ঢাকা
রাজস্ব খাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্ত পূরণ করতে আগামী তিন অর্থবছরে বাংলাদেশকে রাজস্ব হিসেবে ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। এর মধ্যে আগামী ২০২৩-২৪ অর্থবছরেই আদায় বাড়াতে হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকা।
বাংলাদেশ আইএমএফের কাছ থেকে ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ পাচ্ছে। এই ঋণ বাংলাদেশ পাবে সাত কিস্তিতে তিন বছরে। এ ক্ষেত্রে সংস্থাটির শর্তই হচ্ছে কর–জিডিপির অনুপাতে প্রতিবছরই সরকারকে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে।
গতকাল সোমবার বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা বলেছে। এ সময় রাজস্ব খাতে আইএমএফের শর্ত মেনে সরকারের যেসব সংস্কার করতে হবে, সে ব্যাপারে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন প্রতিষ্ঠানটি গবেষণা পরিচালক এম এ রাজ্জাক। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের কাছে এখনো কোনো তথ্য নেই, কোন কোন খাত থেকে কর আসতে পারে। এগুলো স্বচ্ছ করতে হবে।
আহসান এইচ মনসুর নির্বাহী পরিচালক, পিআরআই
পিআরআই বলছে, রাজস্ব আয় বাড়াতে আইএমএফের পক্ষ থেকে এখনো সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা না পাওয়া গেলেও বাজেটের আগে ধাপে ধাপে নির্দেশনাগুলো আসবে। তবে শুধু আইএমএফের চাপে এসব সংস্কার না করে বরং নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতেই এই সংস্কার হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি। তা ছাড়া আইএমএফ যে শর্ত দিয়েছে, তা কঠোর কিছু নয়। সুতরাং এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব।
এম এ রাজ্জাক তাঁর উপস্থাপনায় বলেন, রাজস্ব খাতের ক্ষেত্রে আইএমএফের সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন অসম্ভব নয়। এ জন্য সরকারের সদিচ্ছার পাশাপাশি রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিও বদলাতে হবে। তবে সব ছাপিয়ে কর–জিডিপির অনুপাতে রাজস্ব আয় বাড়ানোর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়া উচিত।
পিআরআইয়ের গবেষণা পরিচালক বলেন, ‘আইএমএফ ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের কর–জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়িয়ে ৮ দশমিক ৩ করার শর্ত দিয়েছে। এই শর্ত পূরণ করতে গেলে বর্তমানে আমাদের যে রাজস্ব আয় আছে, তার থেকে প্রায় ৬৫ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত আয় করতে হবে। এরপরের অর্থবছর অর্থাৎ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের শেষে কর–জিডিপির অনুপাত হবে ৮ দশমিক ৮ শতাংশ।
তাতে বর্তমান রাজস্ব আয় থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে অতিরিক্ত রাজস্ব আয় করতে হবে ৭৩ হাজার কোটি টাকার ওপরে। আর আইএমএফের ঋণ কর্মসূচির সর্বশেষ বছর অর্থাৎ ২০২৫-২৬ অর্থবছরে কর–জিডিপির অনুপাতের লক্ষ্যমাত্রা হচ্ছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এই অর্থবছরে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) বর্তমান আয়ের তুলনায় অতিরিক্ত আরও ৯৬ হাজার কোটি টাকা আয় করতে হবে। সব মিলিয়ে আগামী তিন অর্থবছর শেষে ২ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব আদায় করতে হবে।’
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি। আগের অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করেছে এনবিআর। সুতরাং লক্ষ্য অর্জনে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে প্রায় ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে হবে।
এনবিআরের কাঠামোগত সংস্কার ও মানসিকতার বদল করা না গেলে আইএমএফের শর্ত মেনে রাজস্ব খাতের সংস্কার বাস্তবায়ন করা সরকারের জন্য কঠিন হবে বলে মনে করেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক আহসান মনসুর। তিনি বলেন, ‘সুনির্দিষ্টভাবে আমাদের কাছে এখনো কোনো তথ্য নেই, কোন কোন খাত থেকে কর আসতে পারে। এগুলো স্বচ্ছ করতে হবে। তবে রাজস্ব বাড়ানোর জন্য কোন “সিলভার বুলেট” নেই। সুতরাং কাঠামোগত সংস্কারের মাধ্যমে লক্ষ্যটা কীভাবে অর্জন করা যায়, তা নিয়ে আরও কাজ করতে হবে।’
অনুষ্ঠানে জানানো হয়, মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব আদায়ের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান সর্বনিম্ন দেশগুলোর একটি। এর ফলে বাংলাদেশ শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সামাজিক খাতে পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখতে পারছে না। দেশে এখন স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় জিডিপির ১ শতাংশের কম। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মান হচ্ছে ৩ থেকে ৫ শতাংশ। আর শিক্ষা খাতে ব্যয় জিডিপির প্রায় ২ শতাংশ, যা ইউনেসকোর ঠিক করা লক্ষ্যের অর্ধেক।
পিআরআই রাজস্ব বৃদ্ধি বিষয়ে বিশ্লেষণ করে বলেছে, কর-জিডিপি অনুপাত ৫ শতাংশ বাড়ানো গেলে প্রকৃত জিডিপি ৩ দশমিক ৩ শতাংশ বিন্দু পর্যন্ত বাড়বে আর এতে দারিদ্র্যের হার কমবে ২ দশমিক ২ শতাংশ বিন্দু। এ অবস্থায় কোন কোন ক্ষেত্রে রাজস্ব আদায় বাড়ানো সম্ভব, তারও একটি ধারণা দিয়েছে পিআরআই। যেমন বিদ্যমান কর অব্যাহতি হ্রাস, ব্যক্তি খাতে আয়কর আদায়ব্যবস্থা ও করপোরেট আয়ের অসংগতি দূর এবং মূল্য সংযোজন করের (ভ্যাট) সংস্কার। পিআরআই জানায়, কর অব্যাহতি কমাতে পারলে কর-জিডিপি অনুপাত বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ বিন্দু, ব্যক্তি খাতের আয়কর আদায় ব্যবস্থার অসংগতি দূর করতে পারলে আরও ২ দশমিক ১ শতাংশ বিন্দু এবং ভ্যাটব্যবস্থার সংস্কার করলে বাড়বে দশমিক ৬ শতাংশ বিন্দু।
পিআরআই বলেছে, বর্তমানে আয়করে ৮৫ লাখ নিবন্ধন আছে, কিন্তু রিটার্ন দেয় এর মাত্র এক-তৃতীয়াংশ। আবার বাংলাদেশে করপোরেট করহার সর্বোচ্চ হলেও মোট আদায় কম। কারণ, এখানে মাত্র ২৯ হাজার কোম্পানি করপোরেট কর রিটার্ন দেয়। অথচ নিবন্ধিত কোম্পানির সংখ্যা ২ লাখ ৭৩ হাজার। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে করের আওতা বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে।
পিআরআই সংবাদ সম্মেলনে জানায়, অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাতেই ২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে কর–জিডিপি ১২ দশমিক ৩ শতাংশ করার কথা রয়েছে। সুতরাং যদি আইএমএফের সব শর্ত পালন করা হয়, তাহলেও জিডিপিতে করের অবদান হবে মাত্র ৯ শতাংশ।
এদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পক্ষে অতিরিক্ত এই রাজস্ব আয় সম্ভব কি না, এ ব্যাপারে জানতে চাইলে এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মজিদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি এটাকে অসম্ভব মনে করি না। আর আইএমএফ যেহেতু বলছে, সে ক্ষেত্রে তারাও বাস্তবতার আলোকেই বলছে। তবে এটা অর্জন করতে হলে দরকার আন্তরিকতার। সেই সঙ্গে দক্ষতা ও জনবল নিয়োগের বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। ছিদ্রগুলো বন্ধ করতে হবে। এনবিআরের ভাবমূর্তি বাড়াতে হবে।’
এনবিআরের হিসাব অনুযায়ী, দেশের মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ আয়কর দেন। আর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুকের এক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগই বলেছে, বিশ্বের উদীয়মান দেশ ও এশিয়ার উন্নয়নশীল দেশগুলোয় জিডিপির তুলনায় কর বা রাজস্ব সংগ্রহের হার বাংলাদেশের থেকে বেশ বেশি; অর্থাৎ ২৬ দশমিক ৭ শতাংশ। এমনকি সাব-সাহারা আফ্রিকার দেশগুলোর কর-জিডিপি হারও বাংলাদেশের চেয়ে বেশি; অর্থাৎ ১৭ দশমিক ৮ শতাংশ।
আবার আইএমএফের এক প্রতিবেদনের তথ্য বিশ্লেষণ করে অর্থ বিভাগ বলেছে, কর-জিডিপির হারে নিকটতম প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও বাংলাদেশের অবস্থা খারাপ। যেমন নেপালের কর-জিডিপি অনুপাত ২৩ দশমিক ৩, ভারতের ২০ দশমিক ৩, পাকিস্তানের ১৫ দশমিক ২ এবং শ্রীলঙ্কার ১৩ দশমিক ৩ শতাংশ। সরকারি হিসাবে দেশে বর্তমানে কর-জিডিপি অনুপাত ৭ দশমিক ৮ শতাংশ।