দুই সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে ইসরায়েলের হামলায় প্রায় সাড়ে তিন হাজার গাজাবাসী নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছে প্রায় ১২ হাজার মানুষ। অন্যদিকে এই সময়ে গাজার ১০ লাখের বেশি অধিবাসী বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
প্রভাবশালী সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, হামাস-ইসরায়েল যুদ্ধ শুধু সামরিক কর্মকাণ্ডের মধ্যেই আর সীমাবদ্ধ নেই। ইতিমধ্যে গাজায় অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের প্রায় প্রতিটি উৎসকে বন্ধ বা সীমিত করে দিয়েছে ইসরায়েল। পাশাপাশি খাদ্য, পানি সরবরাহ ও চিকিৎসা সুবিধাও বন্ধ করেছে দেশটি।
৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজায় অবিরাম বোমা ফেলে চলেছে ইসরায়েল। তিন দিকে ইসরায়েল দিয়ে ঘেরা গাজার আশপাশের এলাকাগুলো ইতিমধ্যে বোমা মেরে ধূলিসাৎ করা হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘ গত সপ্তাহে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, গাজার ২৩ লাখ মানুষ এখন ‘একটি অতল গহ্বরের দ্বারপ্রান্তে’।
প্রায় দুই দশক ধরে গাজার অর্থনীতি মূলত আন্তর্জাতিক দাতাদের সহায়তার ওপরেই নির্ভরশীল। কিন্তু সম্প্রতি ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েলে অতর্কিত হামলা করলে সব ধরনের বিদেশি সহায়তার পথ বন্ধ করে দেয় দেশটি। শুধু ইসরায়েলি ভূখণ্ডই নয়, পার্শ্ববর্তী মিসর বা ভূমধ্যসাগর হয়েও কাউকে সেখানে সহায়তা পৌঁছাতে দেবে না বলে জানিয়েছে ইসরায়েল।
তবে যুদ্ধবিধ্বস্ত ও বাস্তুচ্যুত গাজাবাসীর জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও জাতিসংঘ মিসরে যাওয়ার একটি পথ খোলার চেষ্টা করছে। পাশাপাশি সেখানে ত্রাণ পৌঁছানোর জন্যও পুরো বিশ্ব থেকে চাপ রয়েছে। এ নিয়ে নানা চাপ ও সমালোচনার মধ্যে সর্বশেষ ১৮ অক্টোবর ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু জানান, মিসরের সীমান্ত পেরিয়ে গাজা ভূখণ্ডে মাত্র সীমিত পরিমাণ খাদ্য ও ওষুধ সরবরাহের অনুমতি দেবে তার সরকার।
এরপর গত শনিবার (২১ অক্টোবর) মিসর থেকে ত্রাণসহায়তা নিয়ে ২০টি ট্রাকের একটি বহর গাজায় প্রবেশ করে। কিন্তু গাজাকে অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করার ইসরায়েলি পরিকল্পনায় ইসরায়েল এখনো স্থির রয়েছে। ইসরায়েল চায়, যেকোনো উপায়ে হামাসের শ্বাসরোধ করতে। এর জন্য অর্থনৈতিক ও সামরিক উভয় অস্ত্র ব্যবহার করছে দেশটি।
কেন ত্রাণের ওপর নির্ভরশীল
১৯৯৪ সালে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় করা একটি চুক্তি অনুসারে ইসরায়েল, গাজা ও পশ্চিম তীর নিয়ে একটি একক বাজার অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ব্যবহার করার কথা। চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলে কাজ করতে পারবে এবং সেখান থেকে আয়ের অর্থ গাজা ও পশ্চিম তীরে ফেরত নিতে পারবে।
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ফিলিস্তিনিদের কর্মসংস্থান ও বিভিন্ন পরিষেবা ব্যবহারের বিষয়ে ইসরায়েল বরাবরই নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা দিয়ে রেখেছে। পশ্চিম তীরে বসবাসকারী মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ফিলিস্তিনির বর্তমানে পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ব্যবহারের সুবিধা আছে। আর সেখানে ১০ শতাংশ লোক সরকারি পানি সরবরাহের সুবিধা ছাড়াই জীবন অতিবাহিত করছেন।
এ ছাড়া পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিরা ইসরায়েলে কেবল স্বল্প-দক্ষতাসম্পন্ন বা কম বেতনের চাকরিতে কাজ করার অনুমতি পান। সে ক্ষেত্রেও তাঁদের চলাচলের ওপর থাকে কঠোর বিধিনিষেধ। একজন ইসরায়েলি নাগরিকের গড় আয় ফিলিস্তিনিদের তুলনায় ১৫ গুণ বেশি। আর গাজাবাসীর ক্ষেত্রে তো কাজের সুযোগ নেই বললেই চলে। এসব কারণে ফিলিস্তিনি অর্থনীতি এখনো ত্রাণ বা অনুদানের ওপরেই নির্ভরশীল রয়েছে।
গাজায় পরিস্থিতি বেশি খারাপ
২০০৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত পশ্চিম তীরে মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল গড়ে ২ দশমিক ৮ শতাংশ। একই সময়ে গাজায় গড় জিডিপি বছরে আড়াই শতাংশ হারে সংকুচিত হয়েছে। ২০০৭ সালে গাজার ক্ষমতা গ্রহণ করে হামাস। এর পর থেকে এই অঞ্চলটি প্রায় সম্পূর্ণভাবে ইসরায়েলি অবরোধের মধ্যে দিন পার করছে।
সাম্প্রতিক হামলার আগপর্যন্ত ইসরায়েল থেকে গাজায় বিদ্যুৎ সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু চাহিদার তুলনায় মাত্র এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ পেত গাজাবাসী। ২০০৮, ২০১৪ ও ২০২১ সালের হামাস-ইসরায়েলের মধ্যে সংঘটিত তিনটি যুদ্ধের প্রতিটিতে গাজাকে কমপক্ষে এক বছরের জিডিপির সমান অর্থ খরচ করতে হয়েছে।
একটি অর্থনীতির জন্য যদি নতুন কিছু তৈরি না হয়, তাহলে শুধু প্রবৃদ্ধিই ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, এর সঙ্গে বেকারত্ব বেড়ে যায়। গাজার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে। ২০২১ সালের হিসাবে গাজার প্রাপ্তবয়স্ক জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বর্ণিত দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করেছে।
যেসব অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চলে
গাজাবাসীর অর্থ আয় করার তথা অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড চালানোর কয়েকটি পথ রয়েছে। এর মধ্যে একটি হলো—গাজার দক্ষিণ সীমান্তে (মিসরের সীমানায়) টানেলের মাধ্যমে আমদানি ও রপ্তানি করা। কিন্তু ২০১৪ সালে হামাসের সঙ্গে সংঘর্ষের পর মিসর এসব টানেলের বেশির ভাগই বন্ধ করে দেয়।
গাজায় অর্থনীতির আরেকটি উৎস হলো আবাসন নির্মাণ। সাধারণত যুদ্ধে যেসব ভবন ধ্বংস হয়, তা পুনর্নির্মাণের কাজটিই গাজার প্রধান বাণিজ্যিক কাজগুলোর মধ্যে একটি। গত বছর এই ধরনের নির্মাণকাজ ২০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। ধারণা করা হচ্ছে চলমান যুদ্ধের পরে তা আরও বৃদ্ধি পাবে।
এ ছাড়া আয়ের আরও কিছু উৎস রয়েছে। যেমন প্রায় ৭০ হাজার গাজাবাসী ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের (পিএ) থেকে নিয়মিত বেতন পান। যদিও ২০০৭ সালে পশ্চিম তীর থেকে আসা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের কর্মকর্তাদের গাজা থেকে বের করে দেয় হামাস।
মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতার কয়েক হাজার গাজাবাসীর ব্যাংক হিসাবে প্রতি মাসে সব মিলিয়ে প্রায় ১ কোটি ডলার নগদ অর্থ জমা করে। গাজার বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ, যা পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের দেওয়া কর থেকে সংগ্রহ করে ইসরায়েল। গাজার তিন লাখ শিশুকে পড়ালেখার ব্যবস্থা করেছে জাতিসংঘ। এ ছাড়া বিভিন্ন দাতব্য সংস্থা বেশ কিছু হাসপাতালের মাধ্যমে ভূখণ্ডটিতে মৌলিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করে।
কী ধরনের অর্থসম্পদ রয়েছে
হামাস গাজার ক্ষমতা গ্রহণের পর গত ১৬ বছরে সরকারের কর্মচারীর সংখ্যা ২০ হাজার থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার করেছে। এই কর্মচারীদের বেতন গত বছর জিডিপির দশমিক ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখে।
যদিও ইসরায়েল থেকে গাজায় কোনো ধরনের পণ্য আমদানির অনুমতি নেই। তবে তারা মিসর ও পশ্চিম তীর থেকে পণ্য আমদানি করতে পারে। সম্প্রতি মিসরের সঙ্গে তাদের বাণিজ্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
গাজার প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা হামাস মিসরীয় সীমান্ত অতিক্রম করে আসা সব পণ্য থেকে প্রায় সাড়ে ১৬ শতাংশ পর্যন্ত কর আদায় করে। এ ছাড়া গাজার জেলেদের ধরা মাছের প্রতি কিলোগ্রামে তিন শেকেল (ইসরায়েলি মুদ্রা) কর নেয়। পাশাপাশি আয়করও ধার্য রয়েছে সেখানে। তাতে সামগ্রিকভাবে হামাস বছরে দেড় শ কোটি শেকেল আয় করে বলে অনুমান করা হয়।
দ্য ইকোনমিস্ট তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, যেহেতু দাতব্য সংস্থাগুলো গাজার বেশির ভাগ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল পরিচালনা করছে এবং ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষ গাজার বিদ্যুৎ খরচ মেটাচ্ছে, তাই হামাস হয়তো কিছু অর্থ অন্যত্র বিনিয়োগ করার সুযোগ পায়।
এদিকে হামাস ও গাজার অর্থ আয়ের বিভিন্ন উৎসের ওপর নজর রাখছে ইসরায়েল ও তার মিত্ররা। যুক্তরাষ্ট্রের ধারণা, গাজার বিভিন্ন ইসলামপন্থী গোষ্ঠী ইরান থেকে বছরে ১০ কোটি ডলার পায়। এ ছাড়া হামাস উপসাগরীয় ও পশ্চিমা কিছু দেশ থেকে ব্যক্তিগত অনুদানও পায়। ইসরায়েল ও তার মিত্ররা ইতিমধ্যেই তুরস্কের ইস্তাম্বুল ও যুক্তরাজ্যের লন্ডনে এ ধরনের অর্থ লেনদেন করা ব্যাংক হিসাব জব্দ শুরু করেছে।
তবে গাজাকে অর্থনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করা নিয়ে ইসরায়েলি নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। অনেকে মনে করছেন হামাসকে শেষ করতে চাইলে গাজার অর্থ ও ত্রাণসহায়তার উৎস বন্ধ রাখতে হবে। আর এর বিরোধিতাকারীরা বলছেন, হামাসকে এভাবে শেষ করা সম্ভব হবে না; বরং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানোর জন্য ইসরায়েলের উচিত গাজাকে আরও বেশি সহায়তা করা।