ক্যাম্পাস রাজনীতিমুক্ত রাখার দাবিতে আন্দোলন করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থীরা। আর ছাত্রলীগ বলছে, যেকোনো মূল্যে বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালু করা হবে।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও বুয়েট শিক্ষার্থী ইমতিয়াজ হোসেন রাহিমের করা রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আজ হাইকোর্টও বুয়েটে সব রাজনৈতিক সংগঠন ও এর কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দেওয়া ‘জরুরি বিজ্ঞপ্তি’ স্থগিত করেছেন।
হাইকোর্টের আদেশসহ ক্যাম্পাসের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টার কথা বলেছে বুয়েটের উপাচার্য অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদারের সঙ্গে।
দ্য ডেইলি স্টার: বুয়েটে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের যে আদেশ, সে বিষয়ে আপনার বক্তব্য জানতে চাই।
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ মজুমদার: আমার কাছে এখনো রায়ের কপি আসেনি, এলে তারপর মন্তব্য করতে পারব।
ডেইলি স্টার: হাইকোর্টের আদেশ শুনেছেন নিশ্চয়ই। তার ওপর ভিত্তি করে…
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: কোনো রিটের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের ওপর যদি কোনো আদেশ আসে, তাহলে আমাদের লিগ্যাল অ্যাডভাইজারের সঙ্গে পরামর্শ করে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। সেখানে যদি আমাদের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতামত নিতে হয়, তাহলে সেটা নেওয়া হবে।
ডেইলি স্টার: শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আপনাদের অবস্থান কী?
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: গতকাল রোববার শিক্ষার্থীরা সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন যে তারা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। তারা যদি নিরাপত্তার নিশ্চয়তা পান, তাহলে ক্লাস-পরীক্ষায় জয়েন করবেন। তাদের কাছে নিরাপত্তার বিষয়টিই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডেইলি স্টার: তার মানে কি বুয়েট ক্যাম্পাস অনিরাপদ?
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: শিক্ষার্থীরা সেটা মনে করছেন, কিন্তু আমি তা মনে করি না। তারা এখন এখানে আন্দোলন করছেন, এর আগে ক্লাস-পরীক্ষা দিয়েছেন—নিরাপত্তার প্রশ্ন কোথা থেকে আসলো? আমাদের ক্যাম্পাস নিরাপত্তাহীন হওয়ার তো প্রশ্নই আসে না। তবুও তারা এটা মনে করছেন।
তাদের আরেকটা দাবি ছিল যে তাদের সব দাবি পূরণ হতে হবে এবং নিরাপত্তা দিতে হবে, তাহলে তারা পরীক্ষা দিতে আসবে। তাদের সব দাবি যে পূরণ হয়নি সেটাই বলতে চাচ্ছে।
আমাদের পক্ষ থেকে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম চলছে। পরীক্ষা চলবে, কারণ এটা অ্যাকাডেমিক কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত। শিক্ষার্থীরা চাইলে যেকোনো সময় পরীক্ষার হলে আসতে পারেন।
ডেইলি স্টার: পরীক্ষা যদি তারা না দেন?
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: এখন পরীক্ষা না দিলে তাদেরকে পরে আবার এই পরীক্ষা দিতে হবে। তাদেরকে তো পাস করতে হবে।
ডেইলি স্টার: আন্দোলন বা অন্য যেকোনো কারণে পরীক্ষা না দিলে ভুক্তভোগী হতে হবে শিক্ষার্থীদেরকেই…
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: কোনো বিষয়ে পরীক্ষা না দিলে তো ফেল করবে, আবার পরীক্ষা দিয়ে পাস করতে হবে। টার্ম সিস্টেমে কোনো বিষয়ে পরীক্ষা না দিলে ফেল করবে। কাজেই অন্য সময়ে তাকে রিটেক দিতে হবে।
ডেইলি স্টার: শিক্ষার্থীদের সব দাবি মানার কি সম্ভাবনা আছে?
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: সব দাবির মধ্যে অনেক কিছু আছে। সব তো এই মুহূর্তেই মানা সম্ভব হবে না। আমরা তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেলে তারপর বুঝতে পারব যে তারা শাস্তি পাওয়ার যোগ্য কি না, হলে কী শাস্তি দিতে হবে। তদন্ত প্রতিবেদনের আগে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না। এতদিন কি তারা পরীক্ষা না দিয়ে বসে থাকবেন?
তাদের মূল দাবিগুলো পূরণ করতে হলে তদন্ত করতে হবে। তদন্তের জন্য ডিজিটাল সিস্টেমে সব থাকতে হবে, রাতে বুয়েট ক্যাম্পাসে যারা এসেছিল তাদের ছবিগুলো তোলা আছে কি না, আইডেন্টিফাই করতে হবে যে তারা কতজন ছিলেন, কতক্ষণ ছিলেন, কে ছিলেন। তদন্ত প্রতিবেদনে যদি সব পরিষ্কার হয়, তার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা বুঝতে পারব যে কে এসেছিল, কেন এসেছিল। এর ওপর ভিত্তি করে তদন্ত কমিটি একটা সুপারিশ করবে।
ক্যাম্পাসে হিযবুত তাহরীর আসার বিষয়েও আমরা একটি তদন্ত কমিটি করেছি। সেটার ফুটেজও আমরা সংগ্রহ করেছি, তদন্ত করা হচ্ছে।
ডেইলি স্টার: আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলছেন যে বুয়েট ক্যাম্পাস জঙ্গিবাদের ঘাঁটি। আপনিও কি তাই মনে করেন?
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: এমন কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। যদি সে ধরনের কোনো তথ্য পাই, তাহলে বুঝতে পারব। আমাদের কাছে শিক্ষার্থীদের অ্যাকাডেমিক তথ্য আছে। কিন্তু তাদের ব্যক্তিজীবনের তথ্য—রাজনীতি বা অন্য কোনো কর্মকাণ্ডের তথ্য আমাদের কাছে নেই। সরকার থেকে যদি আমাদের কাছে তথ্য দেওয়া হয়, তাহলে সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ডেইলি স্টার: আপনার শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চাইছে না। অপর দিকে ছাত্রলীগ জোর দিয়ে বলছে যে যেকোনো মূল্যে বুয়েটে নিয়মতান্ত্রিক ছাত্ররাজনীতি চালু করা হবে। সার্বিকভাবে এখানে কি একটা নিরাপত্তাহীনতার পরিবেশ তৈরি হয়েছে? তারা কি মুখোমুখি অবস্থানে চলে এসেছে?
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: ২০১৯ সালে নিয়ম করা হয়েছিল যে বুয়েট ক্যাম্পাসে রাজনীতি করা যাবে না। তখন যে পরিস্থিতির কারণে এই নিয়ম করা হয়েছিল, সেটার কারণে হয়তো শিক্ষার্থীদের মনে একটা ভয় রয়ে গেছে। সেদিন রাতে ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে এসেছিল, সেটাও ভয় বেড়ে যাওয়ার একটা কারণ হতে পারে। তাদের এই ভয় দূর করার জন্য একটা সময় প্রয়োজন। আমাদের শিক্ষার্থীরা যদি ছাত্রলীগের কার্যক্রম দেখে, তাদের ভালো কাজগুলো দেখে, তাদের সঙ্গে আলোচনা করে—তাহলে এক সময় হয়তো শিক্ষার্থীদের মনে ছাত্ররাজনীতি নিয়ে ভয় থাকবে না। তখন তারা হয়তো এ বিষয়ে ওপেন মাইন্ডেড হবে।
ডেইলি স্টার: গত কয়েক বছরে ছাত্রলীগের ভালো কাজগুলো কী কী? যদি বলতেন, তাহলে শিক্ষার্থীদের সামনে তা তুলে ধরতে পারি।
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: আপনারা সাংবাদিক, ছাত্রলীগের ভালো দিকগুলো আমাদের চেয়ে আপনার ভালো জানা উচিত। ছাত্রলীগের মাধ্যমেই তো বাংলাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছিল। ছাত্রলীগের মাধ্যমেই আমাদের ভাষা আন্দোলন হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হয়েছিল।
ডেইলি স্টার: এগুলো বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের গৌরবময় অতীতের কথা। বাংলাদেশের এমন কোনো অর্জন নেই যেখানে ছাত্রলীগের ভূমিকা নেই। কিন্তু সেগুলো তো অতীত। বর্তমানে ছাত্রলীগের ভালো কাজগুলো বললে শিক্ষার্থীদের বুঝতে সুবিধা হতো, তাদের ভয় কাটাতে সুবিধা হতো। তাদের মাঝে ছাত্রলীগ নিয়ে এক ধরনের আতঙ্ক রয়েছে।
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: ছাত্রলীগের ভালো দিক সম্পর্কে ছাত্রলীগের কাছে জানতে চাইলেই ভালো হয়। আর বুয়েট শিক্ষার্থীদের কাছে জানতে চাইতে পারেন যে তারা ছাত্রলীগ সম্পর্কে কী চিন্তা করে।
ডেইলি স্টার: শিক্ষার্থীরা মনে করছে যে ছাত্রলীগ মানেই এক ধরনের আতঙ্ক। বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ থাকলে আবার আবরারের মতো তাদের কাউকে পিটিয়ে হত্যা করা হবে।
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: এটা তাদের ব্যক্তিগত অভিমত। ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তারা হয়তো এসব বলছে। তাদের এই অভিমত বিষয়ে তো আমি বলতে পারব না।
ডেইলি স্টার: আবরারের বিষয়টি নিয়ে বলেন।
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: হ্যাঁ, ওই ঘটনা থেকে তাদের ভেতরে যে ভয় ঢুকে গেছে সেটা এখনো যায়নি। আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি।
ডেইলি স্টার: সেই ভয়টা কী দূর হবে? আবার রাজনীতি চালু হলে কি সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে না, এমন নিশ্চয়তা দেওয়া যায়?
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: এর জন্য একটা সময়ের প্রয়োজন এবং আমার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের মধ্যে একটা বোঝাপড়া প্রয়োজন। এই বোঝাপড়ার জন্য একটা সময় দরকার। আর শিক্ষার্থীদের ভয় দূর করার জন্য কী করণীয় তা নির্ধারণে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।
ডেইলি স্টার: বিশেষজ্ঞ বলতে কাদের কথা বোঝাচ্ছেন—রাজনীতিবিদ নাকি শিক্ষক?
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: যাদেরকেই দরকার হয়। একটা সমাজে থাকতে গেলে সবার সঙ্গে সবাইকে মিলেমিশে থাকতে হয়। ভয় নিয়ে একজনের সঙ্গে একজন চলতে পারবে না। এই ভয় কাটাতে করণীয় বের করতে হবে। এর আগেও তো শিক্ষার্থীরা এখানে রাজনীতি করেছে।
ডেইলি স্টার: এই আন্দোলনের দুটি রূপ নিয়ে আলোচনা—সাধারণ শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে আন্দোলন এবং ছাত্রলীগের দাবি অনুযায়ী, হিযবুত তাহরীর কিংবা শিবিরের নেতৃত্বে আন্দোলন। উপাচার্য হিসেবে আপনার কাছে কী মনে হয়, কাদের নেতৃত্বে আন্দোলনটা হচ্ছে?
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: এটা তদন্ত না করলে বুঝতে পারব না। আমার কাছে যারা আসেন তারা সবাই সাধারণ শিক্ষার্থী। তাদের পেছনে কে আছে সেটা আমি জানি না, এমনকি আদৌ তাদের পেছনে কেউ আছে কি না, সেটাও আমি জানি না।
ডেইলি স্টার: আলোচনা বা ভয়ের জায়গা রয়েছে যে আমাদের দেশে কোনো তদন্তই সঠিকভাবে আলো মুখ দেখে না…
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: এটা সঠিক না। তদন্ত হয়, তার প্রতিবেদন বের হয় এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। আবার সেই তদন্ত প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রিট হয়, শুনানি হয়। গত এক বছরে অনেক আপিল হয়েছে, কাজ হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদন এখন সঠিকভাবেই চলে আসে।
ডেইলি স্টার: বুয়েট শিক্ষার্থী বা ছাত্রলীগের উদ্দেশে আপনার কিছু বলার আছে?
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: ছাত্রলীগ যা চাইছে, ছাত্রজীবনে সেটার প্রয়োজন আছে এবং বুয়েট শিক্ষার্থীরাও সেটা জানে। কিন্তু আমাদের শিক্ষার্থীরা ছাত্ররাজনীতি করার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ পাচ্ছে না, তার ভয় পাচ্ছে। কাজেই সেই পরিবেশ কীভাবে তৈরি করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে, কাজ করতে হবে।
ডেইলি স্টার: এর জন্য সাধারণ শিক্ষার্থীদের কী করার আছে?
অধ্যাপক সত্য প্রসাদ: আমাকেই যদি সব প্রশ্ন করেন, তাহলে তো আর উত্তর দিতে পারব না। এখানে কিছু সাইকোলজিক্যাল ব্যাপার আছে। সেটা দূর করতে করণীয় সম্পর্কে সাইকোলজিস্টদের পরামর্শ নিতে হবে। ক্যাম্পাসে পরিবেশটা কীভাবে তৈরি করে তাদের মধ্যে সম্প্রীতি তৈরি হবে, সেটা একজন স্যোসিওলজিস্ট বলতে পারবেন।
বুয়েট শিক্ষার্থী ও ছাত্রলীগ যে দাবিতে পাল্টাপাল্টি অবস্থানে রয়েছে, সেই অবস্থান দূর করতে হলে অনেক কাজ করার আছে। শিক্ষার্থীদের মনের ভয় দূর করতে হবে আগে। এই ভয় দূর করতে হলে পরিবেশ বদলে একটা পর্যায়ে আনতে হবে, তারপর ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চালু করার যেতে পারে। বর্তমান পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই বুয়েট ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি চালু করা হলে সেটা ভুল সিদ্ধান্ত হতে পারে।
Daily Star Bangla