ত্রিপুরার মুসলমানদের অপরাধ কী?

নয়া দিগন্ত | মাসুম মুরাদাবাদী

মুসলমানদের বাড়িঘরে হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। – ছবি : বিবিসি

ভারতের উত্তর-পূর্ব রাজ্য ত্রিপুরাতে কয়েক দিন থেকে পরিস্থিতির উত্তাপ ক্রমেই তীব্রতর হচ্ছে। এখানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীরা মসজিদ, মুসলমানদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠানগুলোর মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেছে। বিগত ১০ দিনের মধ্যে দশের অধিক মসজিদে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে। মুসলমানদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট ও কারখানায় সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়েছে। ফলে মুসলমানরা মারাত্মকভাবে অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন। মসজিদগুলো থেকে আগুনে পোড়া বহু কুরআন মাজিদ ও হাদিসের গ্রন্থ উদ্ধার করা হয়েছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের অসংখ্য কর্মী ত্রিপুরার বিভিন্ন অঞ্চলে র‌্যালি বের করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উত্তেজনাপূর্ণ উসকানিমূলক স্লোগান দিচ্ছে। এ কারণেই ত্রিপুরার মুসলমানরা চরম নিরাপত্তাহীনতার মাঝে সময় পার করছেন। কিছু এলাকায় তারা নিজেদের ঘরবাড়ি ও ব্যবসায়-প্রতিষ্ঠান ছেড়ে নিরাপদ এলাকায় চলে গেছেন। কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী এক টুইটে বলেছেন, ‘ত্রিপুরাতে মুসলমান ভাইদের ওপর সহিংসতা চালানো হচ্ছে। হিন্দুর নামে উগ্রতা সৃষ্টিকারীরা হিন্দু নয়, বরং তারা বহুরূপী।’ অপর কিছু পার্লামেন্ট মেম্বারও ত্রিপুরার ঘটনার জন্য আরএসএসের অঙ্গ সংগঠনগুলোকে দায়ী করেছেন।

মিডিয়ার তথ্যমতে, ধরে নেয়া হচ্ছে এ হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ বাংলাদেশে মন্দিরে হামলার প্রতিক্রিয়া। বেশ কিছু স্থানে বিশ্ব হিন্দু পরিষদ মিছিল বের করে উত্তেজনা ছড়ায়। মূলত ত্রিপুরার মুসলমানদের ওপর বাংলাদেশের ঘটনার প্রতিশোধ নেয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। ত্রিপুরা বাংলাদেশের সীমান্ত লাগোয়া রাজ্য এবং এখানকার মুসলমানরা সংখ্যালঘু। এখানকার বেশির ভাগ বসবাসকারী সেই সব হিন্দু, যারা বাংলাদেশ থেকে এখানে চলে এসে বসবাস করছেন। বাংলাদেশে অক্টোবর মাসের প্রথম ভাগে দুর্গাপূজার সময় একটি মন্দিরে কুরআন অবমাননার পর বিভিন্ন মন্দিরে হামলা হয়। হিন্দুদের ঘরবাড়িকেও লক্ষ্যবস্তু বানানো হলো। এতে ভারত তার তীব্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকারের কাছে হিন্দুদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলে। অথচ বাংলাদেশ সরকার তার আগেই তৎপরতা শুরু করে এবং সহিংসতায় জড়িতদের লক্ষ্য করে পুলিশ গুলিও বর্ষণ করেছে। ফলে কমপক্ষে পাঁচজন বাংলাদেশী মুসলমান মারা যায়। পুলিশ সহিংসতায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ৭২টি মামলা দায়ের করেছে এবং প্রায় ৭০০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী হিন্দুদের এলাকায় গিয়ে তাদের ক্ষতস্থানে মলম দিয়েছেন। কিন্তু ত্রিপুরাতে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সংঘটিত সহিংসতা এবং মসজিদগুলোতে অগ্নিসংযোগ ও ভাঙচুরের ১০ দিন পরও রাজ্য সরকার নিন্দা জানিয়ে না কোনো বিবৃতি প্রকাশ করেছে, না কেন্দ্রীয় সরকার তাদের কোনো খোঁজ-খবর নিয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, ত্রিপুরার মুসলমানদের বিরুদ্ধে সহিংসতায় জড়িত একজন ব্যক্তিকেও এখন পর্যন্ত গ্রেফতার করা হয়নি। সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হচ্ছে, ত্রিপুরার মুসলমানদের কোন অপরাধে শাস্তি দেয়া হচ্ছে? যদি বাংলাদেশে মন্দিরে হামলা হয়ে থাকে, তাহলে ত্রিপুরার মুসলমানদের এর জন্য অপরাধী সাব্যস্ত করা হচ্ছে কেন?

আমরা আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি, যে সময় বাংলাদেশে মন্দিরে হামলার ঘটনায় ভারত তার প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিল, তখন সেখানকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সরকারকে সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘তারা তাদের এখানে সংখ্যালঘুদের ওপর সংঘটিত সহিংসতা বন্ধ করুক। কেননা, এ ধরনের ঘটনার প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশেও হয়ে থাকে।’ বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা উচিত হয়েছে কি না, সে প্রশ্নের দিকে না গিয়ে এ প্রশ্নের দিকে খেয়াল করাটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ যে, শেখ হাসিনা ওয়াজেদ অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ নিয়েছেন। পুলিশ গুলিবর্ষণ এবং অসংখ্য অপরাধীদের গ্রেফতার করে কারাগারে নিক্ষেপ করেছে। বাংলাদেশ ক্যাবিনেটের একজন শীর্ষ মন্ত্রী আক্রান্ত হিন্দু পরিবারগুলোর কাছে গিয়ে সাক্ষাৎ করেছেন এবং তাদের সান্ত্বনাও দিয়েছেন।

এ বিষয়ে আরো কিছু বলার আগে আমরা আপনাদের একটু পেছনে নিয়ে যাচ্ছি। আপনাদের স্মরণে আছে হয়তো, গত বছর শুরুতে দিল্লির উত্তর-পূর্ব অঞ্চলের সালিমপুর, জাফরাবাদ এলাকাগুলোতে সঙ্ঘটিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় বহু মুসলমান নিহত হয়। অথচ পুলিশ অসংখ্য মুসলমানকেই দাঙ্গা বাধানোর অভিযোগে গ্রেফতার করে, যারা আজো কারাগারে বন্দী। ওই চরম ভয়াবহ দাঙ্গার পর পুরো বিশ্ব তাদের অস্থিরতা প্রকাশ করেছে। তুরস্ক ও ইরানের মতো মুসলিম দেশগুলোও যথারীতি ভারতের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছে। কিন্তু ভারত সরকার তুরস্ক ও ইরানের প্রতিবাদকে এ বলে প্রত্যাখ্যান করেছে যে, ‘এটি আমাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়।’ প্রশ্ন হচ্ছে, যদি ভারতে মুসলমানদের ওপর হওয়া অত্যাচারে ইসলামী দেশগুলোর প্রতিবাদ মোদি সরকারের ক্ষেত্রে তার ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ হয়, তাহলে তারা কোন মুখে বাংলাদেশে মন্দির ও হিন্দুদের ওপর হামলার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের কাছে প্রতিবাদ করছেন? (সেটি কি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়?)

ত্রিপুরাতে সহিংসতার শিকার আবদুল মান্নান বিবিসিকে বলেন, ‘আমার বয়স ৪৪। কিন্তু কখনো এমন পরিস্থিতি দেখিনি। এখন বেঁচে থাকাটা কঠিন হয়ে গেছে। হামলার এক রাত আগে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের কর্মীরা তাদের বাড়িতে ভাগোয়া পতাকা টাঙ্গায়।’ আবদুল মান্নান একজন প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী এবং প্রাদেশিক অ্যাসেম্বলির জনৈক সদস্যের নিকটতম আত্মীয়ও। কিন্তু তিনি তার ওপর হামলা প্রতিহত করতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘আমরা যেখানে বসবাস করি, সেখানে মুসলমানদের মাত্র পাঁচ-দশটা বাড়িই রয়েছে। যদি হামলা না থামে, তাহলে আমাদের অন্য কোনো স্থানে গিয়ে থাকতে হবে, যেখানে মুসলমানদের ভালো জনসংখ্যা আছে।’ ত্রিপুরাতে মুসলমানদের জনসংখ্যা শতকরা ১০ ভাগেরও কম। এখানে মুসলমানরা কোনো একটি স্থানে বসবাস করে না। বরং তারা পুরো প্রদেশে ছড়িয়ে আছে। সংখ্যায় কম হওয়ার কারণে তারা সাম্প্রদায়িক অপশক্তিগুলোর সহজ টার্গেটে পরিণত হয়। দেখে মনে হচ্ছে, পুলিশ বিশ্ব হিন্দু পরিষদকে বিশৃঙ্খলা ছড়াতে বাধা দেয়ার পরিবর্তে তাদের পরোক্ষভাবে সাহায্য করছে। উত্তর ত্রিপুরায় বসবাসরত তানিয়া খানম বলেন, হিন্দু উগ্রবাদীরা পুরো প্রদেশে র‌্যালি-মিছিল করছে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। সহিংসতা কয়েক দিন ধরে চলছে। কিন্তু যখনই মুসলমানরা তার বিরোধিতা করছে, তখনই পুলিশ দ্রুত বাধা দিচ্ছে। নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে। ত্রিপুরা স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন অব ইন্ডিয়ার প্রধান শফিকুর রহমানের বক্তব্য- তারা কয়েকটি মসজিদ পরিদর্শন করেছেন। কিন্তু পরিস্থিতি নাজুক হওয়ার কারণে তারা হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকাগুলোর মসজিদে যেতে পারেননি। তিনি বলেন, পুরো ত্রিপুরার মুসলমানরা ভীতসন্ত্রস্ত। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ সব হিন্দু যুবককে উগ্রপন্থী বানিয়ে দিয়েছে। শফিকুর রহমান এ কথাও বলেন, যখন এরা মসজিদে আগুন জ্বালিয়ে চলে যায়, তখন প্রশাসন সেখানে ১৪৪ ধারা জারি করে।’

বিজেপির শাসনামলের এটি সবচেয়ে ভালো দিক যে, এ সময় সাম্প্রদায়িক ও ফ্যাসিবাদী গোষ্ঠী প্রকাশ্যে ছাড়া পেয়ে যায়। মুসলমানদের বিরুদ্ধে বড় থেকে আরো বড় হামলাতেও পুলিশ ও প্রশাসনের কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। এ কারণেই তাদের দুঃসাহস আকাশ ছুঁতে চলেছে। এর বিপরীতে প্রতিবেশী দেশগুলোতে কোথাও যদি হিন্দুদের বিরুদ্ধে কোনো আক্রমণ চলে, তাহলে সে বিষয়ে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এর অন্যতম প্রমাণ সম্প্রতি পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্টের একটি রায় থেকে পাওয়া যায়। ওই রায়ে খায়বারপাখতুনখাওয়ার কারাক অঞ্চলে হিন্দু মন্দিরে অগ্নিসংযোগে জড়িত অপরাধীদের কাছ থেকে ৩৩ কোটি রুপি আদায়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। জরিমানা আদায়ের জন্য অপরাধীদের এক মাসের সময় দেয়া হয়েছে। এর পাশাপাশি, আদালত হিন্দুদের ওই পরিমাণ ভূমিতে মন্দির বানানোর অনুমতি দিয়েছেন, যে পরিমাণ ভূমিতে তারা মন্দির বানাতে চান। সুপ্রিম কোর্টের চিফ জাস্টিস গুলজার আহমদের নেতৃত্বে দুই বিচারকের বেঞ্চ ২০২০ সালের ডিসেম্বরে দলবেঁধে একটি মন্দির ভেঙে ফেলার ঘটনায় নিজেই নোটিশ জারি করেছিলেন। ওই মামলায় ১২৩ জন আসামি। সরকার সেখানেই নতুনভাবে ৩৩ কোটি রুপি খরচ করে মন্দির নির্মাণে হাত দিয়েছে। এ অর্থ এখন মন্দির ভাঙচুরকারীদের থেকে আদায় করা হবে। এর বিপরীতে যদি আপনারা ভারতের পর্যালোচনা করেন, তাহলে দেখতে পাবেন, আদালত ওই সব অপরাধীকেই সসম্মানে মুক্তি দিয়ে দিয়েছেন, যারা ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বরে দিনের স্পষ্ট আলোতে বাবরি মসজিদ শহীদ করেছিল। আদালতই সেখানে রামমন্দির নির্মাণের রায় শুনিয়েছেন, যেখানে দ্রুতগতিতে রামমন্দির নির্মাণের কাজ এগিয়ে চলেছে। এর দ্বারা আপনারা ভালো করেই অনুমান করতে পারবেন, কোন দেশের সংখ্যালঘুরা কেমন আছে।

মুম্বাই থেকে প্রকাশিত দৈনিক মুম্বাই উর্দু নিউজ ৩১ অক্টোবর, ২০২১ হতে ভাষান্তর ইমতিয়াজ বিন মাহতাব
ahmadimtiajdr@gmail.com
লেখক: ভারতের প্রখ্যাত সাংবাদিক ও কলামিস্ট