From bottomless basket to basket with a hole

by Minar Rashid

তলাবিহীন ঝুড়ি থেকে তলাছেদা ঝুড়ি

( দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত আমার আজকের কলাম)

সাদাসিধে কথার মানুষ এক প্রফেসরের সাদা দিলে কালা লাগিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত একজন ব্রিটিশ লেখক। জিয়া হায়দার নামে এই তরুণ লেখককে নিয়ে প্রফেসর সাব এতটাই হতাশ হয়েছেন যে তাকে ‘বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত’ না লিখে ‘বাংলাদেশী বংশোভূত’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ, প্রতিভাবান এই তরুণ লেখক বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক স্থবিরতা নিয়ে অপ্রিয় একটি সত্য উচ্চারণ করেছেন। তিনি বাংলাদেশকে মৃত চিন্তাভাবনার দেশ বলেছেন।

এই তরুণ লেখকের মন্তব্যটি তাকে বিশেষভাবে আহত করেছে। এই তরুণ মন্তব্য করেছেন, ‘এখানে যখনই নতুন কোনো ধারণার প্রকাশ ঘটে, তখনই তাকে শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়। বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক ও শ্রেণীর বাধায়? নতুন চিন্তা-চেতনা, ধ্যানধারণা বিকশিত হতে পারে না।’

এই কঠিন সত্য কথাটি অত্যন্ত ভারী লেগেছে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের কাছে। এর চেয়েও মর্মবিদারক হলো বিশুদ্ধ গান্ধীবাদী ও অবিশুদ্ধ (কারণ, এ ধরনের লেখা আর কয়েকটি লিখলেই বুদ্ধিজীবীর খাতা থেকে নামটিও কাটা পড়তে পারে) আওয়ামী বুদ্ধিজীবী সৈয়দ আবুল মকসুদ এই লেখককে সমর্থন করে একটি কলাম লিখেছেন। এই প্রফেসর সাব নিশ্চিত ছিলেন যে এই তরুণ লেখকের কথা ভাষার দেয়াল ও তাদের বিশেষ ফিল্টারের বদৌলতে বুদ্ধিবৃত্তিক একটি ক্ষুদ্র পরিসরেই আটকে থাকবে। কিন্তু সৈয়দ মকসুদ বিরাটসংখ্যক পাঠকের কাছে এই তরুণ লেখকের বক্তব্যকে পৌছে দিয়েছেন। এখানে মূল সর্বনাশটি করেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। কাজেই তার গোস্বাটি পড়েছে সৈয়দ আবুল মকসুদের ওপর।

গল্পের সেই ভেজাল তেলের দোকানদারের মতো তিনি আঁতকে উঠেছেন। কারণ, ভেজাল ছাড়া তেল বিক্রি করলে পাবলিক টের পেয়ে যাবে আসল তেলের স্বাদ। তাই মাগরিব নামাজের নিয়াত ছেড়ে দিয়ে দোকানের গোমস্তাকে বেয়াক্কেলি কাজের জন্য ধমক দিতে হয়েছে। বুদ্ধির ভেজালের আড়তদারেরাও একই ধরনের শঙ্কায় ভুগছে। কারণ, জিয়া হায়দার, শর্মিলা বসু ব্ল্যাক কোটের লেখক কানাডিয়ান বাংলাদেশী নেয়ামত ইমামদের মতো ইন্টেলেকচুয়ালদের প্রজ্ঞার সাথে সাধারণ মানুষের পরিচয় হয়ে গেলে এই ডিজুস তেলের মালিকেরা আসলেই বেকায়দায় পড়ে যাবেন।

জিয়া হায়দার এবং সৈয়দ মকসুদকে মিথ্যা প্রমাণ করতে তিনি তার জাদুমাখা বর্ণনায় জাতির অর্জনগুলো বর্ণনা করেছেন। দু-একটা গণিত অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে আর খেলনা উড়োজাহাজের মতো কিছু একটা তৈরি করেই ‘ইউরেকা ইউরেকা’ বলে আকাশ-পাতাল একাকার করে ফেলেছেন। তার অর্জনগুলো সব ডিজুস প্রকৃতির। একটি জাতির বুদ্ধিবৃত্তিক ও সাংস্কৃতিক মানটি কেমন- তা উচ্ছ্বাস প্রকাশের এ ধরনটি থেকেই স্পষ্ট হয়।

চিন্তা করার ক্ষমতা আমাদের কত উন্নত তা দেখাতে অর্জনের তালিকায় ডক্টর ইউনূসের সাথে সাথে গণজাগরণ মঞ্চকেও টেনে এনেছেন। অথচ বিশেষ চেতনার অ্যাকাউন্টে যাদের মগজ পুরো খরচ হয়ে পড়েনি সেসব সুধীজন ওই গণজাগরণ মঞ্চে মধ্যযুগের Lynching mob গড়নের স্পষ্ট ছায়া খুঁজে পেয়েছেন। মধ্যযুগের শেষ দিকে এবং বর্তমান আধুনিক সভ্যতা উন্মেষের আগে আগে এই লিঞ্চিং মবদের উপস্থিতি তখনকার বিচারব্যবস্থাকে কলুষিত করেছে। এরা দল বেঁধে (মঞ্চ বানিয়ে) কোনো ব্যক্তিকে হত্যার জন্য বিচারকের ওপর চাপ সৃষ্টি করত। এরা সমস্বরে বলত, একে ফাঁসি দাও, একে ফাঁসি দাও। এই প্রফেসর সাব ওই লিঞ্চিং মবকে শুধু নৈতিক সমর্থনই করেননি- এই মবের বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্বেও প্রথম কাতারেই ছিলেন।

বলার অপেক্ষা রাখে না, এই প্রফেসর ভদ্রলোক একধরনের আত্মতৃপ্তি বা আত্মতুষ্টিতে ভুগছেন। জিয়া হায়দারকে মিথ্যা প্রমাণের জন্য এবার বেগম খালেদা জিয়াকেও কিছুটা কাছে টেনে নিয়েছেন। লেখাটি দেখে মনে পড়ে যায় এক দেশপ্রেমিক মাতালের কথা। যে মাতাল অন্য মাতালকে উদ্দেশ করে বলছে, ‘আরে ব্যাটা উল্লুক, তুই খাইছোস বিদেশী মদ। আর আমি খাইছি বাংলা মদ। তাতে নেশা কি আমার তোর চেয়ে কোনো অংশে কম হয়েছে?’

এই মাতালের দাবি আর এই প্রফেসরদের ডিজুস দাবির মধ্যে কোথায় যেন একটা সূক্ষ্ম মিল রয়েছে। বাংলা খেয়ে আত্মপ্রসাদে মগ্ন মাতালের মতো এই স্যাররা মনে করেন, তিনি ও তার অনুসারীদের দাবিই সঠিক। এই ডিজুস স্যাররা চিন্তার যে কুয়োয় আশ্রয় নিয়েছেন সেখান থেকে মনে হবে জিয়া হায়দাররা বিভ্রান্ত, পথভ্রান্ত ও বংশোভূত। ব্রিটিশ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যানের ওপর গোস্বা করে বাংলা ভাষা থেকে কিন্তু শব্দটি সরিয়ে ফেলতে চেয়েছিলেন। এই ব্রিটিশ আইনজীবীর ওপর তিনি এতটুকু ক্ষেপেছিলেন যে, ভুলে গেছেন ব্রিটিশদের ভাষা ইংরেজি। টবি ক্যাডম্যানরা ‘কিন্তু’ ব্যবহার করেন না, দরকারমতো জাফর ইকবালদের জন্য অত্যন্ত মোটা ও ভারী ‘বাট’ (But ) প্রয়োগ করেন। এবার জিয়া হায়দারের ওপর রাগ করে নতুন ও অদ্ভুত শব্দ (বংশোভূত) সংযোজন করে বসেছেন।

বাস্তবতা যাই হোক, বাইরের মানুষের মূল্যায়ন যাই হোক না কেন- তারা নিজের নেশা বা চেতনা সম্পর্কে যা দাবি করবে, বাদবাকি সবাইকে সেটাই সঠিক বলে মেনে নিতে হবে। এরা নিজেরা যেটাকে মুক্তচিন্তা বা গণতন্ত্র বলবে, বাইরের সবাইকে তাই মেনে নিতে হবে।

জিয়া হায়দারের মতো একই বিলাতে থেকেও যিনি ডক্টর জাফর ইকবালের চোখে ‘বাংলাদেশী বংশোভূত’ হননি, সর্বোপরি বিলাতে থেকেও যিনি বিলাতি বেগুন না হয়ে দেশী বেগুনই রয়ে গেলেন সেই গাফফার চৌধুরী বলেছেন, আমরা ড. কামালের গণতন্ত্র চাই না- আমরা শেখ হাসিনার গণতন্ত্র চাই।

মজার কথা হলো, এ দেশে এ ধরনের একটা ‘গণতন্ত্র’ আইয়ুব খানেরও ছিল। সেটার নাম ছিল মৌলিক গণতন্ত্র। সাদ্দাম, গাদ্দাফি, আসাদ, হোসনি মোবারক সবারই এ রকম একটা করে নিজস্ব ব্র্যান্ডের গণতন্ত্র ছিল। আর এখন গাফফার চৌধুরী শোনালেন হাসিনার গণতন্ত্র।

কাজেই প্রগতির মিথ্যা দাবিদার এদের চিন্তা-ভাবনা আসলেই স্থবির ও সেকেলে। একধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক লাঠিয়ালপনা এদের মূল সম্বল। তারেক রহমানের সাম্প্রতিক মন্তব্যের বিরুদ্ধে গাফফার চৌধুরীর নিচের মন্তব্যটি লক্ষ্য করুন।

‘বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে একবার একটা কাজে জিয়াউর রহমানের বাড়িতে গিয়েছিলাম, সেখানে গিয়ে দেখলাম জিয়াউর রহমান কোমরের বেল্ট দিয়ে একটা বালককে বেধড়ক পেটাচ্ছেন, পেছনে খালেদা জিয়া দাঁড়িয়ে আছেন। জানতে চাইলাম, মেজর সাহেব তাকে এত পেটাচ্ছেন কেন? সে তো মারা যাবে, তখন জিয়াউর রহমান আমাকে বললেন, বদমাশটা স্কুল থেকে বহিষ্কার হয়েছে। পরে জানলাম ওই বালক জিয়াউর রহমানের জ্যেষ্ঠপুত্র তারেক রহমান। মেয়েদের চুমু খাওয়ার অপরাধে বিএএফ শাহীন কলেজ থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়। এই সেই তারেক রহমান।”

পরে গাফফার চৌধুরী সংশোধনী দিয়েছেন, তিনি ‘কিস’-এর কথা বলেননি, ‘টিজ’-এর কথা বলেছেন। সাংবাদিকদের কান খারাপ থাকায় ঠিকভাবে শুনতে পাননি।

এই সংবাদটি কানাডা প্রবাসী আমার এক মেরিন ইঞ্জিনিয়ার বন্ধু গোলাম আহমেদ মান্নার কাছে পাঠাই। সর্বদা ক্লাসে প্রথম দিকে থাকা আমার এ বন্ধুটি বিএএফ শাহীন স্কুল থেকে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে এসএসসি পাস করেছিল। ঘটনাক্রমে তারেক রহমান তাদের সাথেই ১৯৮০ সালে ক্লাস নাইনে ভর্তি হয়েছিলেন। যতদূর জেনেছি তিনি মাত্র এক বছর শাহীন স্কুলে ছিলেন। আমার বন্ধুটি ছিলেন বিজ্ঞান বিভাগে আর তারেক রহমান ভর্তি হয়েছিলেন মানবিক বিভাগে। তারেক রহমান সম্পর্কে আমার এই বন্ধুটির মন্তব্য, ‘ক্লাসে তেমন মনোযোগী না হলেও খুবই চুপচাপ স্বভাবের ছিলেন তারেক রহমান।’

এ ধরনের নম্র একটি ছেলের পক্ষে গাফফার চৌধুরীর কল্পনামতো মেয়েদের কিস কিংবা টিজ- দুটোই অসম্ভব। গাফফার চৌধুরীর এ মন্তব্যটি দেখে খুবই রেগে গেছেন রাজনীতি থেকে অনেক দূরে থাকা আমার এই বন্ধুটি।

বন্ধুটি আমাকে প্রশ্ন করে, এই গাঁজাখুরি গল্প কোন পাগলে কিংবা ছাগলে লিখেছে?

তার কথা হলো, ১৯৮০ সালে জিয়াউর রহমান অলরেডি প্রেসিডেন্ট। ১৯৭২ সালে তিনি আর্মির ডেপুটি চিফ হয়েছেন। ১৯৭৩ সালে মেজর জেনারেল হয়ে গেছেন। আর তখন কিনা গাফফার চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জিয়ার বাড়িতে গিয়ে এ ঘটনাটি দেখলেন। বেগম খালেদা জিয়ার কাছে প্রশ্ন করেছেন, ‘মেজর’ সাহেব তাকে এত পেটাচ্ছে কেন? আর্মির অফিসার এবং পরিবারবর্গ নিজেদের র্যাংক নিয়ে এতটুকু স্পর্শকাতর যে এ ধরনের সম্বোধন করলে (মেজর জেনারেলকে মেজর সম্বোধন করলে) সেই বক্তার শরীরের সম্মুখভাগ ঠিক থাকলেও পেছনের দিক অন্তত ঠিক থাকত না, এটুকু গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারি।

বন্ধুটির মন্তব্য, এরা যে দেশের বুদ্ধিজীবী সেই দেশ ও জাতির কপালে ছেদা হবে না তবে কার কপাল ছেদা হবে? কাজেই জিয়া হায়দার আমাদেরকে মৃত চিন্তার দেশ বলে কি সত্যিই বড় অন্যায় করে ফেলেছেন?

১৯৮০-১৯৮১ সালে ঢাকার শাহীন স্কুলে কমপক্ষে হাজারখানেক প্রাপ্তবয়স্ক ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা , কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন যারা তারেক রহমানের ওই সময়ের সব ঘটনা এখনো স্মরণ করতে পারেন। প্রেসিডেন্টের ছেলে হিসেবে তার ওপর সবার বিশেষ নজর ছিল। সারা দেশবাসীর সাথে সাথে এদেরকেও থোড়াই কেয়ার করলেন গাফফার চৌধুরী। তেমনিভাবে শত শত ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় দেখা ১৯৭২ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক ছাত্র এবং তার পরপরই যিনি ঢাকার উদয়ন স্কুলের শিক্ষক বা বিডিআর কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল ছিলেন তিনি হয়ে পড়েছেন কসাই কাদের! তেতাল্লিশ বছর পর যাকে আমরা চিনতে পারলাম- যুদ্ধের পরপরই ’৭১-এর দুর্ধর্ষ সেই কসাই কাদেরকে মাত্র দু-এক বছরের ব্যবধানে চিনতে পারলাম না? কাজেই আমাদের মহামান্য আদালত কোনো লিঞ্চিং মব বা এ ধরনের কোনো মব দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েছেন কি না সেই প্রশ্নটিও আমাদের বোধ ও ভাবনাকে আজীবন তাড়া করে ফিরবে। এই সত্য কথাগুলো উচ্চারণ করলেই কেউ তারেকের কিংবা কাদের মোল্লার সমর্থক হয়ে পড়বেন না। দেশের মধ্যে এ ধরনের সত্যবাদী ও সাহসী মানুষের অনুপস্থিতিই চিন্তার স্থবিরতা বা বন্ধ্যাত্বের বড় প্রমাণ।

কাজেই জিয়া হায়দারের কথার মর্মার্থ বোঝার মতো ইন্টেলেকচুয়াল হাইট এসব ডিজুস প্রফেসর ও কলামিস্টদের রয়েছে কি না তা নিয়ে আজ সত্যিই সন্দেহ দেখা দিয়েছে। চরম অপ্রিয় সত্য কথাটি হলো ধর্মের কিংবা অধর্মের- এ দু’টি ব্লকেই মানুষের আবেগকে উসকে দেয়ার কাজটিই বেশি করা হচ্ছে। মানবপ্রজ্ঞা ও প্রকৃত মানবপ্রগতিকে সামনে এগিয়ে নেয়ার কাজটি আদতেই কম হচ্ছে।

একটি জাতির মধ্যে যখন চিন্তার এই বন্ধ্যত্ব দেখা দেয় তখন তার প্রভাব সরাসরি রাজনীতি ও অর্থনীতিতে পড়ে। জাতির জ্ঞানী-গুণীরা তখন লোভী, ধূর্ত, সুবিধাবাদী ও তোষামোদকারী হয়ে পড়ে। চিন্তার এ বন্ধ্যত্বটি নিয়েই আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল।

প্রথমেই আমাদের মগজে ঢুকিয়ে দেয়া হয় অন্য কোনো ইজম বা বাদ নয়- আমাদের অনুসরণ করতে হবে একমাত্র মুজিববাদ। তখন রাস্তায় রাস্তায় স্লোগান শোনা যেত- এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। সেই তাত্ত্বিকেরা গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র মিশিয়ে একটা খিচুড়ি পাক করেছিলেন। নাম দিয়েছিলেন মুজিববাদ।

এই খিচুড়ির বদৌলতে স্বাধীনতা অর্জনের কিছু দিনের মধ্যেই দেশটি হয়ে পড়ে তলাছাড়া বা তলাবিহীন ঝুড়ি। এই মারাত্মক উক্তিটি যিনি করেছিলেন সেই হেনরি কিসিঞ্জার বিশ্বরাজনীতিতে ঠোঁট কাটা হিসেবে সুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন। অন্যদের যেখানে একটি কথা বোঝাতে হাজার হাজার পৃষ্ঠার প্রয়োজন পড়ত- এই স্টেটম্যান এক বাক্যে তা বলে দিতে পারতেন। আমাদের অবিসংবাদিত নেতা সম্পর্কে তার আরেকটি বিখ্যাত উক্তি ছিল- ‘এ ফার্স্টক্লাস এজিটেটর, সেকেন্ড ক্লাস অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এবং থার্ডক্লাস পলিটিশিয়ান।’ এসব কথার কোনো সদুত্তর যেমন আমাদের কাছে ছিল না, তেমনি এসব সমালোচনা থেকে উপকৃত হওয়ার মতো ন্যূনতম বুদ্ধিমত্তাও আমাদের ছিল না।

ইতিহাসের কী চমৎকার পুনরাবৃত্তি! মুজিববাদের জায়গায় এসেছে শেখ হাসিনার গণতন্ত্র!

অনেক কষ্ট নিয়ে এ দেশের মানুষ বলতে বাধ্য হচ্ছে যে, একটি ভুল দলের হাত দিয়ে এ দেশের স্বাধীনতা এসেছে। মুখে মুখে গণতন্ত্রের কথা বললেও এরা গণতন্ত্র কী জিনিস তাই বোঝে না। অন্ধকে যেমন সাদা রঙ চেনাতে গেলে বকের মতো মনে করে বসে। আওয়ামী লীগের কাছেও গণতন্ত্র সেই একই রকম হয়ে গেছে। এই জাতির সবচেয়ে বড় ভুলটি হলো আওয়ামী লীগের মতো একটি ফ্যাসিবাদী দলকে গণতান্ত্রিক দল বলে মনে করা।

পদ্ধতিগত কিছু ত্রুটির জন্য তাদের প্রথম বাকশাল সফল হয়নি বা অসমাপ্ত রয়ে গেছে। অসমাপ্ত সেই কাজটি আপাতত সমাপ্ত করে ফেলেছেন। সব বিরোধী দল বলতে গেলে নিশ্চিহ্ন। কেউ রাজাকার, কেউ জঙ্গি এবং আবার কেউ তাদের সঙ্গী হিসেবে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে। কারো কাঁধে এতিমের টাকা মেরে খাওয়ার খড়গ ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে।

কিন্তু গণতন্ত্রের জন্য দরকার বিরোধী দল। নো প্রবলেম, তারও ব্যবস্থা হয়ে গেছে। বিশেষ ভায়াগ্রা (মেইড ইন ইন্ডিয়া) প্রয়োগ করে বিরোধী দল হিসেবে এরশাদকে দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা এরশাদের ইদানীংকার সরকারবিরোধী লম্ফঝম্ফ সেই ভায়াগ্রারই প্রভাব। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের বিস্ময় এই এরশাদ কঠিন কঠিন কথা বলা শুরু করেছেন সরকারের বিরুদ্ধে। হাসিনা-এরশাদ জুটির ধারণা, এ দেশে ভাত শুধু তারাই খান। দেশের বাদবাকি মানুষ ঘাস খেয়ে বড় হয়েছেন।

এত লুটপাট এত হরিলুটের পরও দেশটি টিকে আছে। এই টিকে থাকাকেই চাঁপাবাজ সরকার তাদের উন্নয়নের লক্ষণ বলে প্রচার করছে। বর্তমান অর্থনৈতিক ও সামাজিক বাস্তবতায় এখন আর হয়তো পুরো তলাটি খসে পড়ার সম্ভাবনা নেই। প্রায় এক কোটি প্রবাসীর কষ্টার্জিত আয় ও জনগণের নিজেদের উদ্যোগে যে প্রাইভেট সেক্টর বিকাশ লাভ করেছে তা এই দেশের তলাটি যে কোনো পরিস্থিতিতে জায়গায় ধরে রাখবে। কিন্তু তলাটিতে অনেক ছেদা বা ছিদ্র সৃষ্টি হয়ে গেছে- তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

আর এই ছিদ্র শুধু অর্থনীতির তলাটিতেই সৃষ্টি হয়নি। সমাজের সব কিছুতেই এই ছিদ্র বা ছেদা স্পষ্ট হচ্ছে। জাফর ইকবাল গং (সরকারের এডুকেশন পলিসির অন্যতম মন্ত্রণাদাতা) এবং নাহিদ গংদের যুগপৎ প্রচেষ্টায় দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে গেছে। সকালে জাফর ইকবাল প্রশ্নপত্র আউটের ব্যাপারে শিক্ষামন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনশন করেন এবং সন্ধ্যায় তার হাত থেকেই পুরস্কার গ্রহণ করেন। তাদের এ ধরনের লেফট-রাইটে দেশের শিক্ষাব্যবস্থা আইসিইউতে।

শিক্ষকদেরকে পড়ানোর তাগিদ দেয়ার চেয়ে পরীক্ষার খাতায় বেশি নম্বর দেয়ার জন্য ফরমান জারি করা হয়। সরকারের সাফল্য দেখাতে গিয়ে গুণধর শিক্ষামন্ত্রী জিপিএ ফাইভ দিয়ে দেশের আকাশ-বাতাস, পথ-প্রান্তর, মাঠ-ঘাট সব ভরে ফেলেছেন। দিল্লি জয়, সমুদ্র জয়, বিলাত জয়, দুবাই জয় ও জাতিসঙ্ঘ জয়ের ধারাবাহিকতায় সর্বত্র এই জয়জয়কার।

বিশ্ব মানে এই শিক্ষা কোন পর্যায়ে পৌছেছে তা আর বলার অপক্ষা রাখে না। লাখে লাখে জিপিএ ফাইভ থেকে খোদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাত্র দু’জনের বেশি ইংরেজি বিভাগে ভর্তির যোগ্য বলে বিবেচিত হয় না! হলমার্ক, ডেসটিনি, কালো বিড়াল, পদ্মা সেতু, শেয়ারবাজার, কুইক রেন্টাল ইত্যাদির মাধ্যমে এই লুটেরারা এ দেশের অর্থনীতির তলাটিই শুধু ছেদা করেনি- অ্যানালগ ও ডিজিটাল বাজিকরেরা মিলে জাতি ও রাষ্ট্রের আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় ছেদা বা ছিদ্র করে ফেলেছে।

স্বাধীনতার ঘোষণার সাথে জড়িত যে মেজর শব্দটি আমাদের বোধ ও ভাবনায় অন্যরকম ব্যঞ্জনা এনে দেয়, সেই মেজরকেই এখন নূর হোসেনরা খুনের জন্য ভাড়া খাটায়। চুক্তিমতো কাজ না পাওয়ায় ধমক দেয়, ‘আরে মিয়া আফনে কেমন মেজুর?’

জাতির সব কিছু ‘ছেদা’ করা নূর হোসেনদের সঙ্গী এই মেজুর-কর্নেলদের শ্বশুর বিরোধী দলকে ঠেঙ্গাতে লুঙ্গি পইরা রাস্তায় নামার হুমকি দিয়েছে। কাজেই শেখ হাসিনার গণতন্ত্র মানে এই মেজুর-কর্নেলদের শ্বশুরদের গণতন্ত্র। মায়া, শামীম ওসমান, আবু তাহের ও হাজারীদের গণতন্ত্র। শেখ হাসিনার গণতন্ত্রের লুঙ্গি ড্যান্সাররা আমাদের গণতন্ত্রকে ছেদা করবে নাকি জনগণ এদের লুঙ্গি ছেদা করবে? এই প্রশ্নের জবাবের ওপর নির্ভর করবে তলাছেদা ঝুড়িটিকে আদৌ মেরামত করা যাবে কি না।