today-is-a-good-day
Thursday, March 28, 2024

সেকুলারিজমের আড়ালে সমাজ এবং রাষ্ট্র সবসময় নিপীড়ক ছিল

সেকুলারিজমের আড়ালে সমাজ এবং রাষ্ট্র সবসময় নিপীড়ক ছিল

ফরহাদ মজহার     19 January 2020

 

‘প্রথম আলো’র পক্ষে লিখতে গিয়ে জিয়া হাসান বলেছেন অরুন্ধতী রায়ের একটা লেখায় তিনি নাকি বলেছেন, “কংগ্রেসের অধীনে সেকুলারিজম ছিল মূলত একটা খোলস। সেকুলারিজমের আড়ালে সমাজ এবং রাষ্ট্র সবসময় নিপীড়ক ছিল। বিজেপি আসার পরে, অরুন্ধতী বুঝতে পেরেছেন যা ছিল তাও অনেকটুকু ভালো ছিল। ইংরেজিতে কথাটা বোধহয় “that facade was the best thing that India had.”।

নিপীড়নের রূপ অবস্থা ভেদে নানান প্রকার। জাতপাতের নিপীড়ন, পুরানা এশীয় সামন্ত সম্পর্কের নিপীড়ন, পুঁজিতান্ত্রিক নিপীড়ন, পুরুষতান্ত্রিক নিপীড়ন, ইত্যাদি। কোনটিই কংগ্রেসের দোষ না। বরং ভারতীয় সমাজের বাস্তব অবস্থা। পাশা পাশি নানান নিপীড়নের বিরুদ্ধে নানান দিক থেকে নানান ধরণের লড়াইও ভারতে চলছে। তাই আমি অরুন্ধতীর ‘নিপীড়িক’ কথাটা বুঝি নি।হয়তো তিনি এভাবে বলেন নি।

তবে প্রসঙ্গ যখন উঠেছে একটা বিষয় আলোচনা দরকার। কংগ্রেসের অধীনে এবং পাকিস্তানের বিপরীতে সেকুলার ভারতের জন্ম ছিল একটি মিথ এবং প্রচার। যদি দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশ ভাগ হয়ে থাকে তাহলে নেহেরুর ভারত জিন্নাহ’র পাকিস্তানের বিপরীতে হিন্দুরাষ্ট্র হিশবেই জন্মলাভ করেছিল। এটাই ইতিহাস। উভয়েরই জন্ম আধুনিক জাতিবাদের গর্ভে, ধর্মীয় জাতিবাদের ঔরসে। এর সঙ্গে ইসলাম বা হিন্দু ধর্মের সম্পর্ক একান্তই আকস্মিক, বাহ্যিক এবং গৌণ। সমস্যাটা ধর্ম নয়, আধুনিক জাতিবাদের।

অথচ প্রচার চলেছে,পাকিস্তান ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র,কিন্তু ভারত সেকুলার ও গণতান্ত্রিক। এইসকল মিথ ভেঙ্গেছে অনেক আগেই। সাতচল্লিশ শুধু ধর্মবাদী পাকিস্তান নয়,একই সঙ্গে ছিল হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রেরও আরম্ভ। তাহলে সেকুলারিজমের আড়ালে সমাজ এবং রাষ্ট্র সব সময়ই ‘নিপীড়ক’ ছিল, কথাটা অস্পষ্ট, কিছুই মানে দাঁড়ায় না। খোলসের আড়ালে স্রেফ নিরাকার নিপীড়ন ছিল না, সেটা ছিল হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্রেরই সেকুলার নিপীড়ন। এখন খোলস ছেড়ে সাপের মতো নিজের স্বরূপ প্রদর্শন করছে।

এই সত্য এখন বারবার বলা দরকার। কারন এতোকাল দেশভাগের জন্য একতরফা মুসলমান, মুসলিম লীগ, শেরে বাংলা ফজলুল হক ও জিন্নাহকে দায়ী করা চলছিল। যার কোন ঐতিহাসিক সত্যতা নাই। উভয় পক্ষেই সমস্যা রয়েছে। কোন সম্প্রদায়ই দোষগুণের উর্ধে নয়, অন্যদিকে উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এমন ব্যক্তিরা ছিলেন যারা দেশভাগ চান নি। হিন্দু-মুসলমান সহ সবাইকে নিয়েই এক সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলেন। নিরন্তর মুসলমানদেরই অভিযুক্ত করারা মধ্য দিয়ে ধর্ম বিদ্বেষী বাম ও সেকুলার হিন্দু আদতে হিন্দুত্ববাদের হাতকেই শক্তিশালী করেছে। অখণ্ড ভারতের পক্ষে যাদের দাবির মূল বয়ান হচ্ছে দেশ মুসলমানই ভাগ করেছে, হিন্দুদের দোষ নাই, কিম্বা তারা ধোয়া তুলসি পাতা। এখন হিন্দুত্ববাদের আঠা দিয়ে ভারত মজবুত করতে হবে। যেন আর না ভাঙে। মুসলমান যখন দেশ ভাগই করল তাহলে ভারত থেকে এখন মুসলমানদেরও তাড়াতে হবে। আর যেসব হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান দেশে সংখ্যালঘু, তাঁরা ভারতে গিয়ে নির্যাতীত হয়েছেন প্রমাণ করতে পারলেই নাগরিকত্ব পাবেন।

তাই বোঝা দরকার ভারতীয় সেকুলারিজম হিন্দু জাতীয়তাবাদ থেকে আলাদা নয়। হিন্দুত্ববাদ থেকে একে আলাদা করা কঠিন। এ কারণে অধিকাংশ সেকুলার হিন্দু কিম্বা কমিউনিস্ট জ্ঞানে বা অজ্ঞানে হিন্দুত্ববাদের হাতিয়ারে পরিণত হয়।

হিন্দুত্ববাদের নিজেরই দাবি হিন্দুত্ববাদ একটি সেকুলার মতাদর্শ। তাই ভারতীয় সংবিধানে শুরুতে আলাদা করে ‘সেকুলারিজম’) ঢোকানো জরুরি ছিল না। সেটা পরে ঢোকাতে হয়েছে। ভারতীয় সেকুলারিজম সবসময়ই ছিল রাষ্ট্রের হিন্দুত্ববাদী মর্ম ঢেকে রাখবার জোব্বা। মাঝেমধ্যেই জোব্বার ফাঁকে হিন্দুত্ববাদী ভারতের চেহারা মোবারক দেখা যাচ্ছিল। ফুটা জোব্বা সেলাই করার দরকারে এবং বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ণের পরে ভারতের সংবিধানেও সেকুলারিজম ঢোকানো হোল।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র মানেই সেকুলার রাষ্ট্র, আলাদা করে সংবিধানে সেকুলারিজম ঢোকানো প্রয়োজন পড়ে না। কিন্তু বাংলাদেশে রাষ্ট্রের মূল নীতি হিশাবে সেকুলারিজম চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাছাড়া রয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সমাজতন্ত্র। এই তিন আদর্শ মূলত একসঙ্গে মিলেই ফ্যাসিস্ট আদর্শ। সেকুলারিজম ভারতীয় সংবিধানে প্রি-এম্বেলে শুধু নয় একে জুডিসিয়ারির সংবিধান ব্যাখ্যার এখতিয়ার প্র্য়োগ করে সংবিধানের ‘বেসিক স্ট্রাকচার’ তত্ত্বের অন্তর্গত করে নেওয়া হয়েছে। এই তত্ত্বের মতাদর্শিক এবং আইনী যুক্তি হোল কেন্দ্রীভূত ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্রের বলপ্রয়োগের ক্ষমতাকে হাতিয়ার হিশাবে ব্যবহার৷ করা। আইন, আদালত বা সাংবিধানিক ক্ষমতা দিয়েই সেকুলারিজম বলবৎ রাখতে হবে। সেকুলারিজম ইতিহাস, সংস্কৃতি বা ধর্মের পর্যালোচনার অন্তর্গত কোন বিষয় নয়। স্রেফ সংবিধান এবং আইনের বিষয়।

তাই বাংলাদেশ ও ভারতের সেকুলারিজমকে বলা যায় ‘সাংবিধানিক সেকুলারিজম’। অর্থাৎ সমাজ বা জনগণের চিন্তা চেতনা পরিবর্তনের জন্য কঠিন ও দীর্ঘ মেয়াদি লড়াই লাগবে না। আইন, পুলিশ, আদালত দিয়ে সেকুলারিজম রক্ষার ব্যর্থ ও প্রাণান্ত চেষ্টা তাই আমরা এই সব দেশে দেখি।

তাই সেকুলারিজমের আড়ালে নিরাকার ‘নিপীড়ন’ ছিল, এটা ঠিক না। আড়ালে ছিল হিন্দুত্ববাদ। মাত্রার তারতম্য ছিল। তার হিংস্র রূপটাই এখন খোলস ভেঙে বেরিয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে এই দিকটা বোঝা সকলের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

Source: https://www.facebook.com/718000741/posts/10158100335610742/