সিঙ্গাপুরে শীর্ষ ধনীদের তালিকায় ২০১৮ সালেই নাম লিখিয়েছেন সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। কয়েক বছর ধরেই সে দেশে তার সম্পদের পরিমাণ বাড়ছে। যদিও দেশে অনেকটা উল্টো পথেই হাঁটছে সামিট পাওয়ার। কোম্পানিটির মুনাফায় নেমেছে ধস, যা চার বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন পর্যায়ে পৌঁছেছে। এক বছরেই মুনাফা কমেছে প্রায় ৫০২ কোটি টাকা। পাশাপাশি দায়দেনা অনেক বেড়ে গেছে সামিট পাওয়ারের। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে গেছে কোম্পানিটির ডেট-ইকুইটি অনুপাত।
এদিকে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিদ্যুৎ খাতের বড় কোম্পানিগুলোর মধ্যেও মুনাফার দিক দিয়ে খারাপ অবস্থায় রয়েছে সামিট পাওয়ার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ইপিএস (শেয়ারপ্রতি আয়) তুলনামূলকভাবে কম ছিল কোম্পানিটির। বিদ্যুৎ খাতের গড় ইপিএসের অর্ধেকেরও কম সামিটের শেয়ারপ্রতি আয়। যদিও চার বছর ধরেই সামিট পাওয়ারের বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা একই (১৫টি) রয়েছে। কোম্পানিটির সর্বশেষ আর্থিক প্রতিবেদনে এ চিত্র উঠে এসেছে।
সূত্রমতে, সিঙ্গাপুরের শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় গত বছর টানা ষষ্ঠবারের মতো নাম ওঠে মুহাম্মদ আজিজ খানের। বিজনেস সাময়িকী ফোর্বসের গত সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত তালিকায় তিনি ছিলেন ৪১ নম্বরে। তার সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয় এক দশমিক ১২ বিলিয়ন বা ১১২ কোটি ডলার। প্রতি ডলারের বিনিময়মূল্য ১১০ টাকা ধরে হিসাব করলে বাংলাদেশি মুদ্রায় তার সম্পদের পরিমাণ ১২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা। এর আগে ২০২২ সালে তার সম্পদের পরিমাণ ছিল এক বিলিয়ন বা ১০০ কোটি ডলার, ২০২১ সালে ৯৯ কোটি ডলার ও ২০২০ সালে ৯৫ কোটি ডলার।
ফোর্বসের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা মুহাম্মদ আজিজ খান দেশটির শীর্ষ ৫০ ধনীর তালিকায় প্রথম স্থান পান ২০১৮ সালে। ওই বছর সিঙ্গাপুরে তার ও তার পরিবারের সম্মিলিত সম্পদের পরিমাণ ছিল ৯১ কোটি মার্কিন ডলার। তবে ২০১৯ সালে মুহাম্মদ আজিজ খান জাপানি প্রতিষ্ঠান জেরার কাছে সামিট পাওয়ার ইন্টারন্যাশনালের ২২ শতাংশ শেয়ার ৩৩ কোটি ডলারে বিক্রি করে দেন। ফলে ২০১৯ সালে তার সম্পদের পরিমাণ কমে যায়। ওই বছর তার সম্পদের পরিমাণ দাঁড়ায় ৮৫ কোটি ডলার। তবে এর পর থেকে আবার তার সম্পদের পরিমাণ বাড়তে শুরু করে।
এদিকে সামিট পাওয়ারের আর্থিক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০২৩ সালের ৩০ জুনে শেষ হওয়া হিসাববছরে সামিট পাওয়ারের আয় তথা টার্নওভার দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৫১৭ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর আগের বছরে (২০২১-২২) তা ছিল পাঁচ হাজার ৩১৮ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। অর্থাৎ গত হিসাববছরে কোম্পানিটির আয় বেড়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বা তিন দশমিক ৭৫ শতাংশ। যদিও আয় বৃদ্ধির প্রভাব পড়েনি কোম্পানির মুনাফায়। বরং গত হিসাববছরে সামিট পাওয়ারের করপরবর্তী মুনাফা কমেছে ৭৪ দশমিক ৫২ শতাংশ।
গত হিসাববছরে সামিট পাওয়ারের করপরবর্তী মুনাফা দাঁড়ায় ১৭১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ছিল ৬৭৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত হিসাববছরে সামিটের মুনাফা কমেছে ৫০১ কোটি ৫৪ লাখ টাকা। এর আগে ২০২০-২১ হিসাববছরে কোম্পানিটির করপরবর্তী মুনাফার পরিমাণ ছিল ৮৪২ কোটি ৯২ লাখ টাকা ও ২০১৯-২০ অর্থবছর ৮৪৮ কোটি ৩৮ লাখ টাকা। অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবেই সামিট পাওয়ারের মুনাফা কমছে। তবে গত হিসাববছরে এর হার অনেক বেড়ে গেছে।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, নিট মুনাফার পাশাপাশি সামিট পাওয়ারের মুনাফা মার্জিনেও ধস নেমেছে। ২০১৯-২০ হিসাববছরে কোম্পানিটির মুনাফা মার্জিন ছিল ৩৫ দশমিক ৩০ শতাংশ। ২০২০-২১ হিসাববছরে তা কমে দাঁড়ায় ২১ দশমিক ২৫ শতাংশ, ২০২১-২২ হিসাববছরে ১২ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ২০২২-২৩ অর্থবছরে তিন দশমিক ১১ শতাংশ। অর্থাৎ গত হিসাববছরে সবচেয়ে কম মুনাফা মার্জিন ছিল সামিট পাওয়ারের। এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি কোম্পানিটির।
যদিও বার্ষিক প্রতিবেদনে কোম্পানিটির আর্থিক অবস্থা নাজুক হওয়ার কয়েকটি কারণ ও চেয়ারম্যানের বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে। সামিটের লোকসানের অন্যতম কারণ হিসেবে ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়াকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এতে ডলারে ঋণ পরিশোধ ও জ্বালানি তেলের মূল্য পরিশোধ ব্যয় বেড়ে গেছে। এছাড়া ঋণের সুদহার বিশেষ করে বিদেশি ঋণের সুদহার অনেক বেড়েছে। এছাড়া বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) বিল পরিশোধেও বিলম্ব করছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান উল্লেখ করেছেন, গত হিসাববছরটি ছিল সামিটের ইতিহাসে ২৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ বছর। তৃতীয় ও চতুর্থ প্রান্তিকে সামিট পাওয়ার ১২ কোটি ও ১২৪ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। এতে সার্বিকভাবে কোম্পানির মুনাফা অনেক কমে গেছে। তবে চলতি হিসাববছরে (২০২৩-২৪) কোম্পানিটি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। চলতি হিসাববছরের প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় প্রান্তিকে সামিট ১৫০ কোটি টাকারও বেশি মুনাফা করেছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
কোম্পানির সার্বিক অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে মুহাম্মদ আজিজ খান উল্লেখ করেন, করোনার ধাক্কা সামলে উঠতে না উঠতেই ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে সরবরাহ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে জ্বালানি তেলের দাম প্রতি ব্যারেল ৬০ ডলার থেকে বেড়ে ১১২ ডলারে পৌঁছায়। তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাসের (এলএনজি) দাম ১০ ডলার থেকে বেড়ে ৪০ ডলারে ঠেকে। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে। দেশের সব বিদ্যুৎ কোম্পানিই এজন্য লোকসান গুনেছে।
তিনি আরও বলেন, বিপিডিবি আনডিসপিউটেড বিদ্যুৎ বিল পরিশোধে সাত মাস বিলম্ব করে। এটি সামিট পাওয়ারের ওপর দ্বিগুণ ক্ষতিকর প্রভাব ফেলেছে। প্রথমত, অপরিশোধিত বিলের বিলম্বজনিত সময়ের জন্য সামিট পাওয়ারকে বাড়তি সুদ পরিশোধ করতে হয়েছে। দ্বিতীয়ত, যখন বিপিডিবির বিল পাওয়া গেছে, তত দিনে ডলারের বিনিময় হার ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। এতে তেলের দাম ও ঋণ পরিশোধে বাড়তি দরে ডলার কিনতে হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, দেশের অন্যান্য বিদ্যুৎকেন্দ্র একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হলেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বিদ্যুৎ খাতের কয়েকটি কোম্পানি গত হিসাববছরে বেশ ভালো মুনাফা করেছে। সামিট পাওয়ারের আর্থিক প্রতিবেদনেই বিষয়টি উঠে আসে। এক্ষেত্রে ইপিএসের দিক দিয়ে সবচেয়ে ভালো অবস্থায় রয়েছে ইউনাইটেড পাওয়ার। গত হিসাববছরে কোম্পানিটির ইপিএস ছিল ১৩ টাকা ৮৩ পয়সা। এছাড়া ডরিন পাওয়ারের ইপিএস ছিল তিন টাকা ৫৬ পয়সা। আর সামিট পাওয়ারের ইপিএস কমে দাঁড়ায় দুই টাকা সাত পয়সায়। এ সময় বিদ্যুৎ খাতের কোম্পানিগুলোর গড় ইপিএস ছিল চার টাকা ৩১ পয়সা।
এদিকে সামিট পাওয়ারের ঋণ-ইকুইটি অনুপাত দুই বছর ধরে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় পৌঁছেছে। গত হিসাববছরে তা দাঁড়ায় ১০৬ দশমিক ১০ শতাংশে। অর্থাৎ ১০০ টাকা মালিকানা স্বত্ব বা ইক্যুইটির বিপরীতে কোম্পানির ঋণ দাঁড়িয়েছে ১০৬ টাকা ১০ পয়সায়। এর আগে ২০২০-২১ হিসাববছরে এ অনুপাত ছিল ৬৯ দশমিক ৩৬ শতাংশ ও ২০১৯-২০ হিসাববছরে ৬৯ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
অন্যদিকে সামিট পাওয়ারের রিটার্ন অব ইকুইটি অনুপাত ধারাবাহিকভাবে কমছে। এ অনুপাত ২০২২-২৩ হিসাববছরে দাঁড়ায় পাঁচ দশমিক ৬১ শতাংশ, যা ২০২১-২২ হিসাববছরে ছিল ১১ দশমিক শূন্য দুই শতাংশ, ২০২০-২১ হিসাববছরে ১৫ দশমিক ৯২ শতাংশ ও ২০১৯-২০ হিসাববছরে ১৬ দশমিক ২০ শতাংশ। একই অবস্থা কোম্পানিটির রিটার্ন অব অ্যাসেটের ক্ষেত্রেও। গত কয়েক বছরের মধ্যে ওই অনুপাতও সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে।
শুধু তাই নয়, আর্থিক অবস্থা খারাপ হওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগকারীদের মুনাফা দেয়ার হারও কমিয়েছে সামিট পাওয়ার। গত হিসাববছরে কোম্পানিটি ১০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছে। এর আগে ২০২১-২২ হিসাববছরে দিয়েছিল ২০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ। তবে ২০২০-২১, ২০১৯-২০ ও ২০১৮-১৯ হিসাববছরে ৩৫ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ দিয়েছিল কোম্পানিটি।
sharebiz