চলতি অর্থবছরের (২০২৩-২৪) প্রথম আট মাসে (জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি) দেশে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় এসেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে। প্রবাসী আয়ে ইউএইর পরে রয়েছে যুক্তরাজ্য, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালির অবস্থান।
গত দুই অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে ইউএই তৃতীয় ও যুক্তরাজ্য চতুর্থ অবস্থানে ছিল। আর প্রথম ও দ্বিতীয় অবস্থানে ছিল যথাক্রমে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে শীর্ষে উঠে এসেছে ইউএই ও যুক্তরাজ্য। তালিকায় ওপরের দিকে উঠেছে।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মূলত সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র থেকে বৈধ চ্যানেলে প্রবাসী আয় আসা কমেছে। তার বিপরীতে ইউএই ও যুক্তরাজ্য থেকে প্রবাসী আয় আসা বেড়েছে। এ কারণে দেশভিত্তিক প্রবাসী আয়ে এমন পরিবর্তন দেখা গেছে।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, বর্তমানে দেশের ধনী গোষ্ঠী, উদ্যোক্তা ও রাজনৈতিক ব্যক্তিদের অন্যতম পছন্দের গন্তব্য হয়ে উঠেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের শহর দুবাই। দুবাইয়ে বাংলাদেশিদের ব্যবসাও বাড়ছে। এ কারণে বিশ্লেষকদের কেউ কেউ ধারণা করছেন, দেশ থেকে দুবাইয়ের পাচার হওয়া অর্থের একটি অংশ হয়তো পাচারকারীরা ফেরত আনছেন প্রণোদনার সুবিধা নিতে। প্রণোদনার সুবিধা নেওয়ার পর সেই অর্থ হয়তো আবারও অবৈধ পথে পাচার হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে বৈধ পথে ইউএই থেকে প্রবাসী আয় আসা হঠাৎ করে বেড়ে গেছে।
তবে ব্যাংকাররা বলছেন, প্রবাসী আয়ে এখন ব্যাংকগুলো ভালো সুবিধা দিচ্ছে। এ কারণে বৈধ পথে আয় আসা বাড়ছে। বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, প্রবাসীরা বৈধ পথে টাকা পাঠালে এখন ভালো সুবিধা পাচ্ছেন। ব্যাংকগুলোও বৈধ পথে অর্থ পাঠাতে প্রবাসীদের নানাভাবে উৎসাহ দিচ্ছে। বিশেষ করে ইউএইতে অনেক প্রচারণা চালানো হয়েছে। এ কারণে দেশটি থেকে প্রবাসী আয় আসা বেড়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোট ১ হাজার ৫০৮ কোটি মার্কিন ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে এসেছে প্রায় ২৯১ কোটি ডলার। যুক্তরাজ্য থেকে এসেছে প্রায় ১৮৮ কোটি ডলার, সৌদি আরব থেকে ১৭৯ কোটি ডলার, যুক্তরাষ্ট্র থেকে ১৬৮ কোটি ও ইতালি থেকে প্রায় ১০০ কোটি ডলার এসেছে। এ পাঁচ দেশ থেকেই চলতি অর্থবছরের আট মাসে এসেছে প্রবাসী আয়ের প্রায় ৬১ শতাংশ অর্থ।
আয় বাড়ছে ইউএই থেকে
২০২১-২২ অর্থবছরে ইউএই থেকে প্রায় ২০৭ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছিল। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৩০৩ কোটি ডলারে। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসেই এসেছে প্রায় ২৯১ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছর শেষ হতে এখনো চার মাস বাকি। গত আট মাসে দেশটি থেকে গড়ে প্রতি মাসে ৩৬ কোটি ৩২ লাখ ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। এই গড়ে প্রবাসী আয় আসা অব্যাহত থাকলে দেশটি থেকে বাকি চার মাসে আরও ১৪৫ কোটি ডলার প্রবাসী আয় আসার সম্ভাবনা রয়েছে। তাতে সব মিলিয়ে চলতি অর্থবছর শেষে ইউএই থেকে আসা প্রবাসী আয় ৪৩৫ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
ইউএইর পাশাপাশি চলতি অর্থবছরে যুক্তরাজ্য থেকেও প্রবাসী আয় আসা বেড়েছে। গত দুই অর্থবছরে দেশটি থেকে প্রবাসীরা যথাক্রমে প্রায় ২০৪ ও ২০৮ কোটি ডলার প্রবাসী আয় পাঠিয়েছিলেন। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে দেশটি থেকে এসেছে প্রায় ১৮৮ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরে প্রতি মাসে গড়ে দেশটি থেকে যে প্রবাসী আয় আসছে, তাতে বছর শেষে তা ২৫০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পিছিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র
দেড় বছরের বেশি সময় ধরে সৌদি আরব থেকে প্রবাসী আয় আসা কমেছে। তাতে প্রবাসী আয়ে শীর্ষস্থান হারিয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে নেমেছে দেশটি। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী আয়ে শীর্ষে ছিল সৌদি আরব। ওই বছর দেশটি থেকে ৪৫৪ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছিল। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসেছিল ৩৭৬ কোটি ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে দেশটি থেকে এসেছে প্রায় ১৭৯ কোটি ডলার। বর্তমানে দেশটি থেকে প্রবাসী আয়ের যে ধারা, তাতে অর্থবছর শেষে তা ৩০০ কোটি ডলারের নিচে থাকবে বলে ধারণা করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
সৌদি আরবের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র থেকেও প্রবাসী আয় আসা কমে গেছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে এসেছিল প্রায় ৩৪৪ কোটি ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তার পরিমাণ ছিল ৩৫২ কোটি ডলার। আর চলতি অর্থবছরের প্রথম আট মাসে দেশটি থেকে প্রায় ১৬৮ কোটি ডলার প্রবাসী আয় এসেছে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রবাসী আয় আসার বর্তমান যে ধারা, সেটি অব্যাহত থাকলে বছর শেষে দেশটি থেকে প্রবাসী আয় দাঁড়াতে পারে ২৫০ কোটি ডলারের আশপাশে।
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন
প্রবাসী শ্রমিকদের নিয়ে কাজ করে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু)। সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ার তাসনিম সিদ্দিকী বলেন, বিনিময় হারের পার্থক্য, ব্যাংকের প্রতি অনাস্থার কারণে অনেকেই হুন্ডিতে প্রবাসী আয় পাঠাচ্ছেন। এ ছাড়া সৌদি আরবে সাম্প্রতিক সময়ে বৈধ ভিসায় যাওয়া অনেক প্রবাসী শ্রমিক চাকরি পাচ্ছেন না; যাঁদের অনেকেই কাজ না পেয়ে দেশে ফিরে আসছেন। এসব কারণে সৌদি আরব থেকে প্রবাসী আয় কমে গেছে।
তাসনিম সিদ্দিকী আরও বলেন, গত দুই বছরে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে—এ আশঙ্কায় সেখান থেকে দেশে অর্থ আসা বেড়ে গিয়েছিল। সে কারণে গত কয়েক বছর দেশটি থেকে প্রবাসী আয় অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। নিষেধাজ্ঞার শঙ্কা কেটে যাওয়ায় এখন আবার আয় আসা কমে গেছে।
খাতসংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রবাসী আয়ে ব্যাংকগুলোতে এখন ডলারের আনুষ্ঠানিক দাম ১১০ টাকা। এর বাইরে প্রতি ডলারে সরকার আড়াই শতাংশ প্রণোদনা দেয়। সরকারের প্রণোদনার পাশাপাশি বিভিন্ন ব্যাংকও সমপরিমাণ প্রণোদনা দিচ্ছে। ফলে প্রবাসীরা বৈধ পথে অর্থ পাঠালে তাতে প্রতি ডলারের জন্য ১১৫ টাকার বেশি পাচ্ছেন। তবে ডলার-সংকটের কারণে কোনো কোনো ব্যাংক ১২০ টাকার বেশি দামেও প্রবাসী আয় কিনছে। এসব কারণে ইউএই থেকে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইউএইতে অনেক বাংলাদেশি পাচার করা অর্থে বিপুল সম্পদ গড়েছেন। কোনো কোনো ব্যাংকের মাধ্যমে প্রবাসী আয়ের নামে পাচারের কিছু অর্থ ফেরত আসছে প্রণোদনার সুবিধা নিতে।’
সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুরে বিআইবিএমের এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনও এমন কথা বলেছেন। ফরাসউদ্দিন ওই অনুষ্ঠানে বলেন, সরকার প্রবাসী আয়ে যে প্রণোদনা দিচ্ছে, তার বড় অংশ রাঘববোয়াল ও মধ্যস্বত্বভোগীদের পেটে যাচ্ছে। তারা প্রণোদনার কিছু অংশ প্রবাসী আয় যারা পাঠাচ্ছে তাদের দিচ্ছে, বাকিটা নিজেরা নিয়ে চোরাই পথে অর্থ আনছে।
Prothom alo