বাংলাদেশে আরও ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি করতে আগ্রহী ভারতের আদানি গ্রুপ। তারা দীর্ঘমেয়াদে এ বিদ্যুৎ দিতে চায় নবায়নযোগ্য উৎস থেকে। এ প্রস্তাবে সরকারের ইতিবাচক মনোভাব রয়েছে। রাজি হলে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই আদানি গ্রুপ চুক্তি করতে চায় বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
এখন বাংলাদেশের বিদ্যুতের চাহিদার তুলনায় উৎপাদনের সক্ষমতা বেশি। এ ছাড়া নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে বাংলাদেশ কাজ করছে। এ অবস্থায় আদানি থেকে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তিতে বিদ্যুৎ আমদানি লাভজনক হবে না বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ বিভাগের কেউ কেউ।
অন্যদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডলার সংকটের কথা বলে বিদ্যুৎ আমদানি করার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমদানির অর্থও তো দিতে হবে ডলারে।
এ ছাড়া গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে প্রায় ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের বহুজাতিক কোম্পানি এক্সন মবিল। বাংলাদেশ রাজি থাকলে চলতি বছরেই চুক্তি সই করতে চায় বৃহৎ এ প্রতিষ্ঠানটি।
এমন সময়ে প্রস্তাব দুটি নিয়ে তৎপরতা শুরু হয়েছে যখন দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব কাজে লাগাতে, তাদের সমর্থন পেতে রাজনৈতিক মহলে অদৃশ্য প্রতিযোগিতা রয়েছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও আলোচনা রয়েছে।
সম্প্রতি আদানি গ্রুপের প্রধান গৌতম আদানি হঠাৎ সংক্ষিপ্ত সফরে ঢাকায় এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে গেছেন।
ভারতের ঝাড়খ-ে বাংলাদেশের জন্য নির্মিত গোড্ডা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বর্তমানে প্রায় দেড় হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানি করছে আদানি। চুক্তি অনুযায়ী আগামী ২৫ বছর এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনবে বাংলাদেশ। এর বাইরে নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আরও ১৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ রপ্তানির প্রস্তাব দিয়েছে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি। সৌরবিদ্যুৎ থেকে ১ হাজার মেগাওয়াট ও জলবিদ্যুৎ থেকে ৬০০ মেগাওয়াট সরবরাহ করার কথা বলা হয়েছে। এজন্য তারা দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে।
জানতে চাইলে বিদ্যুৎ বিভাগের জ্যেষ্ঠ সচিব মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম।’ একপর্যায়ে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগের পরামর্শ দেন তিনি। কথামতো একাধিকবার চেষ্টা করেও পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমানের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি।
পিডিবির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা আদানির প্রস্তাব সম্পর্কে শুনেছেন উল্লেখ করে বলেন, ‘এটি গোপনীয়। সবিস্তারে জানি না।’ পিডিবির আর কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রস্তাব দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে আদানি গ্রুপের এক কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে। বাংলাদেশ প্রস্তাবে রাজি হলে চুক্তিসম্পাদন, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ এবং অন্যান্য প্রক্রিয়া সেরে বিদ্যুৎ পেতে অন্তত চার-পাঁচ বছর লাগবে।’
বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষ পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা আছে বাংলাদেশের। কিন্তু জ্বালানি ও ডলার সংকটের কারণে অনেক সময় চাহিদামতো বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় আদানি বা অন্য বিদেশি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ ক্রয়চুক্তি করা ঠিক হবে না। জরুরি মুহূর্তে লাগলে তখনই শুধু বাংলাদেশ বিদ্যুৎ কিনবে এমন চুক্তি হওয়া দরকার। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হলে বিদ্যুৎ না নিয়েও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে, যা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে না।’
জানা গেছে, ২০৪১ সাল নাগাদ দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতার ৪০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে উৎপাদনের পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এখন নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাত থেকে প্রায় ৩ শতাংশের মতো বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে। নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে সরকারের পরিকল্পনা অনুযায়ী আদানির বিদ্যুৎ সহায়ক হবে এমন বিবেচনা সরকারে রয়েছে।
সম্প্রতি বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বলেছেন, ‘সরকার নবায়নযোগ্য জ্বালানির ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। এ খাতে ৯ হাজার ৯৩০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের উৎপাদন প্রক্রিয়াধীন। প্রতিবেশী দেশগুলো থেকেও নবায়নযোগ্য উৎসের বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বিদ্যুতের দামের বিষয়টি এখানে মুখ্য। আদানির কয়লা-বিদ্যুতের মতো দাম হলে তো হবে না। তাদের বিদ্যুৎ কিনতে আমাদের ডলারে মূল্য পরিশোধ করতে হবে। অথচ তার চেয়ে কম দামে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। সুতরাং সরকারের এ নীতিকে আমরা ভালো চোখে দেখছি না।’
পুরো বিষয়টি না জেনে মন্তব্য করা যাবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আদানির কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনলে তাদের লাভ হবে। এতে আমাদের কী লাভ সেটা পরিষ্কার হওয়া দরকার। নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে সরকারকে সঠিক পলিসি ও প্ল্যানিং করে আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। না হলে ঘোষিত লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করা সম্ভব হবে না।’
এ বিষয়ে পাওয়ার সেলের সাবেক মহাপরিচালক বিডি রহমতুল্লাহ দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘সরকারের তথ্যমতে দেশে বিদ্যুতের চাহিদার চেয়েও বেশি উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ আমদানি অযৌক্তিক। বিদ্যুৎ আমদানি করে কেন নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে? দেশেই তো নবায়নযোগ্য খাতের বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। এটাকে কাজে লাগানো দরকার।’ তিনি বলেন, ‘বিদ্যুৎ আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে সেটা হবে ভারতের সঙ্গে রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও পাকা করার একটা কৌশল।’
এদিকে গত ১৬ জুলাই বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের কাছে পাঠানো এক চিঠিতে এক্সন মবিল জানিয়েছে, তারা গভীর সমুদ্রে জ্বালানির মজুদ নির্ধারণের জন্য দ্বিমাত্রিক জরিপ করতে ৪০ থেকে ৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে। জরিপে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে নিশ্চিত হওয়ার জন্য ত্রিমাত্রিক জরিপ করবে। এতে ব্যয় হবে ৫০ থেকে ১০০ মিলিয়ন ডলার।
গ্যাসপ্রাপ্তি নিশ্চিত হওয়ার পর প্রতিটি কূপের উন্নয়নে ৮০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের পাশাপাশি গভীর সাগরে অনুসন্ধানে ১০ থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ দেখিয়েছে মার্কিন প্রতিষ্ঠানটি।
এক্সন মবিল দ্রুত বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি সই করতে আগ্রহী। এ সংক্রান্ত সমঝোতা চুক্তি সই হওয়ার পর এ ব্যাপারে বোঝাপড়া করতে তারা প্রস্তুত। প্রতিষ্ঠানটি আগামী নভেম্বর থেকেই দ্বিমাত্রিক জরিপ করতে চায়। এজন্য এ মাসের মাঝামাঝি আলোচনার জন্য প্রস্তাব দিয়েছে তারা।
বঙ্গোপসাগরের বাংলাদেশের অংশে ২৬টি ব্লক রয়েছে। অগভীর সমুদ্রে ১১টি ও গভীর সমুদ্রে ১৫টি ব্লক। এর আগে প্রতিষ্ঠানটি তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে গভীর সমুদ্রের সব ব্লক বরাদ্দ দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিল। একক কোনো কোম্পানিকে সব ব্লকে কাজ না দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত রয়েছে সরকারের। তাদের প্রস্তাবের পর রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক নিয়ে নানা আলোচনা হয়। সে কথা মনে করেই তারা বিকল্প প্রস্তাব দিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী এর আগে দেশ রূপান্তরকে বলেছিলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে গভীর সমুদ্রে অনুসন্ধান কাজে কিছু আন্তর্জাতিক কোম্পানি আগ্রহী দেখিয়েও পরে চলে যায়। তবুও আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিদেশি কোম্পানিকে আকৃষ্ট করতে পিএসসি সংশোধন করা হচ্ছে। এতে আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতির প্রসঙ্গও রয়েছে।’
তিনি বলেন, ‘এক্সন মবিলের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমরা আশাবাদী। তারা বাংলাদেশে আসতে পারে ওই ভূরাজনৈতিক কারণে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে সরে এসে তারা যদি এখানে কিছু পায় তাহলে তাহলে তাদের “সাপ্লাই চেইনে” নতুন মাত্রা যোগ হবে। আমার ধারণা তারা তাদের জ্বালানি উৎসে বৈচিত্র্য আনতে চায়। মধ্যপ্রাচ্যের উৎসে কখনো জ্বালানি পেতে সমস্যা হলে তাদের নিজস্ব সরবরাহে যেন সমস্যা না হয়। ভৌগোলিক কৌশলগত কারণে এক্সন মবিল বাংলাদেশে আগ্রহী হতে পারে। দেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই তাদের সঙ্গে সমঝোতা হবে।’
এক্সন মবিলের প্রস্তাবের বিষয়ে সরকারের উচ্চপর্যায়ে পর্যালোচনা চলছে। জ্বালানি বিভাগেরও নানা প্রস্তুতি রয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা পেলেই কাজ শুরু হবে। এখন পর্যন্ত এক্সন মবিলের বিষয়েও সরকারের মনোভাব ইতিবাচক বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
ভূতত্ত্ববিদ অধ্যাপক ড. বদরুল ইমাম দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘বাংলাদেশের সাগরে তেল-গ্যাস পাওয়ার বিশাল সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সেখানে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। গত ২০ বছরে কোনো অনুসন্ধান-পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। স্থলভাগেও অনুসন্ধান চলছে ঢিমেতালে। দেশে বড় ধরনের গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে এক্সন মবিল সাগরে অনুসন্ধানের জন্য যে আগ্রহ দেখিয়েছে, তা বাংলাদেশের জন্য খুবই ইতিবাচক।’
তিনি বলেন, ‘এক্সন মবিল বিশে্বর অন্যতম সেরা কোম্পানি। তাদের আগ্রহের কারণে বিশে^র বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এখানে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাবে।’
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইএসএস) গবেষণা পরিচালক ড. মোহাম্মদ মাহফুজ কবীর দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘এক্সন মবিল বিশ্বসেরা প্রতিষ্ঠান। তারা কাজ করলে সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের নতুন দুয়ার খুলবে। আমেরিকার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের আরও উন্নতি হবে। তবে চুক্তির সময় বাংলাদেশের স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে হবে।’