অপদার্থ সাপের দাঁতের সামান্য বিষটুকু মানুষের মতো মতাধর প্রাণীর জীবন কেড়ে নেয়ার মতা রাখে। মতা এমনই জিনিস। তাই আজ লিখছি মতা নিয়ে। গাফ্ফার চৌধুরীর কথামতো ২০০৮ সালের ১২ আগস্ট ভার্জিনিয়ায় সজীব ওয়াজেদ জয়ের বাড়িতে গেলে সেটাই তার সাথে আমার প্রথম ও শেষ দেখা। কিছু মনস্তত্ত্বের বিষয় আছে। তাই অল্প সময়েই তার অবস্থান দেখে অনেক বুঝেছি। প্রথম কথাটি ছিল, ‘আমি কেন সোনিয়া গান্ধী হবো, আমি মতায় যাবো’। এই মাত্র ওমুক এসেছিলেন কাল আবার আসবেন। আমাকে বলেছেন মন্ত্রিসভা ঠিক করতে। জিজ্ঞেস করলে উত্তর, নাম বলা যাবে না। তখনই দেশ থেকে ভারপ্রাপ্ত সভাপতির ফোন। নির্বাসিত সত্ত্বেও এত আত্মবিশ্বাস দেখে বুঝে নিয়েছিলাম, মতায় তিনিই যাচ্ছেন এবং যেকোনো পথেই হোক। এর মধ্যে আরো কিছু কথা আছে। তবে সংেেপ বলা যায়, ১/১১ এর মাধ্যমে সব হিসাব কড়ায়গণ্ডায় পূর্ণ হয়েছে। অতীতের আওয়ামী লীগের কঙ্কালের ওপর দাঁড়ানো কর্মকাণ্ডে এবার আমি নিশ্চিত, যেকোনো মূল্যেই হোক ২০২১ সাল পর্যন্ত মতা কিছুতেই হাতছাড়া করছেন না। অন্যথায় অযোগ্য, অপদার্থতার কারণে এই দফায় সমূলে বিনাশ হতে পারে আওয়ামী রাজনীতি। রক এবার দিল্লি। ওয়াশিংটন নয়, নির্বাচনের নায়ক এবার বিডিআর ঘটানো ‘র’। রাজনীতিবিদদের সুবিধা, আমরা সব শূয়োর-গাধা আর লেনিনের ভাষায় সংসদ হচ্ছে শূয়োরের খোঁয়াড়।
কথাগুলো বলার কারণ, মঞ্চে শেখ হাসিনা বারবার গণতন্ত্রের কথা বললেও বাস্তবে উত্তরাধিকার সূত্রে আপাদমস্তক স্বৈরাচারী শাসকের পরিচয় দিচ্ছেন। সহিংস আন্দোলনের ধারাবাহিকতায়, জনতার মঞ্চ থেকে জনজীবন বিকল করা তাণ্ডব, ২০০৬ এর ২৮ অক্টোবরে প্রায় ৫০ জন মানুষ হত্যা অথবা ২৭৩ দিন সহিংস হরতালের অত্যাচার এবং জামায়াতকে সাথে নিয়ে ১৭৪ দিন আন্দোলনে দুই টার্মেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় শেষে জামায়াতকে কলার খোসার মতো ছুড়ে ফেলার পাবলিক রেকর্ড শেখ হাসিনার। ষড়যন্ত্র মঞ্চের জন্য কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ এবং পুলিশ প্রহরা। অথচ বিরোধী দল একটি জনসভা করলেই বন্দুকের নলে স্বৈরাচারী সাদ্দাম হোসেনের মতো ঘটনা ঘটানো কোন গণতান্ত্রিক আচরণ? এ দিকে ২৭৩ দিন হরতালে জনজীবনে তাণ্ডব এবং নারকীয় হত্যাযজ্ঞ শেষে ১/১১ আনার কৃতিত্ব মোটেও খালেদার নয়। বরং খালেদার সরকার এই মাত্রায় বন্দুকের নল ব্যবহার করলে কোনো টার্মেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি আদায় করে মতায় যেতে পারত না লীগ। সুতরাং উত্তরাধিকারের ধারাবাহিকতাস্বরূপ, আওয়ামী ইতিহাস মোটেও সুস্থ ধারার রাজনীতি নয় বলেই আদর্শহীন দলের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে জন্ম থেকেই। সোহরাওয়ার্দীকে কবরে নামানোর পরদিনই ৩২ নম্বরে দলীয় সভা ডেকে আইয়ুববিরোধী আন্দোলনের ডাক দিয়ে তখন থেকেই ছাত্রসমাজের হাতে বইপুস্তকের পরিবর্তে রাজনীতির বাঁশ। ছাত্রসমাজকে ধ্বংস করতে লগি-বৈঠার বীজ বপন। এরপর থেকে ৬ দফা, ১১ দফার উন্মাদনায় বই ফেলে উন্মাদ তোফায়েলদের রাজপথে গণ-আন্দোলনের নামে বিপুল বিশৃঙ্খলা। তখন থেকেই ছাত্রদের, শিাঙ্গনের, শিকদের ভবিষ্যৎ ধ্বংসের পথে রওনা হয়। এরপর ’৬৯-এর অস্থিরতা থেকে অপরিকল্পিত যুদ্ধ সামাল দিতে ব্যর্থ হয়ে দিল্লির শরণাপন্ন হওয়া, প্রকৃত অর্থে এসবই অসুস্থ রাজনীতির ফসল ধাপে ধাপে যা আরো বেশি নারকীয় হয়েছে। ৪২ বছর পর, ছাত্রসমাজ আজ প্রায় ৯৯ ভাগই ধ্বংসের প্রান্তে। অত্যন্ত দুঃখজনক যে, ড. আনোয়ার আর আরেফিন সাহেবের মতো ভিসি সাহেবরা শিক না হয়ে দৃশ্যত লগি-বৈঠা বাহিনীর দায়িত্ব পালন করছেন। কিন্তু রাজনীতি মানে ২৪ ঘণ্টা জয় বঙ্গবন্ধুÑ জয় দেশরতœ নয় বরং রিপাবলিকান-ডেমোক্র্যাট অথবা কংগ্রেসের নেহরুর মতো বুদ্ধিভিত্তিক রাজনীতির চর্চা। অন্যথায় সময়মতো বিএনপি-আওয়ামী লীগ স্টাইলের রাজনীতির মৃত্যু হতে পারে।
মতার প্রয়োজনে স্বাধীনতা কিন্তু মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় ১১ মিনিটে গণতন্ত্র হত্যা করে নিজেকে আজীবন রাষ্ট্রপতি ঘোষণার স্বৈরাচারী উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন আর কেউ নন যিনি নিজেই স্বৈরাচারী আইয়ুবের বিরুদ্ধে বিপ্লবের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এরই ধারাবাহিকতায় কখনো বিরোধী, কখনো সরকারে গেলেও পারিবারিক রাজতন্ত্রের কৌশলে শেখ হাসিনার রাজত্বে লগি-বৈঠার স্খলন অতিরিক্ত বাড় বেড়েছে। গণতন্ত্র হত্যা করে বন্দুকের নলে বরং মধ্যপ্রাচীয় স্বৈরশাসকের মতো আচরণ করছেন। এবারো ২০২১ সালের আগে মতা ছাড়ছে না আওয়ামী লীগ এবং সেই ল্েযই রীবাহিনীর আদলে আরেকটি ষড়যন্ত্র সৃষ্টি হচ্ছে প্রজন্ম চত্বরের নামে। অহিংস আন্দোলন কখনো ফাঁসির দাবিতে সহিংস হতে পারে না। দৃশ্যত কিছু মিডিয়ার সাহা এবং দত্তবাবুরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন যা ওপারের ষড়যন্ত্রকেই নিশ্চিত করে। তবে মঞ্চের গোমড় ফাঁস হলেও সরকার ভাবে মানুষ সব বোকা, তারাই শুধু চালাক। তবে বাধ্য হলে শেখ হাসিনা সব করেন যেমন মরিচের গুঁড়া মারা, পদ্মা সেতুর দুই আবুল, মৌলবাদীদের ভয়ে এবার মঞ্চ বন্ধ। ভবিষ্যতে সব মানতে বাধ্য হবেন কারণ রাষ্ট্র পরিচালনায় তার সরকার পুরোপুরি অযোগ্য-অপদার্থ। এদের ওপর দাতাগোষ্ঠী কতটা নাখোশ চাপিয়ে রাখবে কয়দিন? যদিও গান্ধী কিংবা লিংকনকে আমি ‘র’-এর এজেন্টদের সাথে তুলনা করে অপমান করতে চাই না, তার পরও বলতে হয় অহিংস আন্দোলন ছিল গৃহযুদ্ধ বন্ধ করা আর ইমরান বাহিনীর কাজ দেশজুড়ে গৃহযুদ্ধের তাণ্ডব সৃষ্টি করে ১/১১ আনা। বিভক্ত মিডিয়া সব জানে কিন্তু অর্থের সঙ্কীর্ণতা এবং রাজনৈতিক দায়বদ্ধতার কাছে অসহায় অন্যথায় ’৭৫-এর মতো বিলুপ্ত হতে পারে সব মিডিয়া, শুধু পছন্দের ১১টি বাদে।
সরকারের সৌজন্যে নাস্তিকদের এই মাপের ধৃষ্টতা দেখে মনে হওয়াই স্বাভাবিক, নির্বাচন হবে জামায়াতকে সাথে নিয়ে এবং বিরোধী দল ছাড়াই ও সেই ল্েযই বাঘ-ছাগলের খেলা। এতণে অরিন্দম কহিলা বিষাদে। তাই কামাল মজুমদারদের নেতৃত্বে মঞ্চে যখন ‘বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি আর দলে দলে আওয়ামী পাণ্ডারা মঞ্চমেলার নামে রাস্তাঘাট কব্জা করে জনজীবনে নাভিশ্বাস তুলছে, তখন খালেদা জিয়ার প্রতিটি অভিযোগ সত্য। গণহত্যার জন্য সরকারের বিচার হবে। শেয়ারবাজারের ডাকাতির বিচার হবে। পদ্মা সেতু, হলমার্ক…! তাই ব্যর্থতা ঢাকতে সরকার এবার সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধুয়া তুলে দেশজুড়ে তাণ্ডব চালিয়ে দায় চাপাচ্ছে জজ মিয়াদের ঘাড়ে। হিন্দুদের সুবিধা, আওয়ামী লীগকে অন্ধভাবে বিশ্বাস করে, লীগের সুবিধা বিশ্বাস লগ্নি করে ভোট ক্যাশ করে। অর্থাৎ তিনিই মহাপরাক্রমশালী অসীম মতাধারিণী সিংহের পিঠে দশভূজা মার্তৃকা যার একমাত্র ব্যাধি খালেদা জিয়াকে নির্মূল করা। ১৮ মার্চ সোহরাওয়ার্দী ময়দানে সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী বক্তৃতার ৯৯.৯৯ ভাগই খালেদা আর খালেদা অর্থাৎ খালেদা এখন রীতিমতো তার মাথার অসুখ। আর বক্তৃতার সময় মঞ্চে উপস্থিত মান্যগণ্যদের চোখেমুখে অমন কুয়াশা দেখে বোঝা যায়, আপদ-বিপদ নিয়ে তারা কত ভীত। কদর্য, কুরুচি, গ্রাম্য গালাগালি করে হাসির পাত্র হওয়া একজন প্রধানমন্ত্রী শুধু নয়, জাতির মাথাও হেঁট হয়। খালেদা জিয়া কখনোই উল্টাপাল্টা বলেন না বলে তার প্রশংসা করি। কিন্তু পৃথিবী মানেই হাসিনা-খালেদা নয়। নিক্সন-পরবর্তী বিশ্বে শীতল যুদ্ধ-পরবর্তী পশ্চিমাদের পরিস্থিতি আর আগের মতো নয়, এসব তারা কেয়ার করে না। ফলে সেই সুযোগে এই অঞ্চলের ফ্যাসিবাদ তার নিজস্ব জায়গা করে নিয়েছে।
সংসদ সদস্য নাসিম ওসমানের কথা উল্লেখ করে সংসদ সদস্য কবরী বলেছেন, ‘জেলায় চার-পাঁচটি খুন হতেই পারে এতে উদ্বেগের কারণ নেই।’ ত্বকীর হত্যা প্রসঙ্গে মেয়র আইভী শামীম ওসমানকে নারায়ণগঞ্জে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন। এই যদি হয় একটি দলের আইনশৃঙ্খলার অবস্থা, তাহলে সেই বিশৃঙ্খল দলের নেতৃত্বের দেশের মানুষদের বসবাসের জন্য অন্য দেশে পালাতে হবে। পত্রিকায় প্রকাশ, জানুয়ারি-ফেব্র“য়ারি ২০১৩তে খুনের সংখ্যা ৬২৭, নিখোঁজ ১৮৭, ডাকাতি ১৮৪। ভোটের সময় আসল কথা মানুষ মাপছে না যে, দেশ চালানোর যোগ্যতা তার আছে কী নেই! থাকলে পদ্মা সেতু, শেয়ার মার্কেট, হলমার্ক কেলেঙ্কারি হলো কেন? তাই পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি ঘটানো প্রশাসন বারবার আখতারুজ্জামান বাবু এবং শামীম ওসমানদের মতো মেগা-গডফাদারদের ওপর নির্ভরশীল হয়। গুম-খুন-দমন-অর্থ পাচার-চাঁদা… এভাবে দেশ চালানো কারোই কাম্য নয়। আওয়ামী লীগ মতায় এলে উদয় হয়, মতা বদল হলে পালিয়ে যায় ওসমান দুর্বৃত্তরা। কেন্দ্র একেবারেই ভেঙেচুড়ে পড়ায় দেশ রার দায়িত্ব পড়েছে থানা, ইউনিয়ন পর্যায়ের প্রতিরোধ কমিটির কাঁধে। ফলে গুম-খুন মঞ্চ-ফঞ্চ করে জোড়াতালি দেশ চলছে গণতন্ত্রের ঘাড়ে বন্দুকের নল রেখে।
’৭২-’৭৫:
ভালো সংগঠক আর এক্টিভিস্ট হলেই ভালো রাষ্ট্রনায়ক হওয়া যায় না, সেই প্রমাণ আমরা দিয়েছি। গান্ধীজী প্রধানমন্ত্রী হতে রাজি হলেন না বরং ফিরে গেলেন গান্ধীবাদ চর্চায়। বিশ্বজুড়ে গান্ধীবাদ আজ বিপুল জনপ্রিয়। কিন্তু গান্ধী যদি রাজি হতেন, কি হতো? ৬৬ বছরে মাত্র একবার তাদের গণতন্ত্র ব্যাহত হয়েছিল ’৭৫-এ, স্বল্প সময়ের জন্য মাত্র দুইবার সেনাবাহিনী নামানো হয়েছিল। গান্ধি রাজি হলে ভারতের অবস্থা হতো আমাদের বন্দুকের নলে গণতন্ত্রের মতো ভয়াবহ। কারণ ভালো সংগঠক তিনি, ভালো শাসক হতে পারতেন বলে সন্দেহ। সুতরাং মুজিবও যদি জাতীয় সরকারপ্রধান হতেন, তিনিও হতেন অবিতর্কিত। ম্যান্ডেলার মতো ইতিহাস সৃষ্টি করা নেতাও এক টার্ম শেষে স্বেচ্ছায় মতা ছেড়ে দিলেন। ওবামা নিজে গিয়ে তার সাথে দেখা করেছেন, বিশপ টুটু পায়ের কাছে বসে থাকেন। এসব অতি অল্প পরিশ্রমে অর্জন সম্ভব যা ৩০ (?) লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে সম্ভব না।
বুদ্ধিহীন যারা ডিজিটাল যুগে ৩৯ বছর পরেও লগি-বৈঠার রাজনীতি করছে, তারা রাজনীতির ফরমালিন দিয়ে ছাত্রসমাজকে এখনো নষ্ট করছে। এক সময় মুজিবের ফ্যাসিবাদী আচরণে দল ছেড়ে বেরিয়ে গেছেন মুক্তিযুদ্ধের বহু কৃতী সন্তান কিংবা বের করে দেয়া হলো একাধিক স্থপতিকে। এরপর থেকে বারবার ফ্যাসিবাদের নলে গণতন্ত্রের বন্দুক দিয়ে দেশ শাসন। ‘র’-এর চক্রান্তে ৪২ বছর ধরে ’৭১-এর চেতনা ভেজে খাওয়াচ্ছে কংগ্রেস আর আওয়ামী লীগ। বাকশাল ভোলার মতো স্মৃতিভ্রষ্ট হইনি। তখন রীবাহিনীর অত্যাচার আইয়ুব সরকারের চেয়েও অধিক বেদনার কারণ হয়েছিল বলেই ’৭৩Ñ৭৪ ভুলতে পারি না। প্রবহমান দুর্ঘটনায় বিডিআর থেকে বিশ্বজিৎ হত্যা… দুঃস্বপ্ন মনে করিয়ে দেয়।
’৭২-৭৫। মধ্যযুগীয় শাসনে প্রায় লাধিক মানুষ উধাও। গণবাহিনী, জাসদ আর সর্বহারা ছাড়াও নানা দলের সঙ্গে খুনাখুনি। আর এর মধ্যেই সরকারের হাতে বন্দী অবস্থায় বাংলাদেশের প্রথম ক্রসফায়ারের শিকারÑ সিরাজ শিকদার। এসব ইতিহাস কেউ লেখে না, আলোচনাও করে না। তখন সংখ্যালঘুদের ওপর যে নির্যাতন হলো, সেসব কথা বেমালুম ভুলে গেছে বিশেষ করে হিন্দুরা। দেশের বিভিন্ন গ্রাম ও শহর থেকে পুরুষ উধাও। চাঁদা না দিলে পেটাও। ত্রাসের রাজ্যে তখন লাখ লাখ হিন্দু দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেলে শুরু হলো সম্পত্তি লুটপাটের মহোৎসব। পরিচিত কাকা, দাদা, জ্যেঠা এমনকি আমার বাবাও বাদ গেলেন না। মুজিবের রীবাহিনী আমার প্রাণপ্রিয় পিতাকে ময়মনসিংহ জেলের পায়খানায় তিন দিন বন্দী রেখে সিগারেটের আগুনে গায়ের চামড়া পুড়িয়ে দিলে তার জন্য শহরে হরতালও হয়েছিল। জীবনেও বাবাকে এমন কাঁদতে দেখিনি। পাসপোর্টটি পর্যন্ত কেড়ে নিয়েছিল এক মেজর। পরে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের সার্জারি ওয়ার্ডের ডাক্তারের সহায়তায় পাসপোর্টটি আমি নিজে উদ্ধার করি। দুই লাখ টাকার বিনিময়ে ছাড়া পেলেও যাদের টাকা-পয়সা ছিল না তাদের যে পরিমাণ অত্যাচার করা হয়েছিল তা বর্ণনার নয়। পাকিস্তানিদের বিদায় করে একটি গণতান্ত্রিক দেশে এই নষ্টামো নিয়ে কেউ লেখে না। এভাবেই অনিশ্চয়তায়, অনিরাপত্তায় বারবার নেতৃত্বহীন হিন্দুরা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। ’৬৪ থেকে ’৭১… চোখের সামনে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। যারা চোখ নামিয়ে কথা বলত, উত্তেজিত কিছু মুক্তিযোদ্ধারা কথা বলত চোখ তুলে। চাঁদা চাই, মিছিলের জন্য ট্রাক চাই। চার দিকে অস্ত্রের ঝনঝনানি। ভয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের রক্তচুর কাছে বাবা-কাকারা ক্রমশ দুর্বল হতে থাকেন। ব্যবসায় গুটিয়ে ফেলেন। পানির দামে, নয় বিনিময় করে দেশ ছাড়ার ধুম। আর এভাবেই হারিয়ে যেতে থাকে একটি গোষ্ঠী, একটি সম্প্রদায় সংখ্যায় তারা ৪২ ভাগ থেকে কমতে কমতে আজ হাতেগোনা। অথচ হিন্দুদের বন্ধু বলে দীর্ঘ দিন যারা দাবি করছে, আওয়ামী লীগ আসলেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার লেবাসে একটি ভয়ানক সাম্প্রদায়িক দল, যার প্রমাণ বৌদ্ধবিহার থেকে ১৮ মার্চ শেরপুরে মন্দির ভাঙা পর্যন্ত বিস্তৃত। এরকম বহু দুষ্কর্মের জন্য এককভাবে দায়ী আওয়ামী লীগ নিজে। ২০০৬ সালে তাদের নেত্রী একটার বদলে ১০টা লাশ চেয়েছিল, যা পাবলিক রেকর্ডে। জামায়াত-শিবিরকে রাস্তায় দাঁড়াতে পর্যন্ত দেয় না, তারা কিভাবে মন্দির ভাঙে? আওয়ামীওয়ালাদের এত প্রপাগান্ডার পরেও যেখানেই মন্দির পুড়েছে সেখানেই ছাত্রলীগের সোনার ছেলেরা হাতেনাতে ধরা পড়ছে (পত্রিকার ছবি)। সুতরাং সুরঞ্জিত বাবুদের উচিত, দুর্বল গোষ্ঠীকে আর বিভ্রান্ত না করে বরং মানবাধিকার আদায়ে জামায়াত-শিবিরের মতো জীবন বাজি রেখে সাহসী হতে পরামর্শ দেয়া। তাদের মতো প্রতিবাদী না হলে পদতলে পিষ্ট হবেই। ভুললে চলবে কেন, জামায়াত নয় বরং বিশ্বজিতকে এরাই কুপিয়ে কুপিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে, যার বিচার না করে আবারো দোষ চাপিয়েছে জজ মিয়াদের ওপর?
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নিয়ে মিথ্যাচার
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস আর শহীদের বিকৃত সংখ্যা পুনরুদ্ধার না করলে কোনোটারই সতীত্ব আর রা হবে না। বঙ্গবন্ধু আর জয় বাংলার পাঁচফোড়নের খপ্পরে পড়ে জাতির বুদ্ধিবৃত্তি ধ্বংস হচ্ছে। তাই ইতিহাস বদলে দেয়ার বদলে সত্য আদায় করতে হবে। ’৭১-এ জনসংখ্যা সাত কোটি। মুজিব বললেন, ৩০ লাখ শহীদ। পাটিগণিতের হিসাব অনুযায়ী ৭০০ লাখের ৭ মার্চের বক্তৃতা অনুযায়ী পাঁচ শতাংশ ৩৫ লাখ। একে সর্বনিম্ন মূল্যে আনলে শহীদের হার দাঁড়ায় ২০ঃ১ অর্থাৎ প্রতি ২০ জনে একজন, যে প্রশ্নটি তুলেছে ইংল্যান্ডের বিখ্যাত কাগজ ইকোনমিস্ট। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাবাব ব্যবসায় আর ৩০ লাখ সংখ্যা নিয়ে মুজিববাদীদের মিথ্যাচার রুখতে হবে, অন্যথায় শহীদের সতীত্ব নষ্ট হবে। এই দেশে কোনো গ্রাম বা শহর নেই, যেখানে কেউ বলতে পারবে প্রতি ২০ জনে একজন শহীদ হয়েছে। নরসিংদী বা রাজশাহীতে হয়নি। খুলনা বা ময়মনসিংহে হয়নি। এমনকি মেহেরপুরেও হয়নি। তাহলে হয়েছেটা কোথায়? ৩০ লাখ সত্য হলে একটি পাড়ায় যদি এক হাজার লোক থাকে, ন্যূনতম ৫০ জন শহীদ হতে হয়েছে। শেখ হাসিনার মতো ফাঁকা বক্তৃতার বদলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ৬০ লাখ ইহুদি হত্যার বিশ্বাসযোগ্য হিসাব তারা কাগজপত্রে তৈরি করেছে। কিন্তু শেখ মুজিব বা হাসিনার সরকার কি গণহত্যার না মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা আজ অবধি করতে পেরেছেন? কাজে নয় শুনে মুসলমান। নেত্রী যা বলেন, মুজিববাদীরা শিশুদের মতো লাফায়। মুজিববাদীরা সহজ পাটিগণিত পড়লেই উদ্ধার হবে ৩০ লাখ না ৩০ হাজার। সুতরাং শহীদের সম্মানে এখন থেকে বলা হোক, ৩০ হাজার। বলতে বলতেই ইতিহাস শুদ্ধ হবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে অন্য গবেষণাগুলো কী বলে? যেমন শর্মিলা বোসের ‘ডেড রেকোনিং’ বইয়ে দুই বছরের মাঠপর্যায়ে গবেষণা অনুযায়ী শহীদের সংখ্যা ৩০ হাজার কিংবা কম এবং অপারেশন সার্চলাইটে মৃতের সংখ্যা ৭০০ কিংবা কম। এ ছাড়াও রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের ভিন্ন মত, যা আওয়ামী মত থেকে ১০০ ডিগ্রি উল্টো। এর বিরুদ্ধে তথ্য-উপাত্ত যদি স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীও দিতে পারেন বক্তব্য প্রত্যাহার করব। ’৭১ শেষে মানুষ যখন ফিরতে শুরু করল, এমনকি শহরের মানুষেরাও বলেনি দু-একজনের বেশি শহীদের কথা। শেরপুরের জনসংখ্যা কয়েক হাজার হলেও, সম্মুখ সমরসহ সামরিক বেসামরিক ৪০ জনের মতো নিহত হয়েছিল। শহীদের সংখ্যা ঊর্ধ্বে ২৪, বাকিরা পাকিস্তানি। এই একটি উদাহরণই কি যথেষ্ট নয়? তাহলে এই উদ্ভট সংখ্যাটির স্রষ্টা কে? যখনই প্রশ্ন তুলি, বড়ভাইয়েরা ধমক মারেন, মুজিব যেটা বলেছেন, তর্ক করতে নেই। এ জন্যই কি প্রজন্ম চত্বরে মিথ্যার জয় আর সত্যের পরাজয়? আজ বলছি, একটি দেশের কয়টা স্বাধীনতা দিবস থাকা উচিত। কয় মাস স্বাধীনতার মাস হয়। বিশ্বে আর কোথাও বিজয় আর স্বাধীনতা দিবস বলে আলাদা কিছু নেই। ২১ ফেব্র“য়ারি একটি দিবস, এক মাস পালনের কোনো কারণ নেই। জাতিকে বিপথগামী করতেই আওয়ামী লীগ মাস আর দিবসের ব্যবসায় করছে বলে প্রমাণ করেছে। সুতরাং চেতনার ব্যবসায় বন্ধ করতে ফরমালিনমুক্ত রাজনীতি ফিরিয়ে এনে জাতির মাথায় রাজনীতির ফরমালিন ঢালা বন্ধ করতে হবে।
প্রণব ঠেকাও
ভলতেয়ার বলছেন, ‘আমি তোমার মতামত অস্বীকার করতে পারি কিন্তু মতপ্রকাশের স্বাধীনতার জন্য জীবন দিতেও প্রস্তুত।’ একথা স্বীকার করতেই হবে, বাংলাদেশের ৯০ ভাগই মুসলিম এবং প্রায় সাড়ে চার লাখ মসজিদের দেশে সাম্প্রতিককালে ব্লগারদের নাস্তিক তাণ্ডব না চাইলেও বরং ইসলামিক বিপ্লবকেই উসকে দিচ্ছে। বিভিন্ন জেলায় আন্দোলন দানা বাঁধছে, সঙ্ঘবদ্ধ এরা বদর যুদ্ধের কথা বলছে। তাহলে রক্তপাত অনিবার্য জেনেও সরকার কেন ইমরান বাহিনীকে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে গ্রেফতার না করে বরং মদদ দিচ্ছেন কেন, পাগলেও বোঝে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট, গণজাগরণের নামে সেনা শাসনের পথ উসকে দেয়া হচ্ছে। ভারতীয়রা মঞ্চের নামে শাহবাগে ঢুকছে। বিষয়টি এখনই নিয়ন্ত্রণ না করলে যা হতে পারে, ’৯২ সালে তসলিমা নাসরিনের বেলায় দেখেছি। তখনো এ বিষয়ে ভারতের উসকানি ছিল, এখনো আছে। সাম্প্রতিককালে ভারতের বিশিষ্ট মহল থেকে প্রজন্ম চত্বরের প্রতি সমর্থন দিতে সীমান্ত অতিক্রমের ঘোষণা উদ্বেগজনক। সাম্রাজ্যবাদী ভারতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে সাম্রাজ্যবাদবিরোধী হুগো শ্যাভেজের দর্শন থেকে সরকারগুলো শিা নিতে পারে।
প্রায় ৯০ ভাগ মুসলমানের দেশে ছয় দিনে এই মাপের গণহত্যা দেখে মনে হওয়াই স্বাভাবিক এটা সংখ্যাগুরু আর সংখ্যালঘুদের মধ্যে কমিউনিয়াল রায়ট কিন্তু বাস্তবে সংখ্যাগুরু বনাম সংখ্যাগুরু মুসলমানের রায়ট। আমি তাজ্জব! বিচণ প্রণববাবু দু’টি দলের মধ্যে আদর্শের দীর্ঘ যুদ্ধের কথা জেনেও গণহত্যা চলাকালীন সময়ে এসেছেন পদক নিতে এবং গণতন্ত্র রা করার পরামর্শ দিতে। বাহ! আসলেই কি তাই, নাকি অন্য কিছু? আশ্চর্য! একবারো দুঃখ প্রকাশ করলেন না! পত্রিকায় প্রকাশ, হাসিনার তৃতীয় টার্ম নিশ্চিত করেছে ভারত। এ দিকে স্বাধীনতাকামী কাশ্মিরের মুসলমানদের খুশি রাখতে ’৪৭ থেকে খাওয়ানো হচ্ছে মাগনা চাল-ডাল-ঘি আর বিশাল ভতুর্কির দ্বৈতনীতি। তারপরেও নিজেদের দিল্লির কাছে বিক্রি না করে বরং তুচ্ছ ইস্যুতেও দিল্লির শ্বাসকষ্ট সৃষ্টি করে। এ কথা আমরা বলতে পারি না বলেই বাংলাদেশের গণহত্যা পরিস্থিতিতেও ষড়যন্ত্রবাবুরা আমাদের টাকায় শ্বশুর ভিটায় আনন্দ সফরে এসে শাহবাগীদের প্রতি সমর্থন দিতে সাহস করেন। ২০২১ সাল টার্গেট রেখে আরেকটি রক্তপাত ঘটানোর মাধ্যমে উপনিবেশ পাকাপোক্ত করাই উদ্দেশ্য। একে আমরা মোটেও বন্ধুসুলভ আচরণ বলব না। তবে এ কথা স্পষ্ট হয়েছে, এই দেশে আর কোনো ইন্দিরা গান্ধী বসানো চলবে না। ভারতীয় মুসলমানেরা এই মর্মে স্মারকলিপিও দিয়েছিল, কঠিন সময়ে প্রেসিডেন্ট যেন বাংলাদেশে সফর না করেন।
এমনকি ভাষার মাসেও খুনের পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ছয় দিনে প্রায় তিন শতাধিক লাশ ফেলার পরেও বিরোধী দলের ওপর দোষ চাপাতে পারেন না যা-খুশি টাইপের প্রধানমন্ত্রী। বরং গণহত্যার আঙুল তার দিকে। প্রভাব পড়ছে জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর ওপর। (মিসরের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির রিপোর্ট, হোসনি মোবারকের হুকুমেই পুলিশ গণহত্যা চালিয়েছিল সুতরাং শাস্তি তাকে পেতেই হবে।) স্বাধীনতার আগে এক দিনে এত মানুষ হত্যা করেনি পাক সরকারও। এই সরকার তারচেয়ে ঘৃণ্য বলে প্রমাণ করেছে। গণ-অভ্যুত্থানের আগে এক দিনে দুই জন, ’৯০তে সাতজন এবং ২১ ফেব্র“য়ারির দিন সাত বা আটজন। হাসিনা সরকারের আপাদমস্তক রক্তে মাখা। তাই গণহত্যার জন্য মুক্তাঙ্গনে নির্মূল কমিটির মতো গণ-আদালত প্রয়োজন।
খালেদা জিয়াকে ধন্যবাদ, প্রণবের সাাৎ বাতিল করে সাহসী অবস্থান নিলেন, যা আরো আগে হলে পানি এতদূর গড়াত না। বুদ্ধিমানেরা অনেক কিছুই সময় থাকতে অনুমান করেন। বিষয়টি ভারত সরকার অন্যভাবে দেখবে, আওয়ামী লীগ ফায়দা লুটবে কারণ ’৬৯ থেকেই বিশ্বকর্মা প্রণব কাকা ছাড়া পরজীবী আওয়ামী লীগ অস্তিত্বহীন। বাংলাদেশের অস্তিত্ব এখন সাম্রাজ্যবাদী ভারতের হাতে। তারা যা বলছে গণভবনকে শুনতে হয়। জাতির দুঃসময়ে প্রণববাবুর সফরের মতো ঘটনা ভারতে ঘটলে এক্টিভিস্টরা হয়তো শেখ হাসিনাকে বিমানবন্দর থেকেই ফেরত পাঠিয়ে দিতেন।
সাম্রাজ্যবাদী ভারত ঠেকাও ল্েয ষড়যন্ত্রবাবুদের সফর নিয়ে ভবিষ্যতে সতর্ক হতে হবে। ভারতীয় দূতাবাসের সামনে ঘন ঘন মানববন্ধন করতে হবে। চুক্তির চরিত্র এবং দিল্লির ভাষা বুঝতে হবে। এ দেশের মানুষদের আর চায়ের দাওয়াত খাওয়ার সময় নেই। আসল বিশ্বকর্মা প্রণববাবু, তিনি চাইলে তিস্তার পানি কিছুই না, অথচ ‘হচ্ছে, হবে’ নামে রঙ্গ করে চুক্তির পর চুক্তি করে কেটে পড়া! পররাষ্ট্র সচিব নাকি ফালানীর নামই শোনেননি। তাজ্জব কথা! সীমান্ত হত্যা বন্ধ বিষয়টা এখন জোকস! সুতরাং ভারতের সাথে সব গোপন চুক্তি এক মাসের মধ্যে জনসমে প্রকাশ না করলে এখনই অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেয়া যেতে পারে। সুনীলদার ভাষায়, ‘নাদের আলী! আমি আর কত বড় হবো!’ সাম্রাজ্যবাদী ভারতের বিরুদ্ধে আমাদের প্রধানমন্ত্রীরা কখনোই বড় হলেন না। তার পরেও খালেদার সাহস, মন্দের ভালো।
লেখক : মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী, নিউইয়র্ক
ইমেইল : farahmina@gmail.com
Source: Naya Diganta