চট্টগ্রাম
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে এবার অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণের পর কারখানায় নিরাপত্তা তদারকির ঘাটতি আবারও সামনে এসেছে। নিয়মিত তদারকি থাকলে সীতাকুণ্ডে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটত না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গত শনিবার বিকেলে সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের কারখানায় বিকট শব্দে হঠাৎ বিস্ফোরণে ছয়জন নিহত হন। গুরুতর আহত হন ২৫ জন। বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে কারখানার আশপাশের অন্তত এক বর্গকিলোমিটার এলাকা। বিচ্ছিন্ন লোহার টুকরা ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। বিস্ফোরণস্থল থেকে প্রায় আধা কিলোমিটার দূর পর্যন্ত উড়ে যায় লোহার পাত।
বিস্ফোরণ যে কারণে
তিনটি কারণে সীতাকুণ্ডে সীমা অক্সিজেন কারখানায় বিস্ফোরণ হতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এই তিনটি কারণ হলো ফিলিং হোস বা যে পাইপ দিয়ে সিলিন্ডারে অক্সিজেন ভরা হয়, সেটিতে ফাটল বা ছিদ্র হওয়া, সিলিন্ডারের ভালভে কোনো ত্রুটি এবং সিলিন্ডারের ভেতরে কোনো ফাটল। তবে কারখানার গ্যাসাধারসহ মূল অংশ উড়ে যাওয়ায় সিলিন্ডার থেকে বিস্ফোরণ ঘটার আশঙ্কা কম বলে মনে করছে বিস্ফোরক অধিদপ্তর।
দুর্ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের পরিদর্শক মো. তোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কারখানাটিতে অক্সিজেন সিলিন্ডারে বিস্ফোরণ ঘটেনি। প্ল্যান্ট থেকে যে কলামের মাধ্যমে অক্সিজেন সিলিন্ডারে ভরা হয়, সেটি বিস্ফোরিত হয়েছে। কী কারণে বিস্ফোরণ হয়েছে, তা নিশ্চিত হতে আরও নিবিড়ভাবে তদন্ত করবেন তাঁরা।
অক্সিজেন গ্যাস নিজে দাহ্য নয়। তবে অন্যকে জ্বলতে সাহায্য করে। গ্যাস আকারে সিলিন্ডারে ভরার সময় চাপ থাকে বেশি। তরল এলপিজির চাপ হলো ৫ ‘বার’ (চাপের একক)। সেখানে গ্যাস আকারে অক্সিজেনের চাপ ১৫৭ বার। অর্থাৎ এলপিজির চেয়ে ৩১ গুণ বেশি চাপ থাকে অক্সিজেন গ্যাসে। অক্সিজেন গ্যাস যে পাইপ দিয়ে প্রবাহিত হয়, সেখানে কোনো ফাটল হলে তা বের হয়ে ধাতব পদার্থের সঙ্গে তীব্রবেগে ঘর্ষণে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে দুটি অক্সিজেন কারখানায় কর্মরত দুজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন।
মালিকপক্ষের গাফিলতি
বিস্ফোরণে বিধ্বস্ত অক্সিজেন প্ল্যান্ট এলাকা আজ রোববার বিকেলে পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটির সদস্যরা। প্রাথমিকভাবে মালিকপক্ষের গাফিলতি চিহ্নিত করা হয়েছে বলে জানান কমিটির বিশেষজ্ঞ সদস্য সুমন বড়ুয়া। তিনি বলেন, প্ল্যান্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানের দক্ষতার অভাব ছিল। আর গাফিলতিও করেছেন তাঁরা। নিরাপদে প্ল্যান্ট পরিচালনার ক্ষেত্রে যেসব বিষয়ে খেয়াল করার কথা ছিল, তা করা হয়নি। এতে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। এমনকি প্ল্যান্টের ইনচার্জ (তত্ত্বাবধায়ক) কারখানা পরিচালনার বিষয়ে পরিপূর্ণ উত্তর দিতে পারেননি। এতে মনে হয়েছে, তাঁর ধারণা পুরোপুরি স্বচ্ছ নয়।
ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মকর্তা বলেন, প্ল্যান্টটি অনেক পুরোনো। এই প্ল্যান্টের যন্ত্রপাতিগুলো যেভাবে রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা ছিল, তা করা হয়নি বলে তাঁদের মনে হয়েছে। এ জন্য যে চাপ তৈরি হয়েছিল, তা সামাল দিতে পারেনি। ফলে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী পরিচালক আবদুল মালেক বলেন, সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের ফায়ার লাইসেন্স ছিল। তবে তারা সেফটি প্ল্যানের জন্য আবেদন করেছিল, যা এখনো অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
তদন্ত কমিটির প্রধান অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসান বলেন, পরিদর্শনের সময় তাঁরা কারখানায় কার্বন ডাই–অক্সাইড ও নাইট্রোজেনের সিলিন্ডার পেয়েছেন। এসব সিলিন্ডার রাখার অনুমোদন ছিল না। তাঁরা দুর্ঘটনার সম্ভাব্য সব কারণ খতিয়ে দেখে দ্রুত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দেবেন। তদন্তে যাঁদের গাফিলতি পাওয়া যাবে, তাঁদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হবে।
দুর্ঘটনা ঘটছেই
সীতাকুণ্ডে একসময় খবরের শিরোনাম ছিল পুরোনো জাহাজ কাটার সময় বিস্ফোরণ বা দুর্ঘটনায় হতাহতের খবর। গত এক দশকে জাহাজভাঙার বাইরে অন্য শিল্পকারখানায় দুর্ঘটনার সংখ্যাও বাড়ছে। সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে গত বছরের ৪ জুন। এদিন সীতাকুণ্ডের কেশবপুরে বিএম কনটেইনার ডিপোতে আগুন থেকে হাইড্রোজেন পার–অক্সাইডবাহী কনটেইনারে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে ৫০ জন নিহত হন। আহত হন শতাধিক। বিস্ফোরণে ডিপোর একাংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। দুর্ঘটনার পর জেলা প্রশাসন ও বন্দরের তদন্ত কমিটির দুটি আলাদা প্রতিবেদনে বিপজ্জনক পণ্য ব্যবস্থাপনায় ঘাটতির চিত্র ওঠে আসে।
এ ঘটনার আট মাসের মাথায় শনিবার সীমা অক্সিজেনে প্ল্যান্টে বিস্ফোরণের ঘটনায় ছয়জন প্রাণ হারালেন। বড় এই দুই ঘটনার বাইরে জাহাজ ভাঙায় দুর্ঘটনার খবরের শিরোনাম হচ্ছে সীতাকুণ্ড উপজেলা। মৃত্যুর ঘটনাও ঘটছে। যেমন জাহাজভাঙা কারখানায় ২০১৮ সালে ১৬ জন, ২০১৯ সালে ২৩ জন, ২০২০ সালে ১২ জন, ২০২১ সালে ১৪ জন এবং ২০২২ সালে ৭ জন নিহত হন।
কারখানার ছাড়পত্র নিয়ে ধোঁয়াশা
সীমা অক্সিজেন কারখানায় ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও কলকারখানা পরিদর্শন পরিদপ্তরের লাইসেন্স থাকার কথা। কারখানার অগ্নিনিরাপত্তার লাইসেন্স হালনাগাদ রয়েছে বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস। বিস্ফোরক অধিদপ্তর মূলত বিস্ফোরক আইন ও গ্যাসাধার বিধিমালা অনুযায়ী গ্যাসাধারের গ্যাস মজুতের লাইসেন্স দেয়। প্রায় ১৫টি শর্তে এই ছাড়পত্র দেওয়া হয়। প্রতিবছর নবায়ন করা হয়।
সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের ছাড়পত্র নবায়ন করা ছিল কি না, জানতে চাইলে আজ দুপুরে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের চট্টগ্রামের পরিদর্শক মো. তোফাজ্জল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, কারখানাটিতে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের লাইসেন্স আছে কি না, তা তাঁর জানা নেই। লাইসেন্স দেওয়া হয় বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ঢাকা কার্যালয় থেকে। সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহের কার্যক্রম চলছে।
বিষয়টি নিয়ে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের ঢাকা কার্যালয়ে যোগাযোগ করা হলে দুজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা তা নিশ্চিত করতে পারেননি। অর্থাৎ দুর্ঘটনার এক দিন পেরিয়ে গেলেও কারখানার ছাড়পত্র নবায়ন করা আছে কি না, তদারকি হতো কি না—এসব বিষয় নিয়ে ধোঁয়াশা রয়ে গেছে।
কাতরাচ্ছেন আহতেরা
বিস্ফোরণে আহত ব্যক্তিদের চিকিৎসা চলছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে। নিহত ছয়জনের মরদেহ তাঁদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। আজ হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) ৬০ বছর বয়সী মাকসুদুল আলমের চিকিৎসা চলছে। তিনি সীতাকুণ্ডের সীমা অক্সিজেন লিমিটেডের কর্মী। বিস্ফোরণে গুরুতর আহত মাকসুদুলকে হাসপাতালে ভর্তির পর রাতে ডান পা হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলা হয়। রোববার সকালে জ্ঞান ফেরার পর তিনি টের পান, একটি পা নেই। তা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
পা কেটে ফেলতে হবে একই কারখানার আরেক কর্মী আতাউল গণি ওসমানেরও (৪৫)। তাঁর বাঁ পায়ের গোড়ালি থেকে ওপরের বেশির ভাগ অংশ হাড়সহ উড়ে গেছে। তীব্র ব্যথায় কাতরাচ্ছেন ওসমান। চমেক হাসপাতালের ২৬ নম্বর অর্থোপেডিক বিভাগে তিনি চিকিৎসাধীন। কর্নেলহাট সিটি গেট এলাকার বাসিন্দা ওসমান প্রায় ১০ বছর ধরে ওই কারখানায় কাজ করছেন।
হাসপাতালে চিকিৎসারত সত্তরোর্ধ্ব নওশাদ সেলিম চৌধুরী প্রায় ২২ বছর ধরে প্ল্যান্টটিতে কাজ করেন। বিস্ফোরণের পর নওশাদ সেলিম চৌধুরীর ঠাঁই হয়েছে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগে। তাঁর মাথায় কাচ ও লোহার টুকরা লেগে ক্ষত হয়েছে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, আঘাত গুরুতর নয়। শুধু ডায়াবেটিসটা নিয়ন্ত্রণে এলে তিনি বাড়ি ফিরতে পারবেন।
হাসপাতালে চোখের আঘাত নিয়ে চিকিৎসা নিচ্ছেন তিনজন। তাঁরা হলেন মো. আজাদ, নাহিন শাহরিয়ার ও মো. সোলায়মান। তাঁদের আঘাতের বিষয়ে হাসপাতালের চক্ষু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক তনুজা তানজিন জানান, তিনজনের একটি করে চোখ খুব বাজেভাবে নষ্ট হয়ে গেছে। তাঁদের দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনা কম। দুজনের অস্ত্রোপচার চলছে। আরও একজনের হবে।
যেন বিধ্বস্ত জনপদ
বিস্ফোরণের পর অক্সিজেন প্ল্যান্টের চারদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে টিন ও লোহার টুকরা। আশপাশের অনেক ভবনের দেয়াল ফেটে গেছে। উড়ে গেছে টিনের চালা। ভেঙে গেছে অনেক ঘরের কাচ। এলাকাবাসী বলছেন, বিস্ফোরণের পরের অবস্থা দেখে তাঁদের মনে হয়, এ যেন এক বিধ্বস্ত জনপদ।
কারখানায় বিস্ফোরণ এতটাই প্রবল ছিল যে তার প্রভাব ছড়িয়েছে আশপাশের অন্তত এক বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে। সিলিন্ডারের লোহার পাত উড়ে গিয়ে পড়েছে আশপাশের ঘরের চালায়। বিকট শব্দে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা। তাঁদের একজন গৃহিণী ডলি আক্তার। গোসল সেরে ঘরে ফেরার সময় বিকট শব্দে আঁতকে ওঠেন তিনি। ঘরের ওপর উড়ে আসা লোহার পাত দেখে তাঁর ভয়টা আরও বেড়ে যায়। কষ্টের টাকায় বানানো টিনশেডের ঘরটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় ভেঙে পড়েন তিনি।
প্ল্যান্ট থেকে প্রায় তিন শ মিটার দূরে ডলি আক্তারের বাড়ি, উপজেলার লালবাগ কেশবপুরে। বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া একটি এলাকার নাম লালবাগ কেশবপুর। পাড়াটিতে প্রায় ৮০টি ঘর আছে। এর মধ্যে অন্তত ২০টি ঘরে লোহার পাত এসে পড়েছে। লোহার পাত পড়েছে খেতেও।
পাড়ার তিন প্রবীণ মো. নাছির, মো. বেলাল, মোহাম্মদ মিয়া জানান, এসব ভারী লোহার পাতের ওজন ৫০০ কেজির কম হবে না। এ রকম লোহার পাত যে তাঁদের পাড়ায় এসে পড়বে কল্পনাও করেননি। কপাল ভালো কেউ হতাহত হননি।
মামলা করবে পুলিশ
কারখানায় বিস্ফোরণের ঘটনায় দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ এনে কারখানা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করবে। সীতাকুণ্ড থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তোফায়েল আহমেদ বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার অভিযান শেষ হলেই মামলাটি রেকর্ড করা হবে।
ওসি তোফায়েল আহমেদ আজ প্রথম আলোকে বলেন, অক্সিজেন কারখানা বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাথমিক তদন্তের কাজ চলছে। এখানে কারখানা কর্তৃপক্ষের অবহেলা আছে। তবে কী ধরনের অবহেলা আছে, সেটা জানতে তদন্ত চলছে। কারা এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, সেটি খুঁজে বের করা হচ্ছে। ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা উদ্ধার অভিযান সমাপ্ত করলেই হতাহত মানুষের নাম-ঠিকানা এজাহারে উল্লেখ করে পুলিশ বাদী হয়ে মামলা করা হবে।