বাংলাদেশে শেখ হাসিনার পতন নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন আকর্ষণীয় তত্ত্ব ঘুরপাক খাচ্ছে। তার মধ্যে একটি হলো, ৮৪ বছর বয়সী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূসই (যাঁকে অনেকে ‘সিআইএ এজেন্ট’ বলেও আখ্যায়িত করে থাকেন) আসলে আওয়ামী লীগকে উৎখাত করার ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং হাসিনার বাইরের সবচেয়ে বড় সমর্থক ও গুরুত্বপূর্ণ আঞ্চলিক শক্তি ভারতকেও তিনি বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে সরিয়ে দিয়েছেন।
আসলেই কি তাই?
দীর্ঘদিন ধরে এই উপমহাদেশে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব খুবই উপভোগ্য বিষয়। কারণ, ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রমাণ করার দরকার হয় না, আবার অনেক সময় তা অস্বীকার করারও জো থাকে না। দক্ষিণ এশিয়ার শাসকেরা যখনই তাঁদের অন্দরমহলে সংকটে পড়েছেন তখনই তাঁরা ‘বিদেশি হাত’ তত্ত্বের আশ্রয় নিয়েছেন।
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে ভারতীয় রাজনীতির প্রধান বিষয় ছিল ষড়যন্ত্রতত্ত্ব। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর কর্তৃত্ববাদী শাসন চালানোর সময় যখনই কোনো প্রতিরোধ বা আন্দোলনের মুখে পড়েছেন, তখনই তিনি তার জন্য বিদেশি হাত, বিশেষ করে সিআইএকে দায়ী করেছেন।
১৯৭৫ সালে জরুরি অবস্থা জারি করার সময় ইন্দিরা গান্ধী ও তাঁর বাম সমর্থকদের অভিযোগ ছিল, দেশের ‘ফ্যাসিবাদীরা’ এবং বিদেশের ‘সাম্রাজ্যবাদীরা’ তাঁর ‘প্রগতিশীল’ সরকারকে উৎখাত করার চেষ্টা চালাচ্ছে।
এত দিন বাদে কেউ কেউ মনে করেন, ‘উদীয়মান ভারত’ এখন আগের চেয়ে অনেক আত্মবিশ্বাসী এবং নিজেই নিজের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য যথেষ্ট। এবং সে কারণেই যেকোনো অনাকাঙ্ক্ষিত বা অপ্রত্যাশিত ঘটনার জন্য ভারতীয়রা ‘বিদেশি হাত’-কে হরেদরে দোষারোপ করে না।
কিন্তু সম্প্রতি ঢাকায় ‘একজন মিত্র হারানোর’ ধাক্কা দিল্লির অন্দরমহলে বিশৃঙ্খলার জন্ম দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
মনে রাখা দরকার, ষড়যন্ত্রতত্ত্বগুলো রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির জন্ম দেয় এবং সাধারণ জ্ঞানবুদ্ধি দিয়ে বিচার-বিবেচনা করাকে নিরুৎসাহিত করে। ষড়যন্ত্রতত্ত্ব আপনার চোখের সামনে ঘটে যাওয়া রাজনৈতিক বিপর্যয়ের কারণগুলোকে পর্যন্ত এড়িয়ে যেতে উদ্বুদ্ধ করে।
শেখ হাসিনা যে দিনকে দিন অজনপ্রিয় হয়ে পড়ছিলেন, তা বোঝার জন্য আপনার ভূ-রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ হওয়ার কোনো দরকার হবে না। তিনি নিজেই তাঁর দলকে দুর্বল করে ফেলেছিলেন এবং দলটিকে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে পরিণত করেছিলেন।
বারবার কারচুপির নির্বাচন ও ক্ষমতার একচেটিয়া কুক্ষিগতকরণ এবং উত্তরোত্তর বাড়তে থাকা কর্তৃত্ববাদের সঙ্গে কোভিড-পরবর্তী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মিলে বাংলাদেশে সরকারবিরোধী বারুদ জমা হয়েছিল। ক্রমাগত ঘনীভূত হওয়া সেই জনরোষের বারুদে কোটাবিরোধী ছাত্র আন্দোলন আগুন ধরিয়ে দেয়। এই অরাজনৈতিক ছাত্র আন্দোলনই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক বন্দুকে চূড়ান্ত ট্রিগার টিপে দেয়।
শেখ হাসিনা এখন ষড়যন্ত্রতত্ত্বকে আঁকড়ে ধরেছেন। এর জন্য আমরা অবশ্যই তাঁর প্রতি সহানুভূতি জানাতে পারি। কারণ তিনি হয়তো ক্ষমতা হারানোজনিত শোকের একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে আছেন; তিনি হয়তো জনগণের কাছে প্রত্যাখ্যাত হওয়ার গ্লানি বহনের প্রাথমিক অবস্থায় আছেন।
হাসিনা মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে উৎখাত করেছে; কারণ তিনি আমেরিকাকে বাংলাদেশে একটি সামরিক ঘাঁটি বানাতে দিতে চাননি।
সাম্প্রতিক সময়ের দক্ষিণ এশিয়ায় হাসিনাই একমাত্র নেতা নন যিনি ক্ষমতা হারানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করছেন।
২০২২ সালের এপ্রিলে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ইমরান খানকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার পর তিনিও এই অভিযোগ করেছিলেন।
হাসিনার মতো ইমরান খানও বলেছিলেন, আমেরিকাকে পাকিস্তানের মাটিতে একটি ঘাঁটি গড়তে দিতে না চাওয়ায় আমেরিকা তাঁর বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিল এবং আমেরিকার ইন্ধনেই তাঁকে গদিচ্যুত করা হয়েছিল।
এ কথা নিশ্চিত করেই বলা যায়, এশিয়ায় চীনের সামরিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলে সামরিক বাহিনীর ঘাঁটি ও সামরিক সুযোগ-সুবিধা খুঁজছে। তাই বলে যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে ঘাঁটি বানানো এতটাই দরকার যে, তার জন্য তারা অভ্যুত্থান সংগঠিত করছে—এই ধারণা পোষণ করা বাড়াবাড়ি হবে।
কিন্তু ষড়যন্ত্রতত্ত্বের মাথাচাড়া দেওয়ার জন্য প্রমাণের প্রয়োজন হয় না। এর মধ্য দিয়ে অভ্যুত্থান তত্ত্ব সিআইএ-কেও বাড়াবাড়ি রকমের কৃতিত্ব দিচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
সিআইএর দক্ষতা ও সক্ষমতা সম্পর্কে দক্ষিণ এশিয়ায় যেসব রটনা আছে তা আদতে সংস্থাটির প্রকৃত ক্ষমতাকে ছাপিয়ে গেছে। খেয়াল করুন: ভেনেজুয়েলার সাম্প্রতিক নির্বাচনে সেখানকার বহুল নিন্দিত প্রেসিডেন্ট নিকোলা মাদুরোকে সিআইএ ক্ষমতাচ্যুত করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেও তা করতে পারেনি। আবার যুক্তরাষ্ট্র ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে চেষ্টা চালিয়েও কিউবায় ক্ষমতায় থাকা কমিউনিস্ট শাসনকে উৎখাত করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই দুটো দেশই বলা যায় আমেরিকার একেবারে বাড়ির উঠোনে।
দক্ষিণ এশিয়ার ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকদের ঘোর লাগা কল্পনাশক্তিকে চাগিয়ে তোলার কাজ যে শুধু সিআইএ করে আসছে তা নয়। এই অঞ্চলের কোনো দেশের শাসন পরিবর্তিত হলে আজকাল আমাদের ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস উইং (সংক্ষেপে ‘র’) -কেও দায়ী করা হয়।
এসব সরকার পরিবর্তনের জন্য ‘বিদেশি হাতকে’ দোষারোপ করা ষড়যন্ত্র তাত্ত্বিকেরা বুঝে হোক বা না বুঝে হোক, শেষ পর্যন্ত ভারতীয় এস্টাবলিশমেন্টকেই গোয়েন্দা ব্যর্থতার জন্য দায়ী করে থাকেন।
বাংলাদেশ ভারতের খিড়কি দুয়ারের সঙ্গে লাগোয়া এবং বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের বহু বছরের ঘনিষ্ঠ লেনদেন চলে আসছে।
এ কারণে আপনি যদি বলেন, সিআইএ বাংলাদেশে একটি অভ্যুত্থান পরিচালনা করেছে, তাহলে ধরেই নেওয়া হয় আপনি দিল্লিকে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তটির বিষয়ে বেখবর থাকার জন্য অভিযুক্ত করছেন।
বাংলাদেশের আজকের এই সংকটের উৎপত্তি ও বিস্তার এবং এই সংকট নজরদারির জন্য দিল্লির ব্যবস্থাপনার ওপর ভারতের পক্ষ থেকে একটি গুরুতর ‘ময়নাতদন্ত’ করতে হবে। সেটি করা গেলে তা ভারতের আঞ্চলিক নীতির ক্ষেত্রে মূল্যবান পাঠ তৈরি করবে।
এটি মনে রাখা জরুরি, কোনো শক্তিই (তা সে বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক যা-ই হোক না কেন) কৌশলগত স্বার্থের ক্ষেত্রে রাজনীতিকে একচেটিয়াভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। একই সঙ্গে কোনো সরকারই (তা সে যত সম্পদশালীই হোক না কেন) অন্য দেশের মাঠ পর্যায়ের বাস্তবতা সম্পর্কে ভুল ধারণার খপ্পরে পড়ার ঝুঁকি থেকে মুক্ত নয়।
হাসিনার আজকের এই গল্পে বিজয় এবং ট্র্যাজেডি দুটোই আছে। তিনি অনেক ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে টিকে ছিলেন এবং পাকিস্তান থেকে তাঁর জাতির মুক্তির ধারা রক্ষা করে এসেছিলেন।
গত ১৫ বছরে তিনি বাংলাদেশকে একটি দ্রুত বর্ধনশীল অর্থনীতিতে পরিণত করেছেন এবং পাকিস্তানসহ অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর অনুসরণযোগ্য একটি ‘মডেল’ হিসাবে দাঁড় করিয়েছেন।
হাসিনা ভারত ও বাংলাদেশকে দেশ ভাগজনিত কিছু তিক্ততা মিটিয়ে ফেলতে, সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি করতে, আন্তসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের অবসান ঘটাতে, আঞ্চলিক যোগাযোগ বাড়াতে এবং দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক বাণিজ্য বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছেন।
তবে কিনা পৃথিবীর আর সব ট্র্যাজিক নায়কদের মতো তাঁরও মারাত্মক কিছু ত্রুটি ছিল। তাঁর অন্যতম ত্রুটি ছিল নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার দুর্নিবার সংকল্প। আরেকটি ত্রুটি ছিল, জাতীয়তা ও ইতিহাস নিয়ে দেশের মানুষের মধ্যে সৃষ্ট গভীর রাজনৈতিক বিভাজনকে সারিয়ে তোলায় তাঁর ব্যর্থতা।
তবে হাসিনাকে মর্মান্তিক পরিণতি বরণ করতে হলেও তিনি আধুনিক উপমহাদেশের বিবর্তনধারায় একজন সত্যিকারের ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে টিকে থাকবেন।
হাসিনার ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়া নিয়ে ভারতের অনুশোচনা করার বিস্তর কারণ আছে। কিন্তু গত কয়েক দিনে যা ঘটে গেছে, সেই ঘটনাবলির মধ্যে দিল্লিকে আটকে রাখা ঠিক হবে না।
দ্বিপক্ষীয় কৌশলগত অংশীদারির ক্ষেত্রে হাসিনা যে মজবুত ভিত্তি তৈরি করে গেছেন, সেটিকে এগিয়ে নিতে দিল্লিকে অবশ্যই ঢাকার নতুন সরকারকে সহযোগিতা করতে হবে।
বাংলাদেশের এই নতুন ছাত্র আন্দোলন রাজনৈতিক উদারীকরণ এবং বৃহত্তর অর্থনৈতিক সুযোগ খুঁজছে। সে কারণে দিল্লিকে অবশ্যই ছাত্র আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতির বার্তা দিতে হবে।
যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে অবিলম্বে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার এবং দেশটির দীর্ঘমেয়াদি অগ্রগতি অর্জনের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে বলে মনে হচ্ছে, সেহেতু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করতেই হবে।
বেশ কয়েক বছরে দিল্লি ও ওয়াশিংটন দক্ষিণ এশিয়ার ইস্যুতে একে অপরের কাছাকাছি চলে এসেছে। গত কয়েক মাসে বাংলাদেশের বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় মতপার্থক্য কমানোর জন্য ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র চেষ্টা চালিয়ে গেছে।
স্মরণ করুন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দিল্লিতে জি-টোয়েন্টি সম্মেলনে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে শেখ হাসিনাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এবং ঢাকার ওপর রাজনৈতিক চাপ কমাতে ওয়াশিংটনকে অনুরোধ করেছিলেন।
বাংলাদেশে জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে অনেক প্রশ্ন থাকা সত্ত্বেও বাইডেন প্রশাসন হাসিনার নেতৃত্বাধীন নতুন সরকারকে সহযোগিতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে যে সংকট উপস্থিত হলো তার জন্য দিল্লি ও ওয়াশিংটনের মধ্যকার কোনো বিরোধ কার্যকারণ হিসেবে কাজ করেনি। মূলত বাংলাদেশের সঙ্গে হাসিনার দ্রুত বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়াই এই সংকটের মূল কারণ।
- সি. রাজা মোহন সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের ভিজিটিং প্রফেসর এবং দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক
- ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত আকারে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ
- prothom alo