৯ মে ২০২৩
অলিউল্লাহ নোমান 10 May 2023
আওয়ামী লীগের দলীয় দৃষ্টিকোণে রচিত সংবিধান অনুযায়ী এ বছরের শেষ মাসে অথবা পরবর্তী বছরের শুরুতেই দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন হওয়ার কথা। সে অনুযায়ী নির্বাচনের আর বেশি বাকী নেই। জাতীয় নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকারের পদত্যাগ চায় বিরোধী দল গুলো। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তির জন্য প্রত্যাশিত মানুষ তাকিয়ে আছে রাজনৈতিক দল গুলোর দিকে। রাজনৈতিক দল গুলোর আন্দোলন সংগ্রামের মাধ্যমেই দেশে দেশে ফ্যাসিবাদের পতন হয়েছে অতীতে। বাংলাদেশের চলমান ফ্যাসিবাদী শাসনের অবসানও ঘটবে রাজনৈতিক আন্দোলনে, এমনটাই প্রত্যাশা সাধারণ মানুষের।
শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদের পতনের লক্ষ্যে বিরোধী দল গুলো একই কর্মসূচিতে যুগপৎভাবে পালন করবে রাজপথে। গত ১০ ডিসেম্বর বিরোধী দল গুলো এমন ঘোষণা দিয়ে ১০ দফা দাবীও পেশ করেছে। তবে ৪ মাসের বেশি পার হয়ে গেছে। যুগপৎ আন্দোলনের অভিন্ন রূপরেখা এখনো আন্দোলনরত দল গুলো ঘোষণা করতে সক্ষম হয়নি। শীঘ্রই অভিন্ন রূপরেখা ঘোষণা হবে এমনটা শোনা যাচ্ছে বহুদিন থেকে। এমন ধীরগতির আন্দোলনে কি শেখ হাসিনার মত ফ্যাসিবাদের পতন সম্ভব? এমন প্রশ্ন এখন সাধারণ মানুষের। অতীতের স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক আন্দোলনের নজির রয়েছে। কেমন ছিল সেই আন্দোলন গুলোর চরিত্র।
পেছনের দিকে নজর দিয়ে অতীতের স্বৈরশাসক বিরোধী আন্দোলন এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলনের চরিত্র একটু স্মরণ করা যেতে পারে। বর্তমান ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনার তুলনায় এরশাদের স্বৈরশাসন কিছুই না। ৯ বছরের স্বৈরশাসনে ক্ষমতায় টিকে থাকতে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও তৎকালীন বিডিআরকে ব্যবহার করেছে এরশাদ। কিন্তু ৯ বছর ধরে স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলন দমনে ৯ জন মানুষও রাজপথে খুন করেনি এরশাদ। অপরদিকে এরশাদের কোন গণভিত্তি ছিল না। বন্দুকের নল তাক করে ক্ষমতা দখলকারী এরশাদের পতনের জন্য সব রাজনৈতিক দল যুগপৎ আন্দোলন করেছে। বিএনপি, আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল অভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে তখন রাজপথে যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছিল। চুড়ান্ত পর্যায়ে সে আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল সকল পেশাজীবীরা। ডাক্তার, প্রকৌশলী এবং কৃষিবিদদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল ‘প্রকৃচি’। পাশাপাশি সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা একজোট হয়েছিল এরশাদের পতনের দাবীতে। সাংবাদিকরা ছিল ঐক্যবদ্ধ। এরশাদ বিরোধী চুড়ান্ত আন্দোলনে শিক্ষকরা শ্রেণীকক্ষ ছেড়ে রাজপথে নেমেছিলেন। ঘোষণা করেছিলেন এরশাদের বিদায় না হওয়া পর্যন্ত পাঠদানে ফিরবেন না। তখন এত গুলো টেলিভিশন চ্যানেল ছিল না। শুধুমাত্র বিটিভি ছিল। একমাত্র খবরের কাগজ ছিল তথ্য জানার উৎস। এরশাদের পতন না হওয়া পর্যন্ত পত্রিকা প্রকাশ করা হবে না, এমন ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল ঐক্যবদ্ধ সাংবাদিক ইউনিয়ন থেকে। ডাক্তার-প্রকৌশলীরাও এমন কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে রাজপথে নেমেছিলেন।
সর্বশেষ এরশাদের ক্ষমতা ধরে রাখার ভরসা ছিল সেনাবাহিনী। কিন্তু জগণের বিরুদ্ধে দাড়াতে সেনাবাহিনী অস্বীকার করার পর এরশাদ বোঝে গিয়েছিলেন পায়ের নিচের মাটি সব সরে গেছে। নিরুপায় এরশাদ পদত্যাগের ঘোষণা দিয়ে সরে দাড়াতে বাধ্য হয়েছিলেন।
এরশাদের পতনের পর একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়েছিল তৎকালীন প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে। তখন ছিল রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা। প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদকে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব দিতে তখন সব রাজনৈতিক দল একমত হয়েছিল। সব রাজনৈতিক দলের সম্মতিতে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসাবে দায়িত্ব গ্রহন করেছিলেন বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ। ১০জন উপদেষ্টা নিয়ে গঠিত হয়েছিল তাঁর সরকার। নির্বাচন কমিশন ও প্রশাসন ঢেলে সাজিয়ে ঘোষণা করা হয়েছিল জাতীয় নির্বাচনের তারিখ। নির্ধারিত ৯০ দিনের মধ্যেই ১৯৯১ সালের ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল জাতীয় নির্বাচন।
শাহাবুদ্দিন আহমদ যে পদ্ধতিতে সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং সরকার গঠন করেছিলেন সেটা কিন্তু সংবিধানে ছিল না। রাজনৈতিক দল গুলো সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং তাঁর মত করে ১০জন উপদেষ্টা নিয়োগ দিয়েছিলেন। সুতরাং সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান না থাকলেও রাজনৈতিক দল গুলো একমত হলে সেটা সম্ভব, এমন উদাহরণ বাংলাদেশেই রয়েছে।
শাহাবুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে গঠিত সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছিল বিএনপি। বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত বিএনপি সরকার ক্ষমতায় তখন। ২/১টি উপ-নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ এনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আন্দোলন। এই আন্দোলনও পরিচালিত হয়েছিল যুগপৎ কর্মসূচির মাধ্যমে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দল গুলোর সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল লিয়াজো কমিটি। লিয়াজো কমিটি কর্মসূচি চুড়ান্ত করলে রাজনৈতিক দল গুলো নিজ নিজ অবস্থান থেকে সেটা ঘোষণা করত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে ১৯৯৪ সাল থেকে ১৯৯৬ সালের ৩০ মার্চ পর্যন্ত আন্দোলনে হরতাল, অবরোধ ও অসহযোগ কর্মসূচির নামে ১৭৩ দিন দেশ প্রায় অচল করে রাখা হয়েছিল। সর্বশেষ কথিত জনতার মঞ্চ বসানো হয়েছিল জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে। তৎকালীন কেবিনেট সচিব মহিউদ্দিন খান আলমগীরের নেতৃত্বে আমলারা বেগম খালেদা জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। একদল আমলা সচিবালয় থেকে বের হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে স্থাপিত জনতার মঞ্চে এসে অবস্থান নিয়েছিলেন। তাদের অনুসরণ করে অনেক জেলায় জেলা প্রশাসক নিজ নিজ জেলায় স্থাপিত জনতার মঞ্চে উঠেছিলেন। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশাপাশি আমলা বিদ্রোহের পরপরই বেগম খালেদা জিয়ার সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য জাতীয় সংসদে বিল উত্থাপন করেছিলেন। যেদিন বিলটি উত্থাপন করা হয়েছিল সেই দিন দিবাগত রাতভর সংসদ চলছিল। ভোররাতে বিলটি পাস করে সংসদ অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছিল। সংসদে পাস হওয়া বিলটি রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের পরপরই নয়াপল্টনে বিশাল জনসভায় তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে যুগপৎ এই আন্দোলনের নামে জ্বালাও-পোড়াও কর্মসূচিতে দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছিল তখন। রাজপথের পাশাপাশি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবীতে আমদানি-রফতানির প্রধান কেন্দ্র চট্টগ্রাম বন্দর তখন মাসের পর মাস অচল করে রাখা হয়েছিল শ্রমিক আন্দোলনের নামে।
আবার ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই তত্ত্বাবধান সরকারে সংস্কারের দাবীতে রাজপথে আন্দোলনের নামে লগি-বৈঠার তাণ্ডব দেখেছিল দেশের মানুষ। তখনো মাসের পর মাস কর্মসূচি দিয়ে দেশ রাজপথ অচল করে রাখা হয়েছিল ২০০৫-২০০৬ সালে। শেখ হাসিনা নিজেই ঘোষণা করেছিলেন তাঁর লগি-বৈঠার তাণ্ডবের আন্দোলনের ফসল ছিল মঈন উদ্দিন-ফখরুদ্দিনের জরুরী আইনের সরকার।
১৯৯৫-৯৬ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনেও জাতিসংঘের প্রতিনিধি এসেছিল রাজনৈতিক দল ও সরকারের মধ্যে মধ্যস্থতা করতে। জাতিসংঘের প্রতিনিধি স্যার নিনিয়ান দিনের পর দিন আন্দোলনরত রাজনৈতিক দল গুলোর প্রতিনিধি এবং সরকারি দল বিএনপি’র প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন। কোন সুরাহা করতে না পেরে ব্যর্থ হয়ে ফেরত গিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত ফয়সালা হয়েছিল রাজপথে। সুতরাং জাতিসংঘের প্রতিনিধি স্যার নিনিয়ানের ব্যর্থ হয়ে ফেরত যাওয়া প্রমান করে জাতিসংঘ ও শক্তিশালী দেশ গুলো চাইলেও সমাধান হয় না। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হয় জনতার রোষানলে রাজপথের আন্দোলনে, এটাই প্রমান করে সেই সময়কার ঘটনা গুলো।
শেখ হাসিনা ১৭৩ দিন দেশ অচল রেখে, আন্দোলনের নামে রাজপথে সচিবদের দিগম্বর করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায় করেছিলেন। ক্ষমতায় এসে তিনিই আবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান সংবিধান থেকে উচ্ছেদ করেছেন। এখন শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের লোকজন বলছেন, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কোন সুযোগ নেই। এই রকম একজন বেহায়ার নিকট থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায় শুধু মাত্র বক্তৃতা আর বিবৃতিতে সম্ভব নয়। এমনকি রাজপথে আন্দোলনবিহীন অবস্থায় শুধুমাত্র বিদেশীদের হস্তক্ষেপেও সম্ভব হবে না, অতীতের আন্দোলনের চরিত্র তাই প্রমাণ করে।
এদিকে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী সরকার প্রশাসনকে চূড়ান্তভাবে সাজানো শুরু করেছে। তাদের মত করে অনুগত নির্বাচন কমিশন জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
অতীতের আন্দোলনের চরিত্র গুলো বিশ্লেষণ করে বিরোধী দল গুলোর উচিত এখনই চুড়ান্ত কর্মসূচি ঘোষণা করা। মুক্তিকামী জনগনের প্রত্যাশা, এখন একদফার আন্দোলন। কর্মসূচির মূল শ্লোগান হওয়া উচিত, একদফা-এক দাবী, হাসিন তুই এখন যাবি!
লেখক: যুক্তরাজ্যে নির্বাসিত সাংবাদিক