Site icon The Bangladesh Chronicle

Sinking ship and whose uncle am I?

Minar Rashid

‘মুই কার খালু’ ও কাত হওয়া জাহাজ

(দৈনিক নয়াদিগন্তে প্রকাশিত আজকের উপসম্পাদকীয় কলাম)

আব্রাহাম লিংকন গণতন্ত্রের সংজ্ঞায় লিখেছিলেন, ডেমোক্র্যাসি অব দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল অ্যান্ড ফর দ্য পিপল। গণতন্ত্রের মানসকন্যা, তার সমর্থিত বুদ্ধিজীবীকুল ও কথিত ‘মুই কার খালু’কুল সবাই মিলে এটাকে ‘ডেমোক্র্যাসি অব দ্য পাহলোয়ান, বাই দ্য পাহলোয়ান অ্যান্ড ফর দ্য পাহলোয়ান’ বানিয়ে ফেলেছেন।

এই ‘মুই কার খালু’কুল সম্পর্কে দু-একটি কথা বলা দরকার। তা না হলে উল্লেখিত বিষয়টি অনেকেই ধরতে পারবেন না। ব্যারিস্টার রফিক-উল হক একবার তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তার ব্যাপারে বিএনপি সাথে সাথেই তাদের অনাপত্তি জানিয়ে দেয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে তাকে উপহাস করে বলেছিলেন- মুই কী হনু রে, মুই কার খালু রে?

আজ জানা যাচ্ছে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর আসলেই ‘খালু’ ছিলেন। ব্যারিস্টার সাহেব শেখ হাসিনার পছন্দের মেয়রপ্রার্থী আনিসুল হকের শ্বশুর।

যা হোক, প্রধানমন্ত্রীর সেই তিরস্কারের পর থেকেই ‘মুই কার খালু’কুল আরেকটু সতর্ক হয়ে পড়েছেন। জাতির খালু বা জাতির বিবেক না হয়ে জনপ্রিয় মিডিয়ার সুপ্রিয় ‘খালু’ হতেই এদের আগ্রহ বেশি। ‘মুই কার খালু’কুল সত্য কথা বলার চেয়ে নিরপেক্ষ বা মাঝামাঝি কথা বলতেই বেশি আগ্রহী। অর্থাৎ কথাটি যত ন্যায্য ও খাঁটি হোক না কেন, তাতে নিজেদের নিরপেক্ষতা নষ্ট হবে ভেবে চুপ মেরে যান। এই ভাবনা জাতি হিসেবে আমাদেরকে আসলেই পঙ্গু বানিয়ে ছেড়েছে।
আওয়ামী বলয়ের খালুরা যে ভঙ্গিতে বিএনপিকে পরামর্শ দিতেন, এখন ব্যারিস্টার রফিক-উল হকের মতো নিরপেক্ষ ব্যক্তিত্বও সেই একই ভাষা ও ভঙ্গিতে বিএনপিকে পরামর্শ দেয়া শুরু করেছেন। তিনি বলেছেন, বিএনপি থেকে জামায়াত আলাদা হয়ে গেলেই দেশের সমস্যা কমে যাবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা ভালো, এ কথাটিই আওয়ামী লীগের বর্তমান রাজনৈতিক দর্শনের অন্যতম প্রধান ভিত্তি।

কারণ, ২০ দলীয় জোট ভাঙলেই ২০৪১ সাল পর্যন্ত দেশে আর কোনো সমস্যা থাকবে না। নতুন এই ‘খালু’ সম্ভবত সে কথাটিই বোঝাতে চেয়েছেন।

কারণ, জামায়াত বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক বাস্তবতা। এই দেশে যেকোনো সরকারের বিরুদ্ধে যেকোনো আন্দোলনকে সফল করতে জামায়াতের অংশগ্রহণ এক ধরনের আবশ্যিকতা হয়ে পড়েছে। জামায়াত বাংলাদেশের রাজনীতিতে পরম আকাংক্ষিত। সবাই কাছে পেতে চায়, কিন্তু সাহচর্যের বদনাম কেউ নিতে চায় না।

বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই আন্দোলনটিতে জামায়াতকে দরকার হয়ে পড়েছিল। আওয়ামী লীগের সেই প্রয়োজন বা রাজনৈতিক বাস্তবতাটি খুশি মনেই গ্রহণ করেছিলেন জাতির সব মামু ও খালুগণ। তখন জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার জন্য খালুরা আওয়ামী লীগকে কোনো পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে মনে পড়ে না। বিএনপি জামায়াতকে ত্যাগ করলে আবারো যদি আওয়ামী লীগ কাছে টেনে নেয়, তবে তারা তখনও সম্ভবত চুপ মেরে যাবেন।

আজ শুধু সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পুনঃপ্রতিষ্ঠাই দরকার হয়ে পড়েনি, জাতির ওপর জগদ্দল পাথরের মতো অঘোষিত একদলীয় ব্যবস্থা চেপে বসেছে। এটা সরানোও জাতির সম্মুখে একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এই কঠিন মুহুর্তে খালুরা বিএনপির হাত পাটি যতদূর সম্ভব বাঁধতে চাচ্ছেন!

পৃথিবীতে যুদ্ধ করা অপরাধ নয়। তাই ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের সবাই যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সাব্যস্ত হয়নি। তাদের ১৯৫ জন অফিসার যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল, কিন্তু উপমহাদেশের শান্তির কথা চিন্তা করে মূল যুদ্ধাপরাধী ১৯৫ জন পাকিস্তানি আর্মি অফিসারকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। বলা হলো, বাঙালি ক্ষমা করতে জানে। মূল যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করার পর তাদের অক্সিলারি ফোর্স বা সহায়তাকারীদের জন্য সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করা হয়। শুধু ফরগিভ নয়, ২০-২৫ বছরের মধ্যেই সব কিছু ফরগেট করে তাদেরকে সাথে নিয়ে একসাথে আন্দোলন করা হয়। এখন ৪০ বছর পর সেই জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধী বানিয়ে বিচার- তা এই রাজনৈতিক গণনা থেকেই শুরু বলে স্পষ্ট প্রতীয়মান হচ্ছে। ময়মনসিংহের ১৮-১৯ বছরের রাজাকার কমান্ডারের ফাঁসি দেয়া হয়েছে, অথচ ময়মনসিংহ জেলার তদানীন্তন ডিসি, যিনি ওই অঞ্চলের সব রাজাকারের নিয়োগদাতা ছিলেন, তাকে পরম আদরে কাছে টেনেছে এই সরকার।

গৃহস্থের বাড়িতে ডাকাত উঠে যেমন করে তাকে বারবার বাপ ডাকায়, আজ জাতির যেন হয়েছে সেই দশা। বিপন্ন জাতিকেও বিশেষ ভাবে আটকে ফেলে যুদ্ধাপরাধী ও গণতন্ত্রসহ সব কিছুর নতুন সংজ্ঞা শেখানো হচ্ছে।

‘জাতির বিবেক’ বলে এত দিন যাদেরকে গণ্য করা হয়েছে, তাদের ভূমিকাও হতাশাজনক বলে মনে হচ্ছে। সময়ের প্রয়োজনে সত্য কথা বলার চেয়ে তারাও রেজিমের মনোবাঞ্ছা পূরণে ব্যস্ত। ভীতিবাদ ও সুবিধাবাদে প্রশাসনযন্ত্র অনেকটাই বিকল হয়ে পড়েছে।

বেনজীর-শহিদুল-আজিজের র‌্যাব-পুলিশ-বিজিবির সরাসরি গুলির মুখে টিকতে পারার মতো পাহলোয়ান সঙ্গত কারণেই কম থাকবে। এব্যাপারে বিশেষ ঘরানার মিডিয়া তাদের কাজ শুরু করে দিয়েছে। তিন মাসের আন্দোলনের ফলাফল শূন্য বলে ঘোষণা দিয়েছে। তার দেখাদেখি বাকিরাও এই কোরাসে যোগ দিয়েছে। শুধু সাধারণ জনগণই নয়, ২০ দলীয় জোটের কর্মী-সমর্থকেরাও এতে কিছুটা বিভ্রান্ত। স্বৈরাচারের প্রকৃত চেহারাটি আড়াল করে বিরোধী দলের অক্ষমতাটিই তারা ইনিয়ে-বিনিয়ে তুলে ধরছেন।

কিন্তু আজকে যারা গণতন্ত্রের পাহলোয়ান সেজে বসেছেন, তাদের চেহারাও জাতি স্মরণে রেখেছে। এক-এগারোতে যখন শেখ হাসিনাকেও গ্রেফতার করা হয়, তখন এই পাহলোয়ানরা দেশের কোথাও একটা মিছিলও বের করতে পারেননি। তখন সাহস করে যে দু-একজন সাব-জেলের সামনে টিফিন ক্যারিয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতেন, মাঝখান থেকে তাদের ভাগ্য খুলে গেছে। ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব নিহত হলে একমাত্র কাদের সিদ্দিকী ছাড়া আর কেউ কোনো প্রতিরোধ সৃষ্টি করেনি।

কাজেই আজ যারা বিএনপি নেতাদের সাহস ও ‘হ্যাডম’ নিয়ে টিটকারি-মশকারা করছেন, তাদের জন্য ওপরের বিষয়টি স্মরণ রাখলে ভালো হয়। এমন পাহলোয়ান কখনোই দেখা যায় না যে, এক দিকে গুলি ছোড়া হবে, অন্য দিক থেকে মিছিল নিয়ে এগিয়ে যাবেন। সরকারের এই খুন-গুম-গুলির সামনে এবার যে মানুষেরা এগিয়ে এসেছেন, তাদের সাহসের অবশ্য তারিফ করতে হয়। এমন কঠিন আন্দোলন স্বাধীনতার পর আর কখনো সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে হয় না।

গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষের শক্তির অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার চেয়ে স্বৈরতন্ত্রের নিষ্ঠুরতা, বেহায়াপনা ও কদর্যতাই বর্তমান অবস্থায় উত্তরণে মূল ভূমিকা রেখে চলেছে। এ দেশে স্বৈরাচারী হিসেবে সনদপ্রাপ্ত এরশাদ জানিয়েছেন যে, স্বৈরতন্ত্রের নিক্তিতে তার বর্তমান নেত্রী তাকেও ছাড়িয়ে গেছেন।

স্বৈরতন্ত্রকে টিকিয়ে রাখতে সবচেয়ে বড় নিয়ামক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে দুর্ভাগ্যজনকভাবে এ দেশের গণমাধ্যমের একাংশ। এদেশের গণমাধ্যমের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হলো, এটি এক দিকে কাত হওয়া (বাম দিকে)। ফলে পুরো দেশ ও জাতি নামক জাহাজটিও এক দিকে কাত হয়ে পড়েছে। নেভাল আর্কিটেক্ট বা মেরিন ইঞ্জিনিয়ার মাত্রই জানেন, একটি কাত হওয়া জাহাজ কতটুকু ঝুঁকি নিয়ে চলাফেরা করে। কাত হওয়া জাহাজের মতো এক দিকে কাত হওয়া মিডিয়া জাতিকে তেমন ভয়ঙ্কর অবস্থায় ঠেলে দিয়েছে। নিজের দিকে জাহাজটিকে কাত করাতে পেরে বুদ্ধিজীবী বা সুশীল নামক গণতন্ত্রের পাহলোয়ানরাও পুলকিত। কিন্তু তারা উপলব্ধি করতে পারেন না যে, ১৬-১৭ কোটি বনি আদমসহ তাদের নিজেদের জীবনও এতে ঝুঁকিতে পড়ে যায়। কারণ, তারাও একই জাহাজের যাত্রী। জাহাজটি উল্টে গেলে সবাইকে মরতে হবে।

কাজেই যেভাবেই হোক এই কাত হওয়া জাহাজটিকে আজ সোজা করতে হবে। জাতির অনেক ‘বিবেক’ দাঁড়িয়ে গেছেন। ভবিষ্যতে আরো অনেকেই এসে এই কাজে শরিক হবেন। মূল ধারার মিডিয়ার এ ধরনের দুর্গতি দেখে বিকল্প সামাজিক মাধ্যমগুলো এগিয়ে এসেছে। একটু সময় লাগলেও তারা এই কাত হওয়া জাহাজটিকে সোজা করতে পারবেন বলেই আমার বিশ্বাস।

গণতান্ত্রিক সংগ্রাম বা যুদ্ধে দু-একটি প্রচেষ্টা অসফল হলেই হতাশ হওয়ার কোনো কারণ নেই। কারণ, এ ধরনের দু-একটি Battle-এ আপাতব্যর্থতা দেখা গেলেও সার্বিক War-এ গণতন্ত্রের বিজয় অনিবার্য।

Exit mobile version