অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারলেই সবার জন্য মঙ্গল

সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেছেন, সামনের জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক করতে পারলে সবার জন্যই মঙ্গল হবে।

দলগুলোকে শেষ মুহূর্তে হলেও সেই চেষ্টা করা উচিত। মানবজমিনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। তার মতে নির্বাচন ব্যবস্থার একটা স্থায়ী সমাধান হওয়া দরকার। না হলে বারে বারে একই পরিস্থিতির উদ্ভব হবে।

জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে তিনি বলেন, এখন যে নির্বাচন আয়োজনের দিকে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে তা হওয়া উচিত ছিল সকল দলের অংশগ্রহণের মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যদিয়ে জনসাধারণ তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করে। এবার এই ব্যবস্থায় মনে হয় সে সুযোগটা তারা পাবে না। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি। এই দলের নেতারা কারাবন্দি। কেউ আবার পালিয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। বিরোধী দলের প্রতি মামলা-হামলা চলছেই।

নির্বাচনটি যেভাবে সকলের অংশগ্রহণমূলক হওয়ার কথা সেটি সম্ভবত হবে না।

রাজনীতিবিদরা সদিচ্ছা দেখাননি বলে নির্বাচনের স্থায়ী কোনো ব্যবস্থা এখনো হয়নি উল্লেখ করে তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলো যখন যারা ক্ষমতায় ছিল, তখন তারা ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য চেষ্টা করেছে। আমরা খুব বেশি দূরে না তাকিয়ে যদি ১৯৯১ এর সময় থেকে দেখি, তাহলেও দেখবো যে, এই সময়ে যারা যখন ক্ষমতায় ছিল তারা তা ধরে রাখার জন্য চেষ্টা চালিয়েছে। ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পরে ১৯৯৬ সালে সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার জন্য একটি নির্বাচন করেছিল। ১৯৯৬ সালের জুন মাসে সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী এনে একটি ব্যবস্থা আনা হয়েছিল। সেটি অনুসারে ’৯৬ সালের নির্বাচন হয়, ২০০১ সালের নির্বাচন হয়। কিন্তু ২০০৬ সালের শেষে এসে যখন সরকারের মেয়াদ শেষ হয় তখন নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন সেটা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যে বড় ধরনের একটি বিরোধ সৃষ্টি হয়। এর পরিণতিতেই তখন ১/১১-এর মতো একটি বিশেষ ব্যবস্থা আসে। এরপরে সেই ১/১১ সরকারের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ২০০৮ সালের নির্বাচন হয়। এরপর আর আমরা নির্বাচন ব্যবস্থাকে সুস্থ করতে পারিনি। ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। তারা সুপ্রিম কোর্টের একটি বিভক্ত রায়কে ধরে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেয়। সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়ের মধ্যে নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বিষয়ে কিছুটা ছাড় দেয়া ছিল। বলা হয়েছিল আরও দুই মেয়াদের নির্বাচন সেই ব্যবস্থায় করা যেতে পারে। কিন্তু সেটা না মেনে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সংসদের মাধ্যমে সংবিধান সংশোধন করে। পরে তারা তাদের সংশোধিত সেই সংবিধান ব্যবস্থার আলোকে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করে চলেছে। এইভাবে ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন করেন। এখন আবার আরেকটি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে। তাই কোনো স্থায়ী সমাধান হচ্ছে না।

সামনের নির্বাচন কেমন হতে পারে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমাদের দেশের ভোটারদের যে হার, সেটি আওয়ামী লীগের প্রায় ৩৯-৪০ শতাংশ। আবার একইভাবে বিএনপিরও প্রায় সমান সংখ্যক ভোট রয়েছে। এর বাইরে জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামীরও কিছু ভোট রয়েছে। এ ছাড়া বাকি ভোটগুলো ফ্লোটিং ভোটারদের। এই ভোটাররা শেষ সময়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে, কাকে ভোট দেবে। যখন কোনো খেলার মাঠে ভালো দল না থাকে তখন আমরা যেমন টিভির সামনে খেলা দেখার জন্য বসি না, ভোটের এই ব্যাপারটিও তেমন। ভোটাররা যদি দেখে যে বড় দুই দলের কেউ অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকছেন তাহলে তারাও আগ্রহী থাকেন না। এর প্রমাণ দেখা গেছে, গুলশানের উপনির্বাচনে। ১০-১১ শতাংশ ভোট পড়েছে। ভোটাররা যাওয়ার আগ্রহ দেখায়নি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী পাস করলেও আওয়ামী লীগের সব ভোটাররা পর্যন্ত উপস্থিত হয়নি। তাহলে ভোটার উপস্থিতি এত কম হতো না। গণতন্ত্রের কথা হচ্ছে- সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং মানুষের মত প্রকাশের নিশ্চয়তা তৈরি করা। এগুলো না হলে তা যথাযথ নির্বাচন বা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া বলা যাবে না।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি আশা করবো, সরকার প্রধান বিরোধী দলকে নির্বাচনে নিয়ে আসার চেষ্টা করবে। আবার প্রধান বিরোধী দলও তাদের দাবি-দাওয়ার ব্যাপারে একেবারেই অনড় থাকবে না। সরকারেরও অনড় অবস্থান থেকে সরে আসতে হবে। উভয়কেই কিছুটা ছাড় দিতে হবে। ছাড় দেয়ার মানসিকতা প্রমাণ করতে হবে। যদি একটি অংশগ্রহণমূলক অবাধ নির্বাচন নিশ্চিত করা যায়, তাহলে দেশের মঙ্গল হবে।

বিদ্যমান ব্যবস্থায় নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কতোটা আশা করছেন এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এখানে বিষয়টি অন্যভাবে দেখতে হবে। প্রধান বিরোধী দলবিহীন যেভাবে নির্বাচন আয়োজনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, যেটাকে ‘একতরফা’ হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে এমনটা হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী এবং প্রশাসনিক রদবদল করার তো প্রয়োজনীয়তা নেই। আর যদি একটি প্রতিযোগিতামূলক ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করা হয় তাহলে অবশ্যই বড় ধরনের রদবদল করতে হবে। এর জন্য নির্বাচনের তারিখ পিছিয়ে দিতে হবে প্রয়োজনে।

তফসিল হয়ে যাওয়ার পরেও দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল থেকে সংলাপের কথা বলা হচ্ছে। এই মুহূর্তে সংলাপ কী হতে পারে? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমার মতে সংলাপ এই মুহূর্তে খুবই প্রয়োজনীয়। তবে এই সংলাপের সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ দেখতে পাচ্ছি। কারণ, প্রধান বিরোধী দলের বড় নেতা যারা সংলাপে অংশ নিতে পারতেন, তাদের প্রায় প্রত্যেকেই আটক হয়ে কারাগারে আছেন। আবার কেউ কেউ পলাতক। তাদের মুক্তি পেতে হবে। তাদের নিজেদের আলাপ-আলোচনার জন্য সময় দিতে হবে। তারপরে সংলাপে বসা যেতে পারে। সংলাপ কেবল এক ঘণ্টা-দুই ঘণ্টার মিটিং নয়। একটি ফলপ্রসূ সংলাপের জন্য প্রয়োজনে একাধিকবার বসতে হবে।

সুষ্ঠু নির্বাচন প্রশ্নে বিদেশিদের তৎপরতার বিষয়ে তিনি বলেন, এটা সবসময়ই ছিল। আমরা আমাদের কাজটি সঠিকভাবে করতে পারি না। তাই বিদেশিরা এসে কথা বলেন। এটা আইনগতভাবে দুষ্টু নয়। কারণ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সনদে আমরা স্বাক্ষর করেছি। মত প্রকাশ তো বড় মানবাধিকার। এর আগে আমরা দেখেছি এখানে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিদেশিরা কথা বলেছেন। কেবল কথা বলাই নয়। বিভিন্ন ব্যবস্থাও তারা নিয়েছেন। এখন আবার নির্বাচন নিয়েও তারা বলছেন। এর আগে যখন বর্তমান ক্ষমতাসীন দল বিরোধী দলে ছিল তখন বিদেশিরা কথা বলেছে। তখন তাদের কাছে সেটি পছন্দ হয়েছে। এখন আবার বিরোধী দলে থাকা বিএনপি’র কাছে বিদেশির গণতান্ত্রিক কথা ভালো লাগতে পারে। আমার স্পষ্ট মনে আছে ১/১১ এর আগে এই দেশে অবস্থানরত বিভিন্ন রাষ্ট্রদূতরা সক্রিয় ছিলেন। তখন তাদের কথা আওয়ামী লীগের কাছে খুবই পছন্দ হতো। তাই বলা যায় যে, বিদেশিরা অতীতেও কথা বলেছে।

তিনি বলেন, আমি মনে করি, যার মাধ্যমে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা তুলে দেয়া হয়েছিল সুপ্রিম কোর্টের কাছে সেই আদেশটি পুনর্বিবেচনার আবেদন করে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা যায়। জনগণের প্রতিনিধিত্ব করে রাজনৈতিক দলগুলো। রাজনৈতিক দলগুলো যদি জনগণের মতামতকে মূল্যায়ন না করে তাহলে আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু বলা যাবে না।

সূত্র : মানবজমিন