Minar Rashid
বাংলা ভাষায় এমন কিছু বাগধারা আছে যার কাছাকাছি ফ্ল্যাভারযুক্ত বাক্য পৃথিবীর অন্য কোন ভাষায় দেখা যায় না। তেমনি একটি বাগধারা হলো, দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো। নোবেল কমিটির হাতে যেমন কয়েকটি দুধের গাভী আছে তেমনি নাম জানা বা অজানা কিছু পশ্চিমা সংস্থা কিছু ঘোলের কারখানা স্থাপন করেছে। আমাদের মত দেশে এই সব ঘোলের চাহিদা ব্যাপক। অন্যরা দুধ খেয়ে যতটুকু স্ফুর্তি না করে, আমরা এই সব ঘোল খেয়ে তার চেয়েও ঢের বেশি স্ফুর্তি করি ।
এই ধরনের ঘোল খাওয়ার একটি ছবি আমার ব্যক্তিগত এলবামে রয়েছে। বিশেষ কারণে পাঠকদের সাথে সেই ছবিটি এখানে শেয়ার করছি। হলিউডের ইউনিভার্সেল স্টুডিও তে বেড়াতে গিয়ে ১৯৮৯ সালে এই ছবিটি তুলেছিলাম। ছবিটির পেছনে ছোট্ট একটি দীর্ঘশ্বাস জড়িয়ে রয়েছে। এটি মূলত আমার এলবামে রাখা নষ্ট একটি ছবি। আমি ছিড়ে ফেলতে চেয়েছিলাম। আমার স্ত্রী কী মনে করে যেন রেখে দিয়েছিল।
হলিউডের একটি বিখ্যাত সিনেমার দৃশ্যপট । লোহার শিক ভেঙে নায়িকাকে উদ্ধার করে নায়ক। দৃশ্যটিতে একটা স্পেশাল ইফেক্ট বা বিশেষ টেকনিক ব্যবহার করা হয়েছিল । লোহার শিকের মত দেখতে ওগুলি ছিল আসলে রাবারের শিক। এখানে বেড়াতে আসা অন্য সব দর্শকের মত আমিও নায়কের ভাব নিয়ে শিকটি বাকিয়ে ফেলি।
সে সময় তো আর আজকের মত ডিজিটাল ক্যামেরা ছিল না। কাজেই ছবিটি ওয়াশ করার পর দেখা যায় নাছোরবান্দা এক পিচ্চি পাশে দাঁড়িয়ে পাশের শিকটি বাকাচ্ছে। একই ছবির ফ্রেমে অতি পিচ্চি ছেলে কর্তৃক পাশের শিকটি বাকিয়ে ফেলায় এই ছবি তোলার মূল উদ্দেশ্যটিই মাঠে মারা পড়ে । ছবিটি দেখে মনটি ভীষণ খারাপ হয়ে যায়।
অনেকদিন পর এলবামের সেই ‘নষ্ট ছবিটি নিয়ে নিজের কষ্টের কথাটি মনে পড়ে যায়। আমাদের প্রধানমন্ত্রী পরিবেশ বিষয়ক ‘ চ্যাম্পিয়ন অব দ্য অার্থ ‘ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এটা নিয়ে সমর্থক গোষ্ঠির আহলাদ কিংবা উচ্ছাসের যেন কোন সীমা পরিসীমা নেই। শিল্পী, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী কূলের উল্লাসে সারা দেশ কয়েকদিন হাওয়ায় ভেসেছে। সতের বছরের মালালা নোবেল পুরস্কারের সংবাদটি পেয়ে যতটুকু সংযম দেখাতে পেরেছিল ( সংবাদটি শুনেও সেই দিন এই বালিকা যথারীতি স্কুলের সবগুলি ক্লাস চালিয়ে গেছে) আমাদের সত্তর বছরের নেত্রী ও গড়পরতা আশি বছরের সমর্থককূল পরিবেশ সংক্রান্ত এই ঘোলটি পেয়ে সেই পরিমাণ সংযম দেখাতে পারেন নি।
রাবারের শিক বাকিয়ে হলিউডের নায়ক যেমন করে তার বাহাদুরি প্রদর্শন করেন, আমাদের ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য অার্থ’রা তেমন ভঙ্গিতেই জনগণকে তাদের মাসল প্রদর্শন করেছেন।
এই কিছিমের অন্য একজন ‘চ্যাম্পিয়ন’ হয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বর্তমান গভর্ণর। যুক্তরাজ্যের একটি সংস্থা তাকে সেরা গভর্ণর হিসাবে ডিক্লেয়ার করেছেন। যার সময়ে দেশে সব চেয়ে বড় ব্যাংক ডাকাতিগুলি সংঘটিত হয়েছে, যার সময়ে শেয়ার বাজারে তেত্রিশ লাখ বিনিয়োগকারী সর্বস্বান্ত হয়েছে, যার সময়ে ছয় সাত বছরে খেলাপি ঋণ ২২ হাজার কোটি টাকা থেকে লাফিয়ে প্রায় ৭৫ হাজার কোটি টাকা হয়েছে , যার সময়ে বেশ কয়েকটি সরকারী ব্যাংক ফতুর হওয়ার পথে বসেছে সেই গভর্ণর চ্যাম্পিয়ন বা সেরা না হলে আর কে হবে? আওয়ামী লীগের প্রচার সম্পাদক ও প্রাক্তন মন্ত্রী হাছান মাহমুদও নাকি এই ধরনের আরেকটি পুরস্কার বগলদাবা করেছেন। আমরা নিজেরা নিজেদের রত্নদের চিনতে পারি নি। কাজেই বিদেশী ঘোল কোম্পানীরা আমাদেরকে নিজের দেশের রত্নদের চিনিয়ে দিচ্ছে।
ছোট্ট পিচ্চিটি আমার হলিউডের ঘোল খাওয়ার ছবিটি যেমন করে নষ্ট করে ফেলেছিল, তেমনি বাংলাদেশের আরো দুজন চ্যাম্পিয়ন অব দ্য অার্থ প্রেজেন্ট থাকায় বর্তমান চ্যাম্পিয়নের গুরুত্ব অনেক খানি ম্লান করে ফেলেছে। ২০০৫ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতি (বেলা)র সৈয়দা রেজওয়ানা হাসান এবং ২০০৮ সালে পরিবেশ বিজ্ঞানী ডঃ আতিক এই একই ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য অার্থ’ পুরস্কারটি পেয়েছেন। কাজেই বর্তমান চ্যাম্পিয়নের পাশে বাকি দুজনকে দেখে জনগণ মালুম করে নিবে যে এখানেও শিকটি লোহার নয়, রাবারের।
সেদিনের সেই ক্যামেরা ম্যান যেমন করে বুঝতে পারে নি যে কখন ক্লিক করতে হবে, তেমনি সরকারের পক্ষ থেকে যারা এসবের আয়োজন করেছেন তারাও বিষয়টি ঠিকভাবে মালুম করতে পারেন নি। দেশবাসীকে বোকা বানানো এবং নেত্রীকে খুশী করতে গিয়ে নিজেরাই আজব চিড়িয়াতে পরিণত হয়ে পড়েছেন। কোনদিন সুযোগ আসলে জনগণ এই সব চিড়িয়াদেরকে একজন একজন করে খুঁজে বের করবে।