Site icon The Bangladesh Chronicle

Khaleda Zia should make these mistakes over and over….

খালেদা জিয়ার বারবারই এমন ভুল করা উচিত

মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার

একটা গুমোট পরিস্থিতির মধ্যে আটকে আছে বাংলাদেশের রাজনীতি। মনে হচ্ছে রাজনীতিতে কোনো স্বচ্ছতা নেই, জবাবদিহিতা নেই, নেই নাগরিক সমাজকে স্বস্তি দেয়ার কোনো প্রবণতা। আর সরকারের পক্ষ থেকে রাজনীতিতে স্বাভাবিকতা ও সুস্থ ছন্দ ফিরিয়ে আনার কোনো তৎপরতাও দেখা যাচ্ছে না। এর ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে স্বাভাবিকতা ফিরে আসছে না। ব্যবসা-বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ স্বাভাবিক গতি পাচ্ছে না। একটা স্থবিরতা ও অনিশ্চয়তা যেন রাজনীতিকে গ্রাস করছে। সরকার অবশ্য চলমান পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক দেখাতে চেষ্টা করে যাচ্ছে। শীতকালে মেলা, বর্ষাকালে ক্রিকেট খেলা, আর ১৪ হাজার মামলায় প্রতিপক্ষ বিএনপিকে নাস্তানাবুদ করে সবকিছু স্বাভাবিক দেখাতে ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছে। দশম সংসদ নির্বাচনী প্রহসন দেখার পর নাগরিক সমাজ ভেবেছিল সরকার দ্রুত আরেকটি নির্বাচন দিলে তারা সে নির্বাচনে ভোট দিয়ে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারবেন। কারণ, দশম সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে না পারার একটা মনোবেদনা গণহৃদয়ে জাগরূক রয়েছে। উপজেলা ও তিন সিটি নির্বাচন দেখার পর নাগরিক সমাজের ওই মনোবেদনায় মাত্রাবৃদ্ধি ঘটেছে। কিন্তু সরকার নাগরিক সমাজের ভোট দিতে না পারার মনোবেদনা লাঘব করার কোনো চেষ্টা করেনি। একটা মধ্যবর্তী নির্বাচনের ব্যবস্থা করলেও মানুষ ওই নির্বাচনে ভোট দিয়ে শান্তি পেতেন। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে নেতা-মন্ত্রীরা ২০১৯ সালের আগে সংসদ নির্বাচন হবে না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। এর অর্থ হল একটা ভোটারবিহীন ও নিকৃষ্ট নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় এসে এ সরকার তার আরেকটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেয়ার পূর্ব প্রতিশ্র“তি থেকে সরে এসে বিভিন্ন কলাকৌশলে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দুর্বল করে ক্ষমতার মেয়াদ পূরণ করতে চায়।সরকারের মাননীয় মন্ত্রীরা বলছেন, ২০১৯ সালে যে সংসদ নির্বাচন হবে ওই নির্বাচন হবে বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী। সম্প্রতি জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফও রাজধানীর শিল্পকলা একাডেমিতে যুবলীগের এক অনুষ্ঠানে আগামী সংসদ নির্বাচন বর্তমান সংবিধানের অধীনে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। ওই অনুষ্ঠানে সৈয়দ আশরাফ বলেন, বর্তমান সংবিধানে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণের সুযোগ রয়েছে। আগামী নির্বাচনও সংবিধান অনুযায়ী হবে। সেখানে সব রাজনৈতিক দল অংশগ্রহণ করবে। আশরাফ আরও বলেন, গত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে খালেদা জিয়া যে ভুল করেছেন, আশা করি এবার আর সে ভুল তিনি করবেন না। সৈয়দ আশরাফের এ বক্তব্যটি নতুন নয়। প্রহসনের দশম সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই সরকারের নেতা-মন্ত্রী ও সরকারসমর্থক কিছু সুবিধাভোগী সুশীলসমাজ সদস্য এবং বুদ্ধিজীবী তাদের বক্তব্যে ও লেখনীতে বারবার বলে আসছেন যে, দশম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে খালেদা জিয়া ভুল করেছেন। এ একই বক্তব্য বারবার বলে তারা এটাকে জনগণের মনে প্রতিষ্ঠিত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু আমজনতা এ বক্তব্যে বিশ্বাস করেননি। কারণ, নাগরিক সমাজ এখনও মনে করেন, দলীয় সরকারের অধীন স্বচ্ছ সংসদ নির্বাচন করার মতো পরিবেশ এখনও এ দেশে তৈরি হয়নি। নাগরিক সমাজের এ ধারণা দশম সংসদ নির্বাচনের পর পাঁচ পর্বে অনুষ্ঠিত চতুর্থ উপজেলা পরিষদ এবং সম্প্রতি অনুষ্ঠিত তিন সিটি নির্বাচন দেখে আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। নাগরিক সমাজের সচেতন এবং নিরপেক্ষ অংশ মনে করেন, দশম সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে খালেদা জিয়া ভুল করেননি।জনগণের মধ্যে যারা গণতন্ত্রকে ভালোবাসেন, যারা অংশগ্রহণমূলক, অবিতর্কিত স্বচ্ছ সংসদ নির্বাচন দেখতে চান, সরকারি প্ররোচনায় বিভ্রান্ত না হয়ে তারা মনে করেন, খালেদা জিয়া দশম সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যদি ভুল করে থাকেন, তাহলে গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতা ও জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার স্বার্থে তার এ রকম ভুল বারবার করা উচিত। কারণ, দশম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশগ্রহণ করলে কী হতো? দলীয় সরকার প্রশাসন এবং আইন-শৃংখলা বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে যে নীলনকশা করেছিল, মন্ত্রী-এমপিরা ক্ষমতায় থেকে, সংসদ না ভেঙে সাজানো ওই নির্বাচনী ফাঁদে পা দিয়ে বিএনপি সরকারি ছাড়ে কিছু আসন নিয়ে সংসদে বিরোধীদলীয় ভূমিকা পালন করতে পারত। স্বচ্ছ সংসদ নির্বাচনের দাবিতে আর মুখ খুলতে পারত না। সেক্ষেত্রে ভবিষ্যতেও একই ধারায় নির্বাচন হতে থাকত এবং ওই প্রক্রিয়ায় বিএনপিকে জনগণ পছন্দ করে ভোট দিলেও দলটিকে আজীবন বিরোধী দলে থাকতে হতো। আর তা ছাড়া বিএনপি নির্দলীয়-নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে যে আন্দোলন করে আসছিল, সে আন্দোলনের অপমৃত্যু ঘটে এ আন্দোলনের সব প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতির দায় দলটির ঘাড়ে চাপত। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী না করে, সরকারকে ক্ষমতায় রেখে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে বিশ্বাস করে বিএনপি কেন নির্বাচনে গেল- বিএনপির লাখ লাখ সমর্থক ও নেতাকর্মীরা এমন প্রশ্ন করলে বিএনপি নেতৃত্ব কী জবাব দিত? কিন্তু এখন বিএনপি সংসদ এবং সরকারের বাইরে থাকলেও নৈতিকতা, গণতান্ত্রিকতা ও যৌক্তিকতার দিক থেকে দলটি সরকারি দলের চেয়ে এগিয়ে আছে। সরকারের সুবিধাবঞ্চিত এবং মামলা-হামলায় নাস্তানাবুদ বিএনপি নেতারা কোর্টের বারান্দায় দৌড়াদৌড়িতে ব্যস্ত হলেও জনগণের মাঝে তাদের সমর্থন কমেনি।এখন প্রশ্ন হল, সরকার কি মধ্যবর্তী নির্বাচন না দিয়ে বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ দশম সংসদ নির্বাচনের রায় নিয়ে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকবে? চাইলে সাজানো প্রশাসন ও আইন-শংখলা বাহিনীর সহায়তা নিয়ে সরকার সে চেষ্টা করতে পারে। আন্দোলন-সংগ্রাম করে সরকারকে ক্ষমতা থেকে নামানোর মতো অবস্থায় যে বিএনপি নেই সে বিষয়টি সত্য। কিন্তু এভাবে ক্ষমতায় থাকলে তো দেশের উপকার হবে না। দেশে গণতান্ত্রিক প্রাতিষ্ঠানিকতা পিছিয়ে যাবে। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশ সম্মানিত হবে না। বিদেশী বিনিয়োগ আসবে না। সর্বক্ষেত্রে অস্বাভাবিকতা বিরাজ করবে। আর রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্বাভাবিক হলে আর্থ-সামাজিক উন্নতিও পিছিয়ে পড়বে। তাহলে সরকারের করণীয় কী? সরকার একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে এ পরিস্থিতি থেকে দেশকে বের করে আনতে পারে। নতুন করে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আবার সরকার গঠন করে দেশ পরিচালনায় নিয়োজিত হতে পারে। ওপরে তেমন কিছু না বললেও সরকার কি তেমন কিছু ভাবছে? সরকারের বিরোধী দল দমন এবং নিজ দলের সাংগঠনিক কাজের তৎপরতা বৃদ্ধি দেখে অনেকে মনে করছেন যে সরকার হয়তো রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতির লক্ষ্যে অচিরেই একটি মধ্যবর্তী সংসদ নির্বাচন দেবে। তবে তার আগে আরও কিছু স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিয়ে নেতাকর্মীদের নির্বাচনী কাজে আর একটু ঝালিয়ে নেবে কিনা সে সম্পর্কেও সরকারের ভাবনা আছে। তবে এক্ষেত্রে সংসদ নির্বাচনের আগে অন্য কোনো নির্বাচন দিলে সরকারের জনপ্রিয়তা আরও হ্রাস পেতে পারে। কারণ, স্থানীয় সরকার নির্বাচন দিলে সে নির্বাচন যদি উপজেলা বা তিন সিটি নির্বাচনের মতো হয়, তাহলে তা সরকারের বিপক্ষে যাবে। গত উপজেলা নির্বাচন এবং তিন সিটি নির্বাচন দেখে জনগণ সরকারের ওপর মোটেও খুশি হননি।মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে চাইলে সরকারকে নির্বাচনী ব্যবস্থা নিয়ে ভাবতে হবে। কেমন নির্বাচনী ব্যবস্থায় মধ্যবর্তী নির্বাচন হবে সে বিষয়টির ফয়সালা না করে মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়েও পরিস্থিতির উন্নতি করা যাবে না। এ ব্যাপারে সরকার বিএনপির সহায়তা না নিয়ে এককভাবে কাজ শুরু করতে পারে। আর সরকার যদি বিএনপির সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা করতে চায় তাহলে তো বিএনপি সে ব্যাপারে সম্মত আছে। বিএনপি চেয়ারপারসন সংসদ নির্বাচন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হতে হবে এমন দাবি না করে বলেন, একটি নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হতে হবে। সে সরকারের রূপরেখা কেমন হবে তা আলোচনাসাপেক্ষে ঠিক করা যেতে পারে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আ স ম হান্নান শাহ ১ আগস্ট বিবিসির বাংলাদেশ সংলাপ অনুষ্ঠানে বলেন, সরকার চাইলে বা আলোচনায় রাজি থাকলে বিএনপি অবশ্যই নির্দলীয় সরকারের ফর্মুলা দেবে। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে গড়িমসি করছে। সরকার যদি ভাবে যে বিএনপিকে হামলা-মামলার ভয় দেখিয়ে কাবু করে দলীয় সরকারের অধীনে, শেখ হাসিনার অধীনে সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করাবে তাহলে মনে হয় তারা সঠিক পথে নেই। কারণ, বিএনপি চেয়ারপারসন যে ভয় পেয়ে নীতি পরিবর্তন করেন না সে বিষয়টি তার রাজনৈতিক জীবনে একাধিকবার প্রমাণিত হয়েছে। এবারও তিনি তার নীতিতে এখন পর্যন্ত অনড় রয়েছেন। এ মাসের প্রথম দিনও তিনি গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে এক মতবিনিময় সভায় বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। তিনি আরও বলেন, তার দল শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না।কাজেই ফাঁদ পাতা ৫ জানুয়ারির দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যে বিএনপি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে ব্যাপারে দলটি নিজ অবস্থানে অনড় আছে। কিছু সুবিধাভোগী বুদ্ধিজীবী এবং সুশীলসমাজ সদস্য এবং সরকারদলীয় নেতাকর্মীরা যতই বলুন যে, ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করে বিএনপি ভুল করেছে এবং এখন দলটিকে সে ভুলের মাশুল দিতে হবে, তাতে সমস্যার সমাধান হবে না। উপজেলা নির্বাচন এবং তিন সিটি নির্বাচনের কাণ্ড-কারখানা দেখে জনগণের মাঝে বিএনপির নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের দাবির যৌক্তিকতা অধিকতর সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এ অবস্থায় জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফের বিএনপি ৫ জানুয়ারি নির্বাচনে অংশ না নিয়ে ভুল করেছে, আগামী নির্বাচন বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী দলীয় সরকারের অধীনে হলে বিএনপি ওই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে আর ভুল করবে না বক্তব্যে বিএনপি যে তার অবস্থান পরিবর্তন করবে না, সে বিষয়টি খালেদা জিয়ার বক্তব্যে স্পষ্ট হয়েছে। সাধারণ আমজনতা নির্দলীয় সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচন হওয়াকে ভালো মনে করেন। গণতন্ত্রপ্রেমিক ও স্বচ্ছ নির্বাচন প্রত্যাশীরা মনে করেন, দলীয় সরকারের অধীনে সাজানো প্রশাসনে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নিয়ে যদি খালেদা জিয়া ভুল করে থাকেন, তাহলে আবারও তার এ ভুল করা উচিত। কারণ, সাধারণ মানুষ চান না যে, আগামী সংসদ নির্বাচনটি দলীয় সরকারাধীনে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ, চতুর্থ উপজেলা পরিষদ বা তিন সিটি নির্বাচনের মতো একটি বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন হোক।ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

akhtermy@gmail.com

Source: Jugantor

Exit mobile version