Site icon The Bangladesh Chronicle

Police brutally killed Maulana Nasir. Holding his beard and shooting through his head

P1_Lead

গোবিন্দল গ্রামের মানুষের একটাই প্রশ্ন—কী অপরাধ ছিল মাওলানা নাসিরের? কেন পুলিশ তার পায়ে পাড়া দিয়ে দাড়ি ধরে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করল? মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলার একটি অজপাড়াগাঁ গোবিন্দল। ওই গ্রামে গত ২৪ ফেব্রুয়ারি নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের ওপর পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান চারজন। তারা হলেন গোবিন্দল গ্রামের কুড়া-ভুসি ব্যবসায়ী মাওলানা নাসির উদ্দিন (৩৫), মাদরাসা ছাত্র ও ইমাম হাফেজ মো. শাহ আলম (২৪), কৃষক আলমগীর হোসেন (৩০) ও স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী নাজিম উদ্দিন মোল্লা (২৫)। গ্রামের মানুষের প্রশ্ন, মিছিলে না গিয়েও কেন প্রাণ দিতে হলো হাফেজ ও ইমাম মো. শাহ আলমকে। কী অপরাধ কৃষক আলমগীর ও স্বেচ্ছাসেবক দল কর্মী নাজিম মোল্লার।
আজ থেকে ঠিক এক মাস আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার সরেজমিন অনুসন্ধানে গতকাল সিংগাইরের গোবিন্দল গ্রামে গিয়ে দেখা যায় মানুষ এখনও ক্ষুব্ধ। গ্রামের মানুষ একবাক্যে জানান, সেদিন থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকসহ কয়েকজন নেতার ইন্ধনে এক রকম বিনা উসকানিতে নিরীহ মানুষের ওপর বর্বর হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল পুলিশ। পুরো গ্রাম ছিল রণক্ষেত্র। একাত্তরের রণাঙ্গনেও ওই গ্রামে এত গোলাগুলি হয়নি। শুধু হত্যাকাণ্ডেই সীমাবদ্ধ থাকেনি পুলিশ, ওই ঘটনার জের ধরে এখন চলছে গ্রেফতারবাণিজ্য। ফলে প্রায় পুরুষশূন্য পুরো গ্রাম। রাতে কেউ ঘরে ঘুমাতে পারেন না। দিনের বেলাতেও হাটবাজারে যান না। অনেকে চলে গেছেন দূরে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে। গ্রামবাসীর কাছে এখন পুলিশ এক আতঙ্কের নাম।
গোবিন্দল গ্রামের মানুষ জানায়, মাওলানা নাসির উদ্দিন একজন নিরীহ, ভদ্র ও ধার্মিক ব্যক্তি হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিলেন। দাওরায়ে হাদিস পাস করার পর মসজিদে ইমামতি ও মাদরাসায় শিক্ষকতা করেছেন তিনি। বছর দেড়েক আগে ইমামতি ও মাদরাসার চাকরি ছেড়ে জীবিকার তাগিদে গোবিন্দল বাজারে খৈল, কুড়া ও ভুসির ব্যবসা শুরু করেন। ব্যবসা ভালো না হওয়ায় ওমান যাওয়ার জন্য আদম বেপারির কাছে টাকা জমা দিয়েছেন। পাসপোর্ট করেছেন। নাসির উদ্দিনের স্ত্রী রোমানা আক্তার (২২) জানান, ঘটনার দিন তার জা (দেবরের স্ত্রী) হেলেনা ঘরের ভেতরে গুলিবিদ্ধ হন। পুলিশ গুলি শুরু করার পর বৈদ্যুতিক গোলযোগ হওয়ার আতঙ্কে হেলেনা মেইন সুইচ বন্ধ করতে যান। ওই সময় টিনের বেড়া ভেদ করে হেলেনার গায়ে একটি গুলি লাগে। নাসির তখন দোকানে ছিলেন। তাকে মোবাইল ফোনে জানানো হয়, তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী হেলেনা গুলিবিদ্ধ। তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়েছে। তিনি যেন কিছু টাকা নিয়ে দ্রুত হাসপাতালে যান। নাসির দৌড়ে বাড়িতে গিয়ে বিদেশে যাওয়ার জন্য জমানো টাকা থেকে কিছু টাকা নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে দৌড়াতে থাকেন। গোবিন্দল নতুনবাজার ব্রিজের কাছাকাছি যাওয়া মাত্রই কয়েকজন পুলিশ তাকে ঘিরে ধরে। একজন পায়ে পাড়া দিয়ে যাতে নড়াচড়া করতে না পারেন, আরেকজন চুল ধরে, একজন দাড়ি ধরে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন মাওলানা নাসির। মুমূর্ষু অবস্থায় তাকে ঢাকায় হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি মারা যান। মাওলানা নাসির উদ্দিন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন কিনা বা মিছিলে গিয়েছিলেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে নাসিরের স্ত্রী রোমানা ও তার ভাবী তাজনাহার জানান, নাসির কখনোই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিল না। সে মিছিলেও যায়নি। হেলেনা গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে সে টাকা নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা দেয়। নাসির যে টাকা নিয়ে গেছে সে টাকা উদ্ধার হয়েছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে রোমানা ও হেলেনা জানান, শুনেছি সেগুলো পুলিশ নিয়ে গেছে। কত টাকা সেটা নিশ্চিত জানাতে পারেননি তারা।
নাসিরের ভগ্নিপতি ইসব বেপারি জানান, তার শ্যালকের বউ হেলেনা গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর তিনি ভ্যানে দ্রুত তাকে নিয়ে হাসপাতালে রওনা দেন। নাসিরকে ফোন করে কিছু টাকা নিয়ে হাসপাতালে যাওয়ার জন্য বলেন। হাসপাতালে যাওয়ার সময় নাসিরকে গুলি করে ফেলে যায় পুলিশ। ইসব বেপারি বলেন, বিদেশে যাওয়ার জন্য জমানো টাকা থেকে নাসির পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে রওনা দিয়েছিল। ওই টাকাও পুলিশ নিয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সিংগাইর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (মিঠু) জানান, ছোট ভাইয়ের স্ত্রী গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর শুনে নাসির দৌড়ে বাড়িতে যান। সেখান থেকে টাকা নিয়ে দৌড়ে হাসপাতালের উদ্দেশে রওনা হন। পথিমধ্যে নতুনবাজার ব্রিজের দক্ষিণ পাশে পুলিশ তাকে আটক করে। নাসিরের মুখে দাড়ি দেখে কয়েকজন পুলিশ তাকে ঘিরে ধরে এবং শিবির বলে গালি দেয়। একজন পুলিশ পায়ে পাড়া দিয়ে মাথার চুল ধরে। আরেকজন দাড়িতে ধরে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ফেলে যাওয়ার পর গ্রামবাসী প্রথমে সিংগাইর হাসাপাতালে পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়। কিন্তু ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়ার পর চিকিত্সক জানান, মাওলানা নাসির মারা গেছেন।
ঘটনার অপর প্রত্যক্ষদর্শী গোবিন্দল নতুনবাজারের দোকানি হাশমত আলী জানান, মাওলানা নাসির বাড়ি থেকে দৌড়াতে দৌড়াতে তার দোকানের দক্ষিণ পাশে পৌঁছেন। ওই সময় পুলিশের গুলিবর্ষণ বন্ধ হয়ে গেছে। হঠাত্ নাসিরকে ধরে পুলিশ জামায়াত-শিবির ও রাজাকার বলে গালি দেয়। নাসির তাদের কাছে কাকুতি মিনতি করে ছোট ভাইয়ের বউ হেলেনার গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর জানায়। কিন্তু পুলিশ তার কথা শোনেনি। এক পুলিশ তার দাড়ি ধরে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে গুলি করে। নাসিরের কাছে থাকা টাকাগুলোও পুলিশ নিয়ে গেছে বলে দাবি করেন হাশমত আলী।
মাওলানা নাসিরের বৃদ্ধ মা ফাতেমা বেগম ছেলের শোকে এখন পাগলপ্রায়। চার বোন ছয় ভাইয়ের মধ্যে নাসির তৃতীয়। সত্তর বছর বয়সী ফাতেমা বেগম ছেলের শোকে বারবার মূর্ছা যাচ্ছেন। নাসির প্রায় ছয় বছর আগে পার্শ্ববর্তী নইলাইন গ্রামের দুদ মিয়ার মেয়ে রোমানাকে বিয়ে করেন। তামিম হোসেন নামে তাদের তিন বছরের একটি ছেলে আছে। নাসিরের স্ত্রী জানান, তার স্বামী ওমান যাওয়ার জন্য আদম বেপারির কাছে টাকা জমা দিয়েছেন। ওই আদম বেপারির নাম ঠিকানা তাকে বলেননি। পুলিশের তপ্ত বুলেট তাদের সব স্বপ্ন চুরমার করে দিয়েছে। এখন ভাই ও দেবর ভাসুরদের ওপর নির্ভর করে তাকে বেঁচে থাকতে হবে। মাত্র তিন বছর বয়সী ছেলেকে নিয়ে চোখেমুখে অন্ধকার দেখছেন রোমানা।
হাফেজ শাহ্ আলমের মা ও বোন এখন পাগল : পুলিশের গুলিতে নিহত মাদরাসা ছাত্র শাহ আলমের বাড়ি গোবিন্দল জৈল্লাপাড়া এলাকায়। কোরআনে হাফেজ শাহ আলম ছিলেন পার্শ্ববর্তী ডুবাইল জামে মসজিদের ইমাম। তিনি গোবিন্দল রাশেদিয়া মাদরাসা থেকে হেফজ শেষে গোবিন্দল মুসলিমনগর ফাজিল মাদরাসায় ভর্তি হন। ইয়াতিম শাহ আলম মাদরাসার ছাত্রাবাসে থেকে লেখাপড়া করতেন।
শাহ আলমের মা শহরবানু ও বোনকে গতকাল তাদের বাড়িতে পাওয়া যায়নি। তার চাচি আসমা বেগম জানান, শাহ আলমের বয়স পাঁচ বছর ও তার বোনের বয়স দুই বছর থাকাকালে তাদের বাবা নাসির উদ্দিন প্রায় ১৮ বছর আগে ইন্তেকাল করেন। শহরবানু ইয়াতিম দুই শিশুকে নিয়ে মাটি কাটা ও বাড়িতে বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করেন। শাহ আলমকে হেফজ পড়িয়ে মাদরাসায় ভর্তি করান। ঘটনার দিন শাহ আলম ফোরকানিয়া (মক্তব) মাদরাসায় বাচ্চাদের পড়িয়ে সিংগাইর বাজারের উদ্দেশে রওনা হন। পথেই দাড়ি টুপি দেখে পুলিশ তাকে লক্ষ্য করে গুলি করেছে। আসমা বেগম জানান, একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে নাসির মা শহরবানু মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। একই অবস্থা তার বোনের। মৃত্যুর আগের দিন দুপুরে শাহ আলম তার মাযের সঙ্গে সর্বশেষ দেখা করে যান। গতকাল শহরবানু তার বাবার বাড়িতে ছিলেন বলে আসমা জানান।
গর্ভবতী স্ত্রী ও মা-বাবার প্রশ্ন, কী অপরাধ আলমগীরের : গতকাল যখন আলমগীরের বাড়ি গোবিন্দল মোল্লাপাড়ায় যাই তখন দুপুর ১২টা। চারদিকে চৈত্রের তপ্ত দুপুরের খাঁ খাঁ রোদ। আলমগীরের বাবা রাজ্জাক মাতব্বর (৬০) তখন আখ ক্ষেতে নিড়ানি দিচ্ছেন। তার সারা শরীরে ঘাম ঝরছে। টিনের ঘরে গম, যব ও সরিষার স্তূপ। এক নজরেই বোঝা যায় গৃহস্থের বাড়ি। আলমগীরের বাবার সঙ্গে কথা শুরু করতেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠেন। বললেন, ‘আমার সোনার টুকরা পুতে (ছেলে) গেণ্ডারি (আখ) লাগাইছে, পুতেরে কবর দিয়া আইছি; এখন এই গেণ্ডারি ক্ষেতই আমার পুত, ওপুত পুতরে…।’ আলমগীরের মা হনুফা বেগম (৫৫) শুধু চোখের পানি ফেলছেন। জানান, আলমগীর দুবাই থাকত। বছর তিনেক আগে দেশে এসে বিয়ে করেছেন পাশের কাঞ্চননগর গ্রামের রাফেজা বেগমকে। আঁখি নামে দেড় মাস বয়সী একটি কন্যা আছে আলমগীরের। বউ এখন আবার আট মাসের গর্ভবতী। এই অবস্থায় পুলিশের নির্মম বুলেট কেড়ে নিয়েছে আলমগীরের প্রাণ। আলমগীরের বাবা বলেন, ‘আমরা মূর্খ মানুষ। লেখাপড়া জানি না। মিছিল আর রাজনীতি দিয়া কী অইব’। তার ছেলে মিছিলে যায়নি দাবি করে আবদুর রাজ্জাক মাতব্বর বলেন, ঘটনার দিন আলমগীর ক্ষেতে তোলা সরিষা আনার জন্য গিয়েছিল। সেখানেই পুলিশের গুলিতে মারা গেছে আলমগীর।
নাজিম মোল্লার মায়ের আহাজারি : ‘আপনেরা কত কিছু লেইখা নিলেন, আমি তো পুত (ছেলে) পাইলাম না। ও বাবারে আমার বাবারে আইন্না দাও। আমি কই বাবা তুমি কই যাও, মা আমি আহি, আর আহে নাই, আমার বাবায় চিকিত্সার অভাবে মরছে, এত টাকা থাহার পরও বাবারে চিকিত্সা করাইতে পারি নাই।’ এভাবেই মাতম তুলে কাঁদছেন গোবিন্দল গ্রামে নিহত নাজিম মোল্লার মা রাজিয়া বেগম। আলমগীরর বাবা মজনু মোল্লার দাবি, একসময় ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী লিয়াকত হান্নান বাহিনীর মুশফিকুর রহমান হান্নান ও বলধারা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আওয়ামী লীগ নেতা আবদুল মান্নান খানের লোকজন তার ছেলেকে গুলি করেছে। নাজিম মারা যাওয়ার ১৪ দিনের মাথায় তার দাদি কাজেরুন্নেছা নাতির শোকে মারা গেছেন।
নাজিমের বোন সালমা জানান, নাজিম ছিল সিংগাইর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক। ঘটনার দিন পুলিশ খুব কাছ থেকে তাকে গুলি করে। হাসপাতালে নেয়ার পরও চিকিত্সার অভাবে নাজিমের মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন তার বোন। নাজিমের বোন আরও জানান, মাত্র দেড় বছর আগে নাজিম বিয়ে করেছে। নাজিমের স্ত্রী শারমিন এখন বাবার বাড়িতে। গত ২৮ ফেব্রুয়ারি নাজিম সৌদি আরব যাওয়ার নির্ধারিত ফ্লাইট ছিল। কিন্তু ফ্লাইটের চারদিন আগে পুলিশের বর্বরতায় প্রাণ হারান। সিংগাইর সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেওয়ান মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (মিঠু) ও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দু’জন কাউন্সিলর জানান, পুলিশ নাজিম উদ্দিনকে আটক করে রাখে। ঘটনা শেষে চলে যাওয়ার সময় তাকে গুলি করে ফেলে গেছে।
টার্গেট গোবিন্দল : সাদামাটা একটি গ্রাম গোবিন্দল। গ্রামে কলকারখানা কিছু নেই। কিছু মসজিদ মাদরাসা ছাড়া গ্রামে বড় কোনো স্থাপনাও নেই। সিংগাইর বাজার থেকে এক কিলোমিটার পশ্চিমে এই গ্রামের অবস্থান। গ্রামে স্থাপনা বলতে গোবিন্দল নতুনবাজার। ২০ থেকে ২৫টি টিনের ঘর আর ছাপড়া ঘর। সেখানে পুলিশ কেন এত বেপরোয়া হয়ে উঠল। সেখানে কিছু মানুষ মিছিল করলে কী এমন ক্ষতি হতো। সেই প্রশ্নের জবাবে গ্রামের মানুষ বলেন, জামায়াত-শিবির নয়, টার্গেট ছিল গোবিন্দল গ্রাম। গ্রামের নব্বই শতাংশ মানুষ বিএনপির রাজনীতি সমর্থন করে। গ্রামটি বিএনপির দুর্গ হিসেবে পরিচিত। সেই ক্ষোভ থেকে আওয়ামী লীগ নেতাদের ইন্ধনে ওই হত্যাকাণ্ড ঘটায় পুলিশ প্রশাসন। ২৪ ফেব্রুয়ারি চারজন নিহত হওয়ার পর পুলিশ জ্ঞাত-অজ্ঞাত চার হাজার ব্যক্তির বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা দিয়েছে। গুলিবিদ্ধ গৃহবধূ হেলেনা, গুলিবিদ্ধ ভ্যানচালক আলী হোসেন, নিহত মাওলানা নাসির উদ্দিনের ভাইদের সবাই পুলিশের এজাহারভুক্ত আসামি। ফলে গ্রামে রাজনীতি সচেতন পুরুষ লোক রাতের বেলায় বাড়িতে ঘুমায় না। প্রতিনিয়ত পুলিশ ধরপাকড় অভিযান চালাচ্ছে। পুলিশি গ্রেফতার বাণিজ্যে মানুষ দিশেহারা আতঙ্কিত ও উদ্বিগ্ন। মানুষ পুলিশের নৃশংসতা ও হয়রানির বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসছে। ফলে যে কোনো সময় সেখানে ফের পুলিশ হামলার শিকার হতে পারে।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মোবাইল ফোনে জানান, দেওয়ান মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান (মিঠু) জানান উত্তেজিত জনতাকে বোঝানোর জন্য পুলিশ তাকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়েছে। তিনি লোকজনকে বুঝিয়ে গ্রামের ভেতরে পাঠানোর কিছুক্ষণ পরেই পেছন থেকে গুলি শুরু করেছে পুলিশ। পুলিশের অধৈর্য বর্বর আচরণ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ইন্ধনেই এত মানুষের প্রাণহানি হয়েছে। পুলিশ ৬টি মামলায় মিঠু চেয়ারম্যানকে আসামি করেছে। এখন তিনি গ্রেফতারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন।
যেভাবে সূত্রপাত : ইসলাম ও রসুল (স.) অবমাননার প্রতিবাদে ২৪ ফেব্রুয়ারি ছিল ইসলামি দলগুলোর ডাকা হরতাল। সকাল আটটার দিকে মানিকগঞ্জ-সিংগাইর সড়কের গোবিন্দল বাসস্ট্যান্ড, ঘোনাপাড়া, বাইমাইল ও কাশিমনগর বাসস্ট্যান্ডে পিকেটিং করে এলাকার বিএনপি কর্মীরা। সকাল সোয়া আটটার দিকে সিংগাইর থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বলধারা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আবদুল মাজেদ খান দলীয় লোকজন নিয়ে তাদের বাধা দেয়। পিকেটাররা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের ধাওয়া করে এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এতে মাজেদ চেয়ারম্যানের কপালে ইটের আঘাত লাগে। ওই খবরে স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সংগঠিত হয়ে সিংগাইর উপজেলা বিএনপির কার্যালয় ও দুটি দোকান ভাংচুর করেন। এতে হরতাল সমর্থকরা আরও ক্ষিপ্ত হয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার পর মাজেদ চেয়ারম্যান পুলিশ ডাকেন। পুলিশ গিয়ে কয়েক রাউন্ড কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে পিছু হটে। একপর্যায়ে দাঙ্গা পুলিশসহ আবারও গিয়ে শটগান, বন্দুক ও পিস্তল দিয়ে গুলি শুরু করে। এতে কয়েকজন গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হয়। পরে গ্রামের মসজিদের মাইক থেকে গুলি করার খবর ঘোষণা দিলে স্থানীয়রা লাঠিসোটা নিয়ে ধাওয়া করে। আবারও র্যাব ও দাঙ্গা পুলিশ গিয়ে গ্রামে ঢুকে নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে অর্ধশত মানুষ গুলিবিদ্ধ হয়।
পুলিশের বক্তব্য : সিংগাইর থানা পুলিশ জানিয়েছে, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাদের অনুরোধে তারা সেখানে যান। ওই দিন নেতৃত্বে ছিলেন সার্কেল এসপি কামরুল ইসলাম। মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আলী মিয়া দাড়িতে ধরে গুলি করার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, জামায়াত ও বিএনপির কর্মীরা হরতালের নামে দোকানপাট ভাংচুর ও রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে অবরোধ করে। এ সময় পুলিশ বাধা দিতে গেলে হরতালকারীরা পুলিশের ওপর দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা করে। জীবন রক্ষার্থে পুলিশ গুলি চালাতে বাধ্য হয়। ওই তিন ৫০ রাউন্ড টিয়ারশেল ও তিন শতাধিক রাউন্ড গুলি চালানো হয়েছে বলে দাবি করেন এসপি।

Source: Amardesh

Exit mobile version