today-is-a-good-day

দেশে মানুষের হাতে রেকর্ড টাকা

The Daily Samakal

ওবায়দুল্লাহ রনি

০৯ আগস্ট ২৩

মানুষের মধ্যে হাতে টাকা রাখার প্রবণতা বেড়েছে। অর্থনীতিবিদদের ধারণা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, টাকা ছাপানো বৃদ্ধি এবং হুন্ডি তৎপরতা এর কারণ হতে পারে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাবে, মানুষের হাতে আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে রেকর্ড পরিমাণ টাকা রয়েছে। গত জুন শেষে প্রথমবারের মতো সার্কুলেশন বা প্রচলনে থাকা টাকার পরিমাণ ৩ লাখ ১০ হাজার কোটি টাকার ওপরে উঠেছে। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বরে প্রচলনে থাকা নোটের পরিমাণ সর্বোচ্চ ২ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন পর্যন্ত মোট ছাপানো নোটের পরিমাণ ৩ লাখ ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এর বিপরীতে সার্কুলেশন তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বাইরে ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। সাধারণত দৈনন্দিন চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাংক শাখার ভল্টে থাকে ১৪ থেকে ১৮ হাজার কোটি টাকা। বাকি ২ লাখ ৯২ থেকে ২ লাখ ৯৬ হাজার কোটি টাকা ছিল মানুষের হাতে। সাধারণত কোরবানির ঈদের সময় মানুষের হাতে নগদ টাকা বেশি থাকে। ২০২২ সালের কোরবানির ঈদকে কেন্দ্র করে প্রচলনে ছিল সর্বোচ্চ ২ লাখ ৭৮ হাজার কোটি টাকা।

ব্যাংকাররা জানান, করোনা-পরবর্তী অর্থনীতিতে বাড়তি চাহিদা তৈরি হয়। এর মধ্যে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ডলারের দর ২৫ শতাংশের বেশি বেড়েছে। এ সময় বিশ্ববাজারে বিভিন্ন পণ্যের দরও বেড়েছে। গত জুন শেষে পয়েন্ট টু পয়েন্ট মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর গড় মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক শূন্য ২ শতাংশ। এর মানে এক বছর আগে যে পণ্য কিনতে ১০০ টাকা খরচ করতে হতো, তার তুলনায় এখন খরচ হচ্ছে প্রায় ১০ টাকা বেশি। অথচ বেশির ভাগ মানুষের আয় বাড়েনি। এতে মানুষের সঞ্চয় ক্ষমতা কমেছে। গত অর্থবছর সঞ্চয়পত্র বিক্রির চেয়ে ৩ হাজার ২৯৬ কোটি টাকা বেশি ভাঙানো হয়েছে। আবার গত জুন পর্যন্ত ব্যাংক খাতে আমানত বেড়েছে মাত্র ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। সাম্প্রতিক কোনো বছর আমানতে এত কম প্রবৃদ্ধি হয়নি।

ব্যাংকাররা জানান, ব্যাংকের ভল্টের টাকায় প্রতিদিনের গ্রাহক চাহিদা মেটানো হয়। আর প্রচলনে থাকা নোট মানুষ নিজের কাছে, ঘরের আলমারি, সিন্দুক কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে রাখেন। দুর্নীতি বাড়লে অনেক সময় প্রচলনে থাকা নোট বাড়ে। আবার হুন্ডির টাকাও যেহেতু প্রবাসীর সুবিধাভোগী নগদে পান, ফলে এ ধরনের টাকাও ব্যাংকের বাইরে থাকে। সব মিলিয়ে মানুষের হাতে নগদ টাকা বেড়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মঈনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, প্রবাসে জনশক্তির সংখ্যা প্রতি বছর বাড়ছে। বৈধ বা হুন্ডি যে উপায়েই হোক, তাদের অর্থ পাঠানোর পরিমাণ বাড়ছে। হুন্ডির কারণে  মানুষের হাতে নগদ টাকার পরিমাণ বাড়ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ব্যাংক খাতে মোট আমানত রয়েছে প্রায় ১৭ লাখ কোটি টাকার মতো। এই আমানতের বেশির ভাগই অ্যাকাউন্টে স্থানান্তরভিত্তিক। ফলে কখনও আমানতের সমপরিমাণ টাকা ছাপানোর দরকার হয় না। এখন অনলাইনের মাধ্যমে লেনদেন বাড়ছে। উন্নত বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে মোট লেনদেনের অন্তত ৭০ শতাংশ ক্যাশলেস বা নগদবিহীন করার ঘোষণা দিয়েছে। কেননা, ক্যাশলেস হলে একদিকে ব্যাংক খাতে পদ্ধতিগত ঝুঁকি তৈরি হয় না, আবার টাকা ছাপানোর খরচ বাঁচে। নগদ লেনদেন কমাতে বাংলা কিউআরসহ বিভিন্ন প্রযুক্তিভিত্তিক ব্যবস্থা চালু হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, বেতন ভাতা, বিল বা অন্য যে কোনো উপায়ে ব্যাংকে জমা অর্থ তুলে মানুষ খরচ করেন। কোনো না কোনো উপায়ে তার একটি অংশ আবার ব্যাংকে চলে আসে। কোনো কারণে ব্যাংকে অর্থ আসার পরিমাণ অনেক কমে যাওয়া ব্যাংক খাতের জন্য ঝুঁকির কারণ। যদিও এখনকার প্রবণতা ঝুঁকির পর্যায়ে যায়নি।

অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্চ  ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক টাকা ছাপানো বাড়ালে মানুষের হাতে টাকা বাড়ে। আবার মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি মানে একই জিনিস কিনতে বেশি টাকা লাগে। এতে নগদ টাকার চাহিদা বাড়ে। আবার মুদ্রা সরবরাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলে। একটা আপেল কিনতে কেউ হয়তো আগে পকেটে ১০০ টাকা রাখত, এখন রাখবে ১১৫ টাকা। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি টাকা না ছাপিয়ে সরবরাহ কমিয়ে দেয়, তখন চাহিদা এমনিতেই কমে মূল্যস্ফীতি কমে যায়।

এদিকে উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ কমাচ্ছে সরকার। গত জুলাইতে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ঋণ কমেছে ১০ হাজার ৬৩৫ কোটি টাকা। একই সময়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিয়েছে ১০ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে ব্যাংক ব্যবস্থায় সরকারের নিট ঋণ কমেছে ৫৭ কোটি টাকা। গত অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে নেওয়া রেকর্ড ১ লাখ ২২ হাজার ৯৮০ কোটি টাকার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সরবরাহ করেছিল ৯৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারকে ঋণ দেওয়া মানে টাকা ছাপিয়ে বাজারে ছাড়ার মতো। এ ধরনের প্রবণতা মূল্যস্ফীতিকে উস্কে দেয়।