বাজারে নির্ধারিত দামে ডলার মিলছে না। নতুন বছরও সংকট দিয়ে শুরু হয়েছে। ডলারের বিনিময় হার তথা দাম নিয়ে পুরো
ব্যাংক খাত এখন অস্থির। কোথাও পাওয়া গেলেও চড়া দাম দিয়ে সীমিত পরিমাণে ডলার কিনতে হচ্ছে। আমদানি-রপ্তানিতে ব্যাঘাত ঘটায় উদ্বিগ্ন দেশের ব্যবসায়ীরা। একই সঙ্গে সংকট মেটাতে বাজারে প্রতিদিনিই ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ফলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে। এদিকে বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। নতুন বছরে এই চাপ আরও বাড়বে। অন্যদিকে বিদেশি সহায়তাও কমেছে।
এদিকে ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণে নানা ধরনের চেষ্টা করার পরও বাস্তব অর্থে তার কোনো ফল পাওয়া যায়নি। গত বছর জুড়েই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মজুত ধরে রাখা নিয়ে চাপে ছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আইএমএফ’র ঋণের শর্ত ছিল, ২০২৩ সালের সেপ্টেম্বর শেষে অন্তত ২৫.৩২ বিলিয়ন ডলারের নিট রিজার্ভ থাকতে হবে। সেটাও সম্ভব হয়নি। কারণ, সারা বছরই প্রতি মাসে গড়ে অন্তত ১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করতে হয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে। তাতে নিট রিজার্ভ এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি আছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বাংলাদেশে চলমান টানা ডলার সংকটের অন্যতম কারণ অর্থ পাচার। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো-ইপিবি’র হিসাব মতে, রপ্তানির একটা বিরাট অংশ দেশে আসে না। একইভাবে প্রচুর ডলার পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশ থেকে বেআইনিভাবে টাকা পাচার করে নামে-বেনামে দেশের বাইরে সম্পদ গড়ে তুলছেন একশ্রেণির ব্যবসায়ী।
বিদেশি ঋণে অস্বস্তি বাড়ছে: দুই বছর ধরেই বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। নতুন বছরেও এই চাপ অব্যাহত থাকবে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে বিদেশি ঋণ পরিশোধ ৫১ শতাংশ বেড়েছে। অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে বিদেশি ঋণের সুদাসল পরিশোধ করতে হয়েছে ১৩৩ কোটি ডলার, যা এর আগের ২০২২-২৩ অর্থবছরের একই সময়ে ছিল ৮৮ কোটি ডলার। ইআরডি’র হিসাবে, চলতি অর্থবছরে প্রথমবারের মতো বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ ৩০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে যাবে। গত বছর বিদেশি ঋণ পরিশোধ করা হয়েছে ২৬৭ কোটি ডলার, যা আগের বছরের চেয়ে ৩২ শতাংশ বেশি। মূলত চীন ও রাশিয়ার ঋণের কারণেই বিদেশি ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বাড়ছে। অন্যদিকে গত জুলাই-নভেম্বরে সব মিলিয়ে ২১১ কোটি ডলারের বিদেশি সাহায্য এসেছে, যা আগের বছরের চেয়ে ৩৩ কোটি ডলার কম।
সম্প্রতি এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসের আমদানি বিল বাবদ ১২৭ কোটি ডলার পরিশোধ করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী- গত ১০ই জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রোস রিজার্ভ কমে দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৪৩ কোটি (২৫.৪৩ বিলিয়ন) ডলার। আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী বিপিএম-৬ ম্যাথোডের ভিত্তিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবের সঙ্গে ৫২৫ কোটি (৫.২৫ বিলিয়ন) ডলারের পার্থক্য রয়েছে। অর্থাৎ বিপিএম-৬ ম্যানুয়াল অনুযায়ী গ্রস রিজার্ভ ২ হাজার ১৮ কোটি ডলার বা ২০.১৮ বিলিয়ন। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের শুরুতে গ্রোস রিজার্ভ ছিল ২৯.৭৩ বিলিয়ন ডলার আর বিপিএম-৬ অনুযায়ী ছিল ২৩.৩৭ বিলিয়ন ডলার।
তবে বাইরে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিট বা প্রকৃত রিজার্ভের আরেকটি হিসাব রয়েছে, যা শুধু আইএমএফকে দেয়া হয়। প্রকাশ করা হয় না। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সেই হিসাবে দেশের প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়ন ডলারের মতো। প্রতি মাসে প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার হিসেবে এ রিজার্ভ দিয়ে তিন মাসের আমদানি ব্যয় মেটাতে কষ্টসাধ্য হবে বাংলাদেশের জন্য। সাধারণত একটি দেশের ন্যূনতম ৩ মাসের আমদানি খরচের সমান রিজার্ভ থাকতে হয়।
বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস হলো বৈধ পথে আসা প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। কিন্তু ডলারের দামের পার্থক্যের কারণে বৈধ পথে ডলার আনার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো তেমন গতি আনতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা গেছে, বিদায়ী ২০২৩ সালে দেশে প্রবাসী আয় এসেছে ২ হাজার ১৯০ কোটি ডলার, যা ২০২২ সালে ছিল ২ হাজার ১৩০ কোটি ডলার। প্রবাসী আয়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩ শতাংশ।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, সংকটের কারণে রিজার্ভ থেকে বাজারে প্রচুর ডলার বিক্রি করা হচ্ছে। এ ছাড়া এ মাসে আকুর বিলও পরিশোধ হয়েছে। রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ কম এসব কারণেই মূলত রিজার্ভ কমছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, সরকারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ও জ¦ালানি আমদানির ব্যয় মেটাতে ব্যাংকগুলোর কাছে বিপুল পরিমাণ ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। তবে আমাদের রিজার্ভ ও রপ্তানি আয়ে এখনো কিছুটা প্রবৃদ্ধি রয়েছে।
রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি: বাজারে ডলার সংকট কাটাতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় বা রিজার্ভ থেকে ধারাবাহিক ডলার বিক্রি করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৬ মাস (জুলাই-ডিসেম্বর) সময়ে ৬৭০ কোটি (৬.৭ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সময়ে বাণিজ্যিক কিছু ব্যাংক থেকে এক বিলিয়ন ডলারের মতো কেনে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর আগে গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিভিন্ন ব্যাংকের কাছে ১৩.৫৮ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছিল। আর আগের অর্থবছরে (২০২১-২২) ডলার বিক্রি করেছিল ৭.৬২ বিলিয়ন ডলার।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ৫ মাসে দেশে মোট এলসি খোলা হয়েছে ২৭.৫৩ বিলিয়ন ডলারের। আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে যা প্রায় ১৪ শতাংশ কমেছে। তাছাড়া, এ সময়ে ভোক্তাপণ্য, মূলধনী যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে যথাক্রমে ২৭.৪৭, ১৬.৯৮ এবং ১৬.৭৫ শতাংশ।
এদিকে আন্তঃব্যাংক মার্কেটে ডলার সংকট কমাতে ও ডলার প্রবাহ বাড়াতে রপ্তানিকারকদের ডলার ধরে রাখার সীমা ৫০% কমিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতদিন পণ্য রপ্তানিকারকরা তাদের প্রত্যাবর্তিত রপ্তানি আয়ের ৬০% পর্যন্ত ধরে রাখতে পারতো। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এখন থেকে তারা ৩০% অর্থ ধরে রাখতে পারবেন।
ডলার সংকট ও ঋণপত্র খোলা নিয়ে জটিলতায় আছেন ব্যবসায়ীরা। এলসি জটিলতা এখানো পুরোপুরি কাটেনি। অবশ্য বাজারে এসব সংকট কাটাতে এরই মধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বাজারে সরবরাহ বাড়াতে আসন্ন রমজান মাসে ৮ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ভোজ্য তেল, ছোলা, ডাল, মটর, পিয়াজ, মসলা, চিনি ও খেজুর বাকিতে আমদানির সুযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ভোক্তাদের প্রত্যাশা এবারের রমজানে বাজারে স্বস্তির দেখা মিলবে।
মানব জমিন