত্রণা-জেল-জুলুম-হুলিয়া, নির্যাতন এবং সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে জুলুম-অত্যাচারের কারণে কোটি কোটি মানুষের মধ্যে আওয়ামী লীগ বিরোধী মনোভাবের সাথে ঘৃণা-ক্রোধ-ক্ষোভ-প্রতিশোধস্পৃহা আগ্নেয়গিরির লাভার মতো টগবগিয়ে ফুটছিল এবং অগ্ন্যুৎপাত ঘটানোর জন্য জ্বালামুখ খুঁজছিল।

    মানব মনের লাভা-মস্তিষ্কের বিষ এবং শরীরের বেদনার রঙ যে কতটা ভয়াবহ হতে পারে, তা আমরা ২০২৪ সালের আগস্ট মাসের ৫ তারিখে দেখেছি এবং এখনো দেখছি। বাংলাদেশের রাজনীতির দুর্ভাগ্য যে, আমরা কোনো দার্শনিক প্রকৃতির রাষ্ট্রনায়ক পাইনি- অথচ দর্শন শাস্ত্রের অধ্যয়ন, ইতিহাসের জ্ঞান এবং উত্তম চরিত্র ছাড়া রাষ্ট্রক্ষমতার উত্তাপ সামাল দেয়া সম্ভব নয়। ফলে যাদের মধ্যে এসব গুণাবলি থাকে না ঘটনাচক্রে তারাই রাষ্ট্রক্ষমতা লাভ করে বসে। ক্ষমতার চেয়ারে বসামাত্রই তারা নিজেদের ওজন হারিয়ে ফেলে। তাদের অবস্থা হয় অনেকটা ফোলানো-ফাঁপানো বেলুনের মতো- যেখানে সামান্য একটু খোঁচা লাগলে বেলুন কিভাবে ফটাস করে ফেটে যায় তা বর্তমান জমানায় দেশের ১৮ কোটি মানুষ নতুন করে দেখলেন।

    শেখ হাসিনার ঐতিহাসিক পলায়ন এবং তার সরকারের নির্মম পতনের ফলে যে রাজনৈতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছে, তা হাল আমলে সবাইকে ভোগাচ্ছে। তার পলায়নের পর টানা চার দিন পুরো দেশ কার্যত সরকারবিহীন ছিল। তার পর একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন হয় বটে তবে এই সরকারের আইনগত ভিত্তি-প্রশাসনিক কাঠামো এবং কর্মপরিধি ও ভবিষ্যৎ নিয়ে যেভাবে তর্ক-বিতর্ক শুরু হয়েছে, তার ফলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনযন্ত্রের সর্বত্র একধরনের অনিশ্চয়তা-অস্থিরতা ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে। রাষ্ট্রের মূল সমস্যাগুলো ছাইচাপা পড়ে যাচ্ছে এবং পতিত সরকারের দুর্নীতিবাজ মন্ত্রী-এমপি-আমলা-কামলাদের বিরুদ্ধে মামলা-গ্রেফতার-রিমান্ড নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি হচ্ছে। প্রাচীন রোমান সাম্রাজ্যের সেই উপকথার মতো প্রতিদিনই নিত্যনতুন সার্কাসের দৃশ্য প্রদর্শিত হচ্ছে এবং আমরা সেই রোম নগরীর বাসিন্দাদের মতো সার্কাসের দৃশ্যে মাতোয়ারা হয়ে ভুলে যাচ্ছি আমাদের জীবনের প্রকৃত সমস্যা।

    প্রাচীন রোম সাম্রাজ্যের একটি জনপ্রিয় প্রবাদ হলো, যখন তুমি শাসক হিসেবে জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণ করতে পারবে না, তখন তাদের জন্য সার্কাসের আয়োজন করো। রোমের যোগ্য শাসকরা কোনো দিন এ প্রবাদটি অনুসরণ করেননি। মার্কাস অরলিয়াস, জুলিয়াস সিজার, জাস্টিনাইন কনস্টানটাইনের মতো শাসকরা জনগণের কর্মক্ষমতাকে পূর্ণ মাত্রায় ব্যবহার করে রোম সাম্রাজ্যকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। অন্য দিকে কমোডাস ও নিরোর মতো কুশাসকরা জনগণের কর্মক্ষমতাকে জুলুম-অত্যাচারের মাধ্যমে হ্রাস করতে করতে রীতিমতো পশুর পর্যায়ে নামিয়ে এনেছিলেন।

    তাদের জমানার জনগণ ক্ষুধা না লাগলে কাজের কথা ভাবত না এবং আগামী দিনের কথা চিন্তা করে সময় নষ্ট না করে যুদ্ধবিগ্রহ, ক্রীড়া-কৌতুক-আমোদ ফুর্তি হাপিত্যেশ ও আহাজারিতে মেতে থাকত। হাসিনার জমানায় কৌশলে প্রাচীন রোমান প্রবাদটি কিভাবে অক্ষরে অক্ষরে পালিত হয়েছে তা নিশ্চয়ই তার দোসররা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন। অন্য দিকে বর্তমান শাসকরা যেন সেই প্রবাদ থেকে নিজেদেরে দূরে রাখতে পারেন সে জন্য আজকের নিবন্ধে যথাসম্ভব ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করব।

    মানুষের মৌলিক চাহিদার পর যে অভাবটি মানুষকে সবচেয়ে বেশি পীড়া দেয় তার নাম রাজনীতি। আবার মানুষের সঠিক জীবনযাত্রায় দীর্ঘমেয়াদে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের নিশ্চয়তাদানকারী উপাখ্যানটির নাম রাজনীতি। আজকের দুনিয়ায় টেকসই রাজনীতি বলতে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সরকারব্যবস্থার মধ্যে সর্বাধিক জনপ্রিয় পদ্ধতিটির নাম সংসদীয় ব্যবস্থা, যা একটি মহান বিপ্লবের মাধ্যমে ইংল্যান্ডে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং ম্যাগনাকার্টা দলিলের মাধ্যমে আইনগত ভিত্তি লাভ করেছিল।

    গণতন্ত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলো- জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ পায়। শত ত্রুটি ও শত দুর্বলতা সত্ত্বে¡ও আজ অবধি জনগণের রায়ের বিকল্প কোনো ভালো পদ্ধতি পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী আবিষ্কার করতে পারেননি। সমাজের সুধীজন-জ্ঞানী-গুণী কিংবা সাধু-সন্ন্যাসীকে বহুবার রাজসিংহাসনে বসানো হয়েছে। বিক্ষুব্ধ জনতা তাদেরকে মেরে-কেটে তাড়িয়ে দিয়েছে অথবা কোনো কোনো ক্ষেত্রে জীবন্ত কবর দিয়েছে নতুবা জীবন্ত পুড়িয়ে মেরেছে। তার পর নিজেদের পছন্দমতো লোকের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা ন্যস্ত করেছে। ইতিহাসে এমনো হাজার নজির রয়েছে এবং যেখানে চোর-গুণ্ডা বা ডাকু প্রকৃতির লোককে জনগণ ভোট দিয়েছে এবং সাধুর পরিবর্তে ডাকুকে নিজেদের রাজা বা নেতা বানিয়ে মহাসুখে দিনাতিপাত করেছে। ভারতে দস্যুরানী ফুলনের সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া কিংবা রাশিয়াতে পিটার দ্য গ্রেট, স্পেনে ফ্রাঙ্কো, ভারতবর্ষে অশোক দ্য গ্রেটকে ইতিহাসের মহানায়ক কিন্তু জনগণই বানিয়েছে অথচ তাদের জীবনের বিরাট অংশজুড়ে যে নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা এবং দমনপীড়নের ইতিহাস ছিল তা পাঠ করলে অনেক সাধু-সন্ন্যাসীর হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে যাবে।

    শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনে বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে ৫০ লাখ মামলা, লাখ লাখ নেতাকর্মীর বছরের পর বছর কারাগারের দুর্বিষহ জীবন। ক্রসফায়ার, হত্যা, গুমের মতো ঘটনায় কয়েক হাজার পরিবারের বিভীষিকা সৃষ্টি, লাখ লাখ নেতাকর্মীর ব্যবসায়-বাণিজ্য, বাড়িঘর লুট, লাখ লাখ নেতাকর্মী ১৫ বছর ধরে এলাকা ছাড়া হয়ে যেভাবে পালিয়ে ছিলেন এবং এতসব জুলুম-নির্যাতনের মধ্যে অনেকের পিতামাতা-সন্তান-সন্ততির মৃত্যু হওয়ার পরও অনেকে জানাজায় অংশ নিতে পারেননি। রাজনীতি এই প্রতিহিংসার বেদনা যে কত গভীর তা কোনো সাধু-সন্ন্যাসীর পক্ষে অনুধাবন করা সম্ভব নয়। কেবল একজন ভুক্তভোগী রাজনৈতিক নেতাই তারই মতো ভুক্তভোগী হাজার হাজার নেতাকর্মীর মনে প্রশান্তি আনতে পারেন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক চর্চা এবং সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচনের পদ্ধতি অনুসরণের মধ্য দিয়ে।

    বাংলাদেশের ৫ আগস্টের গণ-অভ্যুত্থান কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে শাসক দলের দমনপীড়ন, জুলুম-নির্যাতনের বা হত্যাকাণ্ডের একক ফসল নয়। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অংশগ্রহণ, রাজনৈতিক দলগুলোর সার্বিক সহযোগিতা, অংশগ্রহণ এবং শেষ পর্যায়ে ঝুঁকি গ্রহণের ফলে বাংলার জমিনে বিস্ময়কর এক গণ-অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়েছে। কোনো একক দাবির বিরুদ্ধে গণ-অভ্যুত্থান হয়নি। কোনো একক নেতৃত্বে এই মাহেন্দ্রক্ষণের সৃষ্টি হয়নি। কোনো সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা করে এবং কোনো সুনির্র্দিষ্ট নীতি ও আদর্শকে সামনে রেখে আন্দোলনকারীরা বন্দুকের সামনে বুক পেতে দেননি; বরং সীমাহীন জুলুম, অত্যাচার, অনাচার-অনিয়ম, অপমান, শোষণ, বঞ্চনা, দুর্নীতিসহ শত শত কারণে প্রতিটি পরিবার, সমাজ এবং সর্বোপরি মানবমন অভ্যুত্থান ঘটানোর জন্য টগবগিয়ে ফুটছিল, যা সমন্বিতভাবে ৫ আগস্ট তারিখে বিস্ফোরিত হয়।

    গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তাদের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো বিদ্যাবুদ্ধিতে ও সফলতায় তারা রাষ্ট্রের অন্যতম উদাহরণযোগ্য মানুষ। আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকে যে দুই তরুণকে সরকারে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে তাদের ইতিবাচক দিক হলো তারা পুরো আন্দোলন প্রক্রিয়ার সাথে সরাসরি যুক্ত ছিলেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং চূড়ান্তপর্যায়ে এসে জুলুম-নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। অন্য দিকে সরকারের কর্তাদের নেতিবাচক দিক হলো তারা কেউই মূল ধারার রাজনীতির সাথে কোনোকালে জড়িত ছিলেন না। উল্টো ক্ষেত্র বিশেষে তাদের কারো কারো মনমস্তিষ্কে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে ঘৃণা ক্ষোভ ও ক্রোধ রয়েছে। ফলে তাদের সামনে রাজনীতি গণতন্ত্র নির্বাচন নিয়ে বেশি কথা বললে তারা কেউ কেউ হয়তো মেজাজ হারিয়ে ফেলবেন।

    উল্লিখিত অবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাজকর্ম ধ্যান-ধারণার সাথে দেশের চলমান রাজনীতির যে দূরত্ব রয়েছে তা দিনকে দিন বাড়ছে। সরকার চাচ্ছে রাষ্ট্র সংস্কার করতে। রাজনৈতিক দলগুলো চাচ্ছে দ্রুত নির্বাচন। সরকারের পক্ষের লোকের দাবি রাজনৈতিক দলগুলো তো আন্দোলনে ব্যর্থ হয়েছে। তারা পতিত সরকারের একটি পশমও স্পর্শ করতে পারেনি- উল্টো ভয়ে গর্তে লুকিয়ে ছিল। ছাত্রদের সাহস রক্ত এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে গণ-অভ্যুত্থান হয়েছে এবং সেই ছাত্রদের পছন্দের মানুষটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্ব দিচ্ছেন। সুতরাং তারা রাষ্ট্রসংস্কার না করে নির্বাচন দেবেন না।

    সরকার সমর্থকদের কথাবার্তায় রাজনৈতিক দলগুলো প্রমাদ গুনছে। কারণ পথে-ঘাটে মাঠে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাকর্মীদের দ্বারা প্রতিদিন এমন সব অপ্রিয় ঘটনা ঘটছে যার ফলে আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর জনপ্রিয়তা ব্যাপক হুমকির মুখে পড়েছে। যদি স্বল্পতম সময়ের মধ্যে নির্বাচন ও রাজনৈতিক সরকার প্রতিষ্ঠিত না হয় তবে পুরো পরিস্থিতি সবার জন্য বুমেরাং হয়ে পড়বে এবং ক্ষমতার চাবি তৃতীয়পক্ষের কাছে চলে যাবে।

    লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য