কালক্ষেপনের দীর্ঘ বেড়াজালে আটকে পড়েছে নৌ পরিবহন অধিদফতরের নিজস্ব ১১তলা ভবন নির্মাণের কাজ। দুই দফায় মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এরপরও সর্বশেষ নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেও নির্মাণকাজ সম্পন্ন হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্মাণাধীন ভবনটি সরজমিন পরিদর্শন করে এবং নৌ অধিদফতরের কর্মতর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এরকমই আভাস পাওয়া গেছে।
অভিযোগ উঠেছে, ভবনটি নির্মাণে দীর্ঘসূত্রতার পেছনে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি রয়েছে। প্রকল্পের সময়সীমা ও ব্যয় বৃদ্ধি করে অর্থ লোপাটের উদ্দেশেই ধীরগতিতে নির্মাণকাজ চালানো হচ্ছে। প্রকল্প পরিচালক (পিডি) ও ঠিকাদারসহ নির্মাণকাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের দিকে অভিযোগের তীর। সাংবাদিকদের প্রশ্নের মুখে অধিদফরের মহাপরিচালক দাবি করেছেন, অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণসহ পিডিকে প্রত্যাহার করে নতুন পিডি নিয়োগের জন্য নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন তিনি। তবে অভিযোগ অস্বীকার করে পিডির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এ প্রকল্পে কোনও অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, নৌখাতের উন্নয়ন ও নিরাপত্তার স্বার্থে ২০১৪ সালে গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম (জিএমডিএসএস) নামে নৌ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি প্রকল্প হাতে নেয় সরকার। এটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় নৌ অধিদফতরকে। প্রকল্পের মোট ৩৮২ কোটি টাকার মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার ঋণ সহায়তা ৭০ শতাংশ ও বাকি ৩০ শতাংশ বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিলের। তিন বছর মেয়াদি প্রকল্পের বাস্তবায়নের শেষ সময় ছিল ২০১৬ সালের ৩১ ডিসেম্বর। পরবর্তীতে দুই দফায় প্রকল্পটির কাজের পরিধি বাড়িয়ে এর নামকরণ হয় ‘এস্টাব্লিশমেন্ট অব গ্লোবাল মেরিটাইম ডিস্ট্রেস অ্যান্ড সেফটি সিস্টেম অ্যান্ড ইন্ট্রিগ্রেটেড মেরিটাইম নেভিগেশন সিস্টেম (ইজিআইএমএনএস)’। একই সঙ্গে ব্যয় বরাদ্দ বাড়িয়ে করা হয় ৭৭৯ কোটি টাকা। বাস্তবায়নের সময়সীমা ২০২৪ সালের ৩০ জুন চূড়ান্ত করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, উপকূলীয় অঞ্চলে বিভিন্ন অবকাঠামো স্থাপনের পাশাপাশি এ প্রকল্পের আওতায় আরও রয়েছে রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নৌ পরিবহন অধিদফতরের জন্য একটি ১১তলা ভবন নির্মাণ। ভবনটির নির্মাণকাল ছিল ২০১৭ সালের ২৯ ডিসেম্বর থেকে ২০২১ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত। পরবর্তীতে সময়সীমা বাড়িয়ে ২০২৪ সালের ৩০ জুন করা হয়।
সূত্র মতে, ভবনের নিচতলা থেকে অষ্টম তলা পর্যন্ত নির্মাণব্যয় ধরা হয়েছে ৪০ কোটি টাকা। যা দক্ষিণ কোরিয়া সরকার দেশটির এক্সিম ব্যাংকের মাধ্যমে দেবে। ৯ থেকে ১১ তলা পর্যন্ত নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ কোটি টাকা। যা দেওয়া হচ্ছে বাংলাদেশ সরকারের নিজস্ব তহবিল থেকে। এ প্রকল্পের মূল ঠিকাদার কোরিয়ান কোম্পানি এলজি সামিহ। তবে কোরিয়ান ঠিকাদার এ কাজে বাগদাদ কনস্ট্রাকশানসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সাব-কন্ট্রাক্টর বা সহঠিকাদার নিয়োগ করেছে। তারাই ভবন নির্মাণসহ ইন্টেরিয়র ও ডেকরেশনের কাজ করছে।
গত ১৬ মে সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ভবনের নিচতলায় ফায়ার ফিটিংসের যে কাজ করা হয়েছে তাতে নানা অসঙ্গতি রয়েছে। এমনকি ভবনের নকশা অনুমোদনের সময় রাজউকের সংশ্লিষ্ট দফতরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের যে ছাড়পত্র জমা দেওয়া হয়েছে তাও জাল। গত ৭ মে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে নৌ অধিদফতরের মহাপরিচালককে জানানো হয়, এই ভবনের অনুকূলে তারা কোনও ছাড়পত্র দেননি।
ভবনের বেজমেন্টে পাওয়ার সাব-স্টেশন ও জেনারেটর হাউজ পাশাপাশি স্থাপন করায় বড় ধরনের অগ্নিঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছিল। এই ঝুঁকি এড়াতে পরবর্তীতে অতিরিক্ত প্রায় ছয় লাখ টাকা ব্যয় করে স্থাপনা দুটি আলাদা করা হয়েছে। ভবনের বিভিন্ন তলা ছিদ্র করে সিঁড়ির সামনে ফায়ারফাইটিং কেস বসানো হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, এটাও যেকোনও সময় মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। দ্বিতীয় তলার সিলিংয়ে কিছু এয়ারকন্ডিশনের (এসি) তার এলোমেলো থাকলেও এ পর্যন্ত কোনও এসি লাগানো হয়নি।
সরজমিন পরিদর্শনকালে সেখানে উপস্থিত মহাপরিচালক কমডোর নিজামুল হক নিজেই তৃতীয় তলায় নিয়ে ঘুরে ঘুরে সেখানকার চিত্র দেখান। তিনি অভিযোগ করেন, সেখানে ব্যবহার উপযোগী বা মানসম্মত কোনও ফিটিংস নেই। এমনকি মহাপরিচালকের কক্ষেও না। মহাপরিচালকের ওয়াশরুমের কোনও কাজই এখনও শুরু হয়নি। তার কক্ষ ছাড়া তৃতীয় তলার কোথাও মার্বেল টাইলস নেই। এছাড়া তৃতীয় তলায় কোনও এসি লাগানো হয়নি, লাইটিং নেই। অথচ ছয় কোটি ৪২ লাখ টাকা খরচের কথা বলা হচ্ছে।
নির্মাণাধীন ভবনটির সাত তলা পর্যন্ত ঘুরে দেখা যায়, বিভিন্ন তলায় অধিকাংশ দরজা প্লাস্টিকের তৈরি। দরপত্রের শর্ত অনুযায়ী, কাঠের তৈরি দরজা লাগানোর কথা। এছাড়া কয়েকটি তলায় মেঝেতে টাইলস বসানো হয়নি। ওয়াশরুমে স্থাপন করা বেসিন, কমোড ও অন্যান্য ফিটিংসও নিম্নমানের।
এদিকে সাংবাদিকের উপস্থিতির খবর পেয়ে প্রকল্প পরিচালক ও নৌ পরিবহন অধিদফতরের নটিক্যাল সার্ভেয়ার আবু সাঈদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমান তাদের সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি সাংবাদিকের মুখোমুখি হননি। তবে পিডি আবু সাঈদ মোহাম্মদ দেলোয়ার রহমানের পক্ষে ১৮ মে দুপুরে উপ-প্রকল্প পরিচালক (ডিপিডি) ফরহাদ জলিল বিপ্লব বলেন, পিডি অসুস্থ। ডিপিডি দাবি করেন, ১১তলা ভবন নির্মাণে কোনও অনিয়ম হয়নি। দরপত্রের শর্ত এবং এ সংক্রান্ত সরকারি বিধিবিধান মেনেই সবকিছুই করা হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নৌ অধিদফতরের মহাপরিচালক কমডোর মোহাম্মদ নিজামুল হক বলেন, তাকে না জানিয়ে এবং কোনও ধরনের অনুমোদন না নিয়ে যাচ্ছেতাইভাবে প্রকল্পের কাজ করা হচ্ছে। তার দাবি আগে প্রকল্পের কাজ ৩০ থেকে ৩৫ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছিল। তিনি মহাপরিচালকের দায়িত্ব গ্রহণের পরে প্রকল্পের কাজ প্রায় ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে।
এই অনিয়মের বিরুদ্ধে আপনি কেন ব্যবস্থা নিচ্ছেন না- এমন প্রশ্নের জবাবে মহাপরিচালক বলেন, পিডি ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম আমার নজরে এলে এ সবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। কর্মকর্তাদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করে বিষয়টি অবহিত করেছি। এমনকি বর্তমান পিডি পরিবর্তন করে নতুন পিডি নিয়োগের জন্য চিঠি দিয়ে অনুরোধ করেছি।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন, নৌ পরিবহন অধিদফতরের মহাপরিচালকের পক্ষ থেকে লেখা চিঠি আমরা পেয়েছি। বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। আমরা বিষযটি তদন্তে দিয়েছি। তদন্তে দোষীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে চাইলেই প্রকল্পের পিডি পরিবর্তন করা যায় না। পিডি নিয়োগ সংক্রান্ত মন্ত্রণালয়ে কমিটি আছে। আমি এই কমিটির প্রধান হিসেবে কমিটির সভা করেছি। বিষযটি সেখানে উপস্থাপন করেছি। তবে প্রকল্পের পিডি নিয়োগ দেওয়ার এখতিয়ার নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর। তিনি সব দিক বিবচনা করেই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।