বাবা-মায়ের দেওয়া নাম চন্দন কুমার ধর। উগ্র ধর্মীয় সংগঠন ইসকনে যোগ দেওয়ার পর বনে যান চিন্ময় কুমার দাস ব্রহ্মচারী। ভক্তরা তাকে ডাকেন চিন্ময় প্রভু নামে। চট্টগ্রামের সাতকানিয়া সদর ইউনিয়নের ১৬ নম্বর করায়নগর এলাকার আওয়ামী লীগ নেতা মৃত মাস্টার আশুতোষ ধর ও সন্ধ্যা রানী ধরের ছেলে তিনি। বড় ভাই রঞ্জন কুমার ধর, মেজো ভাই অঞ্জন কুমার ধর ও বোন রুনা ধরের পরে জন্ম তার। ১৯৮৫ সালে চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে আওয়ামী লীগের সমাবেশে যোগ দিতে এসে ভিড়ের কারণে স্ট্রোক করে মারা যান আশুতোষ ধর। ওইদিনই কক্সবাজারের ডুলাহাজারা মালুমঘাট মেমোরিয়াল খ্রিস্টান হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন চিন্ময়। জন্মের সময় বাবার মৃত্যু হওয়ায় গ্রামের মানুষের কাছে অপয়া সন্তান হিসেবে পরিচিতি পায় চন্দন। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ১৯৯৮ সালে সাতকানিয়া থেকে চট্টগ্রামে পাড়ি জমান সপরিবারে। বন্দর নগরীতে এসে ছাত্রলীগের সঙ্গে জড়িত থাকা অবস্থায় হঠাৎ একদিন জানা গেল তিনি সন্ন্যাসী হয়েছেন। পরের গন্তব্য বিতর্কিত ইসকন। গেরুয়া বেশে উগ্র তৎপরতায় অল্প সময়ের মধ্যেই ইসকনের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পান তিনি। খাতা-কলমে সংগঠনটির তিন নম্বর নেতা হলেও কার্যত ইসকনের পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে যায় তারই হাতে।
বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার চক্রান্ত
জুলাই বিপ্লবে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার পতনের পর বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে ফ্যাসিবাদী শাসন ফিরিয়ে আনার নীলনকশা আঁটে দিল্লি, যার অন্যতম সেনাপতির দায়িত্ব পালন করছেন এই ইসকন নেতা। ইসকনের বাইরে সাধারণ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে বিভ্রান্ত করে মাঠে নামাতে সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোট নামের আরেকটি সংগঠন খুলে বসে চিন্ময়। ইসকনের আঞ্চলিক সদর দপ্তর হিসেবে পরিচিত চট্টগ্রামের প্রবর্তক মন্দিরে ১৭ নভেম্বর সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে তথাকথিত এই জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটে। সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের পরিকল্পনায় ভারতপন্থি আরও কয়েকটি ছোটখাটো সংগঠনকে সঙ্গে নিয়ে নতুন এই জোটের আত্মপ্রকাশ ঘটানো হয়, যার সমন্বয় করছেন ভারতে পালিয়ে থাকা পতিত সরকারের সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তাদের পরিকল্পনায় অন্তর্বর্তী সরকারকে ব্যর্থ বানাতে সক্রিয় ছিলেন তথাকথিত ধর্মীয় গুরু চিন্ময় ওরফে চন্দন। সেই লক্ষ্যে সরকার পতনের পরপরই তিন মাসে অন্তত ১৫টি বড় সমাবেশ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষকে উসকে দেন তিনি। এসব সমাবেশের বেশির ভাগই অনুষ্ঠিত হয় চট্টগ্রামের জামালখান থেকে লালদীঘি পর্যন্ত মুহিবুল হাসান চৌধুরীর ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এলাকায়। গেরুয়া বেশে এসব সমাবেশে অংশ নেন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। মানুষের ভিড়ে এসব কর্মসূচিতে বিভিন্ন ধরনের উসকানি দেওয়ার পাশাপাশি নাটক সাজিয়ে তিলকে তাল বানিয়ে সেগুলো ভিডিও করে পাঠিয়ে দেওয়া হয় ভারতের হিন্দুত্ববাদী মিডিয়ায়। দুই সাংবাদিক, এক ফ্রিল্যান্সার ফটো সাংবাদিক ও দুই অ্যাডভোকেটের নেতৃত্বে গঠিত একটি টিম এসব ভিডিও ধারণ ও পাঠানোর কাজে নিয়োজিত রয়েছে। তাদের মধ্যে রয়েছেন সাংবাদিক বিপ্লব পার্থ ও পূরবী দাস, এডভোকেট শুভাশিস শর্মা , লীলা রাজ গৌর দাস ও ফ্রি ল্যান্সার ফটোগ্রাফার পরিচয়দানকারী গৌরাঙ্গ দাস। ফ্যাসিবাদের পতনের পর মূলত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানোই তাদের মূল উদ্দেশ্য। মহানগর আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আজম নাসির উদ্দিন, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন, জহরলাল হাজারী ও নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের অস্ত্রধারী ক্যাডার নুরুল আজিম রনি এই সাম্প্রদায়িক সহিংসতা বাধানোর মূল দায়িত্বে আছেন।
এ ব্যাপারে বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করলে ইসকনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথা অস্বীকার করে পূরবী দাস বলেন, দীর্ঘদিন ধরে তিনি সপরিবারে ভারতে অবস্থান করছেন। বাংলাদেশের কোনো বিষয়ে তিনি জানেন না। তার ব্যাপারে কোনো তথ্য পেলে ভালোভাবে তদন্ত করার অনুরোধ জানান তিনি। আর বিপ্লব পার্থ নিজেকে সাবেক ছাত্রদল নেতা ও বিএনপিপন্থি পেশাজীবী পরিষদের সক্রিয় নেতা বলে দাবি করেন। ইসকন কিংবা চিন্ময় দাসের সঙ্গে সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন। তবে জনৈক সুমন চৌধুরী নামের এক ব্যক্তি ইসকনের ভিডিও ও ছবি বিভিন্ন জায়গায় পাঠাই বলে জানান তিনি।
ইসকনের মূল টার্গেট চট্টগ্রাম
১/১১-এর সেনাশাসকের সহযোগিতায় ২০০৮ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা দখলের পর থেকেই মূলত ইসকনের কার্যক্রম বড় পরিসরে শুরু হয় বাংলাদেশে। কাজের সুবিধার্থে কয়েকটি পুরোনো মন্দিরের দখল নেওয়াসহ শুধু এই এলাকায় ১৪টি মন্দির প্রতিষ্ঠা করে ইসকন। এসব মন্দির ইসকনের কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ধর্ম প্রচারের নামে চলে সংখ্যালঘুদের মগজ ধোলাইয়ের কাজ। বিশেষ করে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি অফিসে কর্মরত হিন্দু সম্প্রদায়ের কর্মকর্তাদের টার্গেট করে চলে সদস্য সংগ্রহের কাজ। একটি গোয়েন্দা সংস্থা শুধু চট্টগ্রাম বন্দরেই ইসকনের ৫০ সদস্যের তালিকা সংগ্রহ করেছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) এএলএম ফজলুর রহমান জানান, সরকারি অফিসগুলোয় কোনো বিশেষ সংগঠনের প্রভাব বাড়ানোর মানে হলো যেকোনো পরিস্থিতিতে সরকারকে চাপে ফেলে নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নেওয়ার একটি প্রক্রিয়া। তিনি জানান, ইসকনের তৎপরতা চট্টগ্রাম ও রংপুরকেন্দ্রিক। বান্দরবানের সন্ত্রাসী সংগঠন কেএনএফের প্রধান নেতা নাথান বমও আশ্রয়-প্রশ্রয় ও অস্ত্র পাচ্ছে ভারত থেকে। চট্টগ্রাম ও বান্দরবানের নিয়ন্ত্রণ পেলে মিজোরামের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে ভারতের। অন্যদিকে রংপুর নিয়ন্ত্রণে এলে চিকেন নেকের সঙ্গে তাদের যোগাযোগটা সহজ হয়। মূলত এই টার্গেটেই মাঠে নেমেছে ইসকন। এই দুই জায়গায় বিপুল পরিমাণ জমিও কিনেছে সংগঠনটি, যা তাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই মনে করেন এই নিরাপত্তা বিশ্লেষক।
তবে গোয়েন্দা সূত্রগুলো বলছে, ভারতের এই পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে। আর তাই প্ল্যান-বির অংশ হিসেবে টার্গেট করা হয়েছে চট্টগ্রামকে। কারণ চট্টগ্রাম শহরের প্রাণকেন্দ্র নওফেলের নির্বাচনী এলাকা ঘিরে অন্তত ৫৪ হাজার সনাতনী সম্প্রদায়ের মানুষের বাস, যাদের মধ্যে জামাল খান, বান্ডেল কলোনি, আন্দরকিল্লাহ, কোতোয়ালি এলাকায় রয়েছে ইসকনের শক্ত অবস্থান। সেজন্য সরকার পতনের পর তারা চট্টগ্রামকেই বেছে নেয় অস্থিরতা তৈরির কি-পয়েন্ট হিসেবে। গত দুর্গাপূজায় ইসলামি একটি সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীদের ডেকে নিয়ে মঞ্চে তুলে ইসলামি গান পরিবেশনের ঘটনাটিও ছিল ধুরন্ধর ইসকনের কূটচাল।
সীমান্তে হত্যায় ভারতকে সমর্থন
চিন্ময় দাশের কথিত সনাতন জাগরণী জোটের কর্মসূচিতে জাতীয় পতাকার অবমাননার পর বিএসএফের হাতে বাংলাদেশিদের খুন হওয়ার ঘটনায় ভারতের পক্ষে প্রকাশ্যে অবস্থান নিয়ে সমালোচিত হন উগ্র এই ধর্মীয় নেতা চন্দন ধর ওরফে চিন্ময় দাশ। সম্প্রতি বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি কিশোরী স্বর্ণা দাস ও কিশোর জয়ন্ত কুমার সিংহ নিহত হওয়া নিয়ে তিনি বলেন, ‘সীমান্তে দুই হিন্দু মারা গেছে, এ জন্য মায়া-দরদ দেখাচ্ছে। ভারতের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। তো, আমি বলতে চাই, তারা কেন সীমান্তে গেছে? আগে ওটি খুঁজে নিন।’
চিন্ময়ের বিরুদ্ধে শিশুধর্ষণের অভিযোগ
ইসকনের বিতর্কিত নেতা চিন্ময় দাসের বিরুদ্ধে অন্তত ১০ শিশুকে ধর্ষণ ও বলাৎকারের অভিযোগ তোলা হয়েছে। নিপীড়নের শিকার শিশুরা সবাই হাটহাজারী পুন্ডরিকধাম মন্দিরের বাসিন্দা। এই মন্দিরেরই অধ্যক্ষ হিসেবে আছেন চিন্ময় দাস। বিভিন্ন কৌশলে রাতে শিশুদের নিজের ঘরে নিয়ে বলাৎকার করতেন চিন্ময়। ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বরে চার শিশু চিন্ময় দাশের বিরুদ্ধে নিপীড়নের লিখিত অভিযোগ করেন ইসকন যুক্তরাজ্যের আন্তর্জাতিক শিশু সুরক্ষা কার্যালয়ে (সিপিটি)। তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পেয়ে ওই বছরের ৬ অক্টোবর সিপিটি থেকে চিন্ময়কে ইসকনের নেতৃস্থানীয় পদে না রাখা, শিশু ও নারীদের সঙ্গে যোগাযোগে বিরত থাকাসহ পাঁচটি ক্যাটাগরিতে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, যা এখনো বহাল রয়েছে।
চিন্ময়ের নির্দেশে হাজারীগলিতে সেনাসদস্যদের ওপর অ্যাসিড নিক্ষেপ
৬ নভেম্বর চট্টগ্রামের হাজারীগলিতে এক মুসলমান দোকান কর্মচারী ইসকনের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সমালোচনা করে ফেসবুকে পোস্ট দেন। এরই জের ধরে ইসকনের সদস্যরা ওই দোকানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সদস্যরা সেখানে উপস্থিত হন। তারা চিন্ময়ের সঙ্গেও মুঠোফোনে আলোচনা করেন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য। কিন্তু ইসকন সমর্থকরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা করে। একপর্যায়ে কাচের বোতল ও অ্যাসিড ছুড়ে মারা হয় পুলিশ ও সেনাসদস্যদের ওপর। ইসকন সমর্থকদের ছোড়া এসিডে ঝলসে যান পাঁচ সেনা ও ৯ পুলিশ সদস্য।
চিন্ময়ের নির্দেশে আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যা
গত ২৬ নভেম্বর চট্টগ্রাম আদালত এলাকায় সরকারি আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ খুনে জড়িত ছিলেন চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের অনুসারী, নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের কর্মী ও ইসকন-সমর্থক আইনজীবী ও ক্লার্ক। ওই আইনজীবীকে ১০-১৫ জনের একটি সংঘবদ্ধ দল আক্রমণ চালিয়ে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। এর আগে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় চিন্ময়কে গ্রেফতার করে পুলিশ। আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিলে প্রিজনভ্যান আটকে বিক্ষোভ করতে থাকেন ইসকন সমর্থকরা। এসময় নজিরবিহীনভাবে পুলিশের হ্যান্ডমাইক ছিনিয়ে নিয়ে প্রিজন ভ্যানের ভেতর থেকেই উসকানিমূলক বক্তব্য দেন চিন্ময়। এর পরপরই ইসকন সমর্থকরা আদালত এলাকায় তাণ্ডব চালায়। পুলিশ বাধা দিলে ছড়িয়ে পড়ে সংঘর্ষ। এসময় আদালত পাহাড়ের নিচে রঙ্গম কমিউনিটি সেন্টারের গলিতে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফকে ধাওয়া করে নির্মমভাবে কুপিয়ে ও পিটিয়ে হত্যা করে ইসকনের সন্ত্রাসীরা।
চাঞ্চল্যকর এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সরাসরি জড়িত ১২ জনকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ। এর মধ্যে চারজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তারা পুলিশকে জানিয়েছে, চিন্ময় দাসের মুক্তির দাবিতে তার অনুসারীরা চট্টগ্রাম আদালত ভবনে সংঘর্ষে জড়ানো ও বিচারককে মারধর করার পরিকল্পনা নিয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা চরম ধৈর্যের পরিচয় দেওয়ায় আইনজীবীকে হত্যার মিশন নেওয়া হয়। আর এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আর্থিক সহায়তা করেন হাজারীগলির কাটাপাহাড় এলাকার অরবিন্দ ধর বসু নামের এক ইসকন নেতা।
প্রশাসনে ইসকনের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক
শিশুধর্ষণ, জমি দখল এমনকি সরাসরি আইনজীবী হত্যায় উসকানি দেওয়ার মতো গুরুতর অভিযোগ থাকলেও একটি মামলায়ও চিন্ময় দাসের নাম নেই। কারণ শেখ হাসিনার ১৬ বছরের শাসনামলে প্রশাসনে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে ইসকন। দেশের এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে ইসকনের সদস্যরা নেই। তাদের মাধ্যমেই দীর্ঘদিন ধরে ভারতে তথ্য পাচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এরই মধ্যে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তালিকা ধরে বিশেষ নজরে রেখেছেন তাদের। একটি সংস্থা থেকে ইসকন সদস্যদের একটি তালিকা পাওয়া গেছে। ওই তালিকায় রয়েছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের সাবেক কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়, পিবিআইয়ের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার, ঢাকা মহানগর পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, মহানগর যুবলীগের সহসভাপতি দেবশিষ পাল দেবু, চট্টগ্রাম বন্দরের সিবিএ নেতা আশীষ কান্তি মুহুরী, বন্দরের যান্ত্রিক বিভাগের কর্মকর্তা সঞ্চয় কুমার দে, বিশ্বজিৎ দেব, শজীব শর্মা, হৃদয় কুমার দাস (ছাত্রলীগের লায়ন্স সংঘের সাধারণ সম্পাদক), রতন কুমার দাস (চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবসায়ী), সৌরভ শাহ (চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবসায়ী), আশোক কুমার দাস (চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবসায়ী), বন্দর কর্মকর্তা নয়ন মণি, হিমেল বড়ুয়া, সুমন দাস, অপূর্ব কুমার চক্রবর্তী, কিশোর কান্তি দাস ও পর্ণব দাস (বন্দর থানার ইসকনের সাধারণ সম্পাদক)।
চিন্ময়ের নির্দেশেই ভারতে গিয়ে রাষ্ট্রবিরোধী অপপ্রচারে নেমেছেন তার আইনজীবী
চিন্ময় দাসের আইনজীবীর নাম রবীন্দ্র ঘোষ। তার পরিবারের অন্য সদস্যরা ভারতে বসবাস করলেও তিনি বাংলাদেশেই থাকতেন। তবে বর্তমানে চিকিৎসা ভিসায় ভারতে অবস্থান করছেন। সেখানে বসেই চিন্ময়ের নির্দেশে পতিত শেখ হাসিনার এজেন্ডা বাস্তবায়নে বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে চলেছেন। একটি গোয়েন্দা সংস্থা বলছে, ভারতের উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠন আরএসএসের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল রবীন্দ্র ঘোষের। এমন তথ্যের ভিত্তিতে তার ওপর নজরদারি শুরু করে বাংলাদেশের একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা। বিষয়টি বুঝতে পেরেই চিকিৎসার নামে ভারতে পালিয়ে যান তিনি। সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার ব্যারাকপুরে ছেলের ফ্ল্যাটে অবস্থান করছেন রবীন্দ্র ঘোষ। ১৬ ও ১৭ ডিসেম্বর দিনভর ভারতীয় গণমাধ্যমের মুখোমুখি হয়ে সপরিবারে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের উসকানি দেন। ১৮ ডিসেম্বর সাবেক বিজেপি সংসদ সদস্য অর্জুন সিং এবং সনাতনী কথিত ধর্মগুরু মুসলমানবিদ্বেষী কার্তিক মহারাজ তার সঙ্গে বৈঠক করেন। বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার ভারতীয় ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবেই এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় বলে তথ্য রয়েছে বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে। তিনি মূলত চিকিৎসার জন্য ভারতে থাকলেও তার ভিসার মেয়াদ রয়েছে ২০২৯ সাল পর্যন্ত। বাংলাদেশ হাইকমিশন বা সরকারের পক্ষ থেকে এখনো এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো হয়নি।
চিন্ময়ের পরিবারের কে কোথায়
চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ইসকন সদস্য হওয়ার পর তার মা সন্ধ্যা রানী ধরকে অনেকটা জোর করেই ইসকন সদস্য বানান চিন্ময়। বর্তমানে তিনি চিন্ময়ের সঙ্গে হাটহাজারী পুণ্ডরিখধামে থাকেন। তার বড় ভাই রঞ্জন ধর সাতকানিয়া কাঞ্চনা এলাকার একটি স্কুলে শিক্ষকতা করেন। মেজো ভাই অঞ্জন ধর চট্টগ্রামের ইপিজেড এলাকার একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন। বড় বোন অরুণা ধর গৃহিণী।
চিন্ময়কে বহিষ্কারের নাটক ইসকনের
৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার দিল্লিতে পলায়নের পর সংখ্যালঘু নির্যাতনের ভুয়া দাবি তুলে একের পর এক কর্মসূচির নামে দেশে অস্থিতিশীলতা তৈরির অপচেষ্টা করে সমালোচিত হন চিন্ময়। তীব্র সমালোচনার মুখে গত ৯ নভেম্বর ঢাকার স্বামীবাগের ইসকন আশ্রমে সংবাদ সম্মেলন করে সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাশ দাবি করেন, চার মাস আগে অর্থাৎ গত জুলাই মাসেই নৈতিক স্খলনের অভিযোগে চিন্ময়কে সংগঠন থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু সংখ্যালঘু নেতারা মনে করেন, বাংলাদেশে ইসকনের হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগের সুরক্ষা ও পাবলিক সেন্টিমেন্টের কারণেই এমন নাটক মঞ্চস্থ করেছে ইসকন। কারণ যে তারিখে চিন্ময়কে বহিষ্কারের গল্প শোনানো হচ্ছে, তারপর একাধিকবার ইসকন-নিয়ন্ত্রিত মন্দিরে বসে কথিত সনাতনী জাগরণী জোটের কর্মসূচি পালন করেছে চিন্ময়।
ইসকনের বক্তব্য
চন্দন কুমার ধর ওরফে চিন্ময় কৃষ্ণ দাস ব্রহ্মচারী কারাগারে বন্দি থাকায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে ইসকন বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক চারু চন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী চিন্ময়ের কর্মকাণ্ডের দায় নিতে অস্বীকার করে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘চিন্ময়ের সঙ্গে ইসকনের কোনো সম্পর্ক নেই। চট্টগ্রামের আইনজীবী সাইফুল ইসলাম আলিফ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গেও ইসকনের কোনো সম্পর্ক নেই। চারু চন্দ্র আরও বলেন, ‘আমরা স্পষ্টভাবে জানাতে চাই, এ ধরনের ন্যক্কারজনক ঘটনা এবং চলমান আন্দোলনের সঙ্গে ইসকন বাংলাদেশের কোনো ধরনের সম্পৃক্ততা নেই।’
Amardesh