শহীদুল্লাহ ফরায়জী :
দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর সংসদ সদস্যদের শপথ, একাদশ সংসদের মেয়াদ ও সরকার গঠন প্রশ্নে সাংবিধানিক জটিলতা নিয়ে আমি মানবজমিন-এ নিবন্ধ প্রকাশ করেছিলাম। এরপর অনেক আলোচনা ও বিতর্ক উত্থাপিত হয়েছে। ‘শপথ’ এবং ‘কার্যভারগ্রহণ’ শব্দ দু’টির ব্যাপারে আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেলের ব্যাখ্যা সংবিধান পরিপন্থি এবং বিভ্রান্তিকর।
প্রজাতন্ত্রের সংবিধানের ১৪৮ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে- ‘এই সংবিধানের অধীন, যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির পক্ষে কার্যভার গ্রহণের পূর্বে শপথগ্রহণ আবশ্যক সেই ক্ষেত্রে শপথগ্রহণের অব্যবহিত পর তিনি কার্যভার গ্রহণ করিয়াছেন বলিয়া গণ্য হইবে’। অর্থাৎ যে ব্যক্তির কার্যভার গ্রহণের পূর্বে শপথগ্রহণ আবশ্যক, তিনি শপথ গ্রহণ করলেই কার্যভার গ্রহণ করেছেন বলে গণ্য হবে। কার্যভার গ্রহণের জন্যই শপথ। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে কার্যভার গ্রহণ ছাড়া অনর্থক কোনো শপথ হতে পারে না। শপথগ্রহণের সঙ্গে কার্যভারগ্রহণ একীভূত। শপথ এবং কার্যভারগ্রহণ বিচ্ছিন্ন বা ভিন্ন হতে পারবে না। কার্যভার গ্রহণবিহীন শপথের, অর্থহীন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা রাষ্ট্রের কর্তব্য হতে পারে না।
সংবিধানের তৃতীয় তফসিলে ১৪৮ অনুচ্ছেদে শপথ ও ঘোষণায় রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রী, স্পিকার, ডেপুটি স্পিকার, সংসদ সদস্য, প্রধান বিচারপতি বা বিচারক, প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার, মহা হিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক এবং সরকারি কর্মকমিশনের সদস্যদের জন্য শপথ আবশ্যক।
সংবিধানের ১৪৮ (১) বলা হয়েছে- ‘তৃতীয় তফসিলে উল্লিখিত যে কোনো পদে নির্বাচিত বা নিযুক্ত ব্যক্তি কার্যভারগ্রহণের পূর্বে উক্ত তফসিল অনুযায়ী শপথগ্রহণ বা ঘোষণা করিবেন এবং অনুরূপ শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দান করিবেন’। অর্থাৎ শপথপত্রে বা ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দান করার সঙ্গে সঙ্গে কার্যভারগ্রহণ সম্পন্ন হয়ে যাবে।
শপথের প্রশ্নটি উচ্চতম নৈতিকতার সঙ্গে জড়িত, ফলে শপথেই কর্তব্যভার গ্রহণ নিশ্চিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির জন্য বঙ্গভবনে যাওয়া, প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাওয়া, প্রধান বিচারপতির জন্য আদালতে যাওয়া, সংসদ সদস্যদের জন্য অধিবেশনে যাওয়া নির্দেশনা দিতে হয়নি। কারণ শপথ গ্রহণকারী ব্যক্তিগণ নিজ কর্তব্যের প্রতি নিষ্ঠাবান এবং নৈতিকভাবে দায়বদ্ধ, তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অঙ্গীভূত। শপথগ্রহণকারী ব্যক্তিদের অধিকারক্ষেত্র অন্য কোনো কর্মচারীর কাজে যোগদানের মতো হবে না। শপথগ্রহণকারী ব্যক্তিগণকে সংবিধান- রাষ্ট্রের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্য সম্পাদনের দায়িত্ব অর্পণ করেছে।
সংসদ সদস্যদের শপথে বলা হয়েছে- ‘আমি যে কর্তব্যভার গ্রহণ করতে পাইতেছি, তাহা আইন অনুযায়ী ও বিশ্বস্ততার সহিত পালন করিব’। সুতরাং সংসদ সদস্যগণ শপথগ্রহণ করবেন ১০ জানুয়ারি আর কার্যভার গ্রহণ করবেন ৩০শে জানুয়ারি এর কোনো সাংবিধানিক অনুমোদন নেই। একদিন শপথ আর বহুদিন পর কার্যভার গ্রহণ; তাহলে শপথের নৈতিক তাৎপর্য ও গুরুত্ব ধূলিস্যাৎ হয়ে যায়। কিন্তু আমাদের রাষ্ট্রপক্ষ বিবেচনাই করেননি শপথগ্রহণ করে ব্যক্তি, কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য সবাই ব্যক্তি হিসেবে শপথ নেন।
কারণ বঙ্গভবন, গণভবন এবং সংসদ অধিবেশন শপথের আওতাভুক্ত নয়। সংবিধান বলছে- যে ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তির পক্ষে কার্যভার গ্রহণের আগে শপথগ্রহণ আবশ্যক সেখানে সংসদ অধিবেশনের সঙ্গে কী সম্পর্ক? অধিবেশন না থাকলে কি সংসদ সদস্যগণ ‘কার্যভার’বিহীন হয়ে পড়বেন? নিশ্চয়ই না। তাহলে অধিবেশনের সঙ্গে সংসদ সদস্যদের কার্যভার জড়িত নয়।
প্রজাতন্ত্রের আইন বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য সংবিধানকে চরম সংকটপূর্ণ করে তুলেছে। যেমন, সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ না করলে, কীভাবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে ‘সরকার’ গঠিত হবে?
তাছাড়া এক সংসদের মেয়াদ অব্যাহত থাকা অবস্থায়, পরবর্তী সংসদের সরকার গঠিত হতে পারে না। সংসদের মেয়াদ শেষ হলেই প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারের মেয়াদ শেষ হবে। মেয়াদ থাকা অবস্থায় এবং পদত্যাগ না করলে প্রধানমন্ত্রীপদ শূন্য হয় না, পদ শূন্য না হলে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়া যায় না।
রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি রাষ্ট্রপতি, নির্বাচিত হয়েও তিনি শপথ নিতে অপেক্ষমাণ থাকবেন অথবা বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হয়েও শপথের জন্য অপেক্ষমাণ থাকবেন আর সংসদ সদস্যগণ নির্বাচিত হয়ে আরেক সংসদের মেয়াদ থাকা অবস্থায় শপথ নিবেন- এটা কোনো বিবেচনায়ই যুক্তিগ্রাহ্য হতে পারে না। শপথ প্রশ্নে একই দেশে দু’টি আইন চলমান থাকতে পারে না।
আমাদের সংবিধান প্রত্যক্ষ ভোটে ৩০০ জন সংসদ সদস্য নির্বাচিত করার এখতিয়ার দিয়েছে।
সুতরাং যে আসনে একাদশ সংসদের সংসদ সদস্য বিদ্যমান, সেখানে দ্বাদশ সংসদের কেউ শপথ নিতে পারবে না। এই জন্য ১২৩(৩) (ক) সংসদ সদস্যদের কার্যভার গ্রহণ না করার শর্ত দিয়েছে, সংসদ অধিবেশন না ডাকার শর্ত দেয়নি।
সংসদ সদস্যদের যে কোনো সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হইবার ৩০ দিনের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠানের জন্য সংসদ আহ্বান করা হইবে, যাহা সংবিধানের ৭২(২) নিশ্চিত করেছে। অন্যদিকে ১৪৮(২ক)-তে নির্বাচনের ফলাফল সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপিত হইবার তিনদিনের মধ্যে শপথের কথা বলা হয়েছে। সংসদ বিদ্যমান রেখে আরেক সংসদের নির্বাচনই মূল সংকট। অথচ এই সাংবিধানিক জটিলতা নিরসনে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই। বরং এখনও দু’টো সংসদ কার্যকর।
আমাদের সংবিধানে ১২৩ (৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্যদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে- ‘(ক) মেয়াদ অবসানের কারণে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবার ক্ষেত্রে ভাঙ্গিয়া যাইবার পূর্ববর্তী ৯০ দিনের মধ্যে; তবে শর্ত থাকে যে, এই দফার (ক) উপ-দফা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে নির্বাচিত ব্যক্তিগণ, উক্ত উপ-দফায় উল্লিখিত মেয়াদ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ সদস্যরূপে কার্যভার গ্রহণ করিবেন না।”
অর্থাৎ বিদ্যমান সংসদের মেয়াদ সমাপ্তির পূর্বে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের কার্যভার গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এটি সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট এবং নির্দেশনামূলক। এটাই সংসদের মেয়াদ রক্ষার রক্ষাকবচ, যাতে নির্বাহী বিভাগ ক্ষমতার অপব্যবহার করে সংসদের মেয়াদ খর্ব করতে না পারে।
এটা নতুন করে ব্যাখ্যা করারও কোনো প্রয়োজন নেই। বরং ধারাবাহিক সংবিধান লঙ্ঘনের জটিলতা নিরসন করার জন্য সংবিধান সংশোধন করা প্রয়োজন।
লেখক: গীতিকবি ও সংবিধান বিশ্লেষক