- আশরাফুল ইসলাম
- ১৫ মে ২০২৩, ২৩:৩৩, আপডেট: ১৫ মে ২০২৩, ২৩:৩৪
বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ বাড়ছে। তবে, এ বিদেশী ঋণ সংগ্রহে ব্যবসায়ীয়ের সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত ও যুক্তরাজ্যের দিকেই ঝোঁক বেশি। বেসরকারি খাতে মোট বিদেশী ঋণের প্রায় ৬০ শতাংশই এসেছে এ তিনটি দেশসহ ৫ দেশের। গত মার্চ প্রান্তিকে যেখানে বিদেশী ঋণ এসেছিল ১ হাজার ৪০৮ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে শীর্ষ ৫ দেশ থেকেই এসেছে ৮২১ কোটি ডলার। আর এসব ঋণের বেশিরভাগ অংশই স্বল্প মেয়াদি ও বায়ার্স ক্রেডিট। তাই ঋণ পরিশোধের চাপও বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, এসব ঋণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়িয়ে দেয়, তেমনি বায়ার্স ক্রেডিটের আড়ালে অর্থ পাচারের ঝুঁকি থাকে। অর্থ পাচার হচ্ছে কী না সে বিষয়ে তদারকি জোরদার হওয়া প্রয়োজন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এ বিষয়ে গতকাল নয়া দিগন্তকে জানিয়েছেন, স্বল্প মেয়াদি ঋণ রিজার্ভের ওপর নিঃসন্দেহে চাপ সৃষ্টি করে। এছাড়া যারা এসব ঋণ আনছেন রফতানিকারক ছাড়া অন্যরা তো আর বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করছেন না। কিন্তু এসব ঋণের সুদসহ মুনাফা পরিশোধ করতে হয় বৈদেশিক মুদ্রায়। এ কারণে এসব ঋণ পরিশোধ করার সময় বৈদেশিক মুদ্রা কিনেই পরিশোধ করতে হয়। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ পড়ে। অপরদিকে, ঋণের সুদহার প্রথমে তুলনামূলক কম হলেও কার্যকর হার অনেক বেড়ে যায়। কারণ, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়জনিত ঝুঁকি সুদহারের সাথে যুক্ত হয়। যেমন, লাইবর রেট এখন বেশি। আবার ডলারের দাম যখন ৮০ বা ৯০ টাকা ছিল তখন কেউ ঋণ নিলেন। কিন্তু পরিশোধের সময় দেখা গেলো প্রতি ডলারের মূল্য ১১০ টাকা। তখন ১১০ টাকা মূল্যে ডলার কিনেই সুদে আসলে পরিশোধ করতে হবে। এ কারণে রফতানিকারক ছাড়া এসব ঋণে নিরুৎসাহিত করাই ভালো।
বায়ার্স ক্রেডিট হলো ব্যবসায়ী বিদেশী কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য আমদানি করে বিদেশী প্রতিষ্ঠান থেকেই ঋণ নিয়ে সেই অর্থ পরিশোধ করে। বায়ার্স ক্রেডিটের আওতায় বিদেশী প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ঋণ নিতে গেলে গ্যারান্টি দিতে হয়। বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলো আমদানিকারকদের থেকে কর্পোরেট গ্যারান্টি, পারসোনাল গ্যারান্টি ও তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টি নিয়ে থাকে। বায়ার্স ক্রেডিটের গ্যারান্টির জন্য আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হতো। কিন্তু গত বছরের মাঝামাঝি থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তা শিথিল করে দেয়। এর পর থেকে বায়ার্স ক্রেডিট গ্যারান্টির জন্য এখন আর বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন নিতে হয়। গত বছরের ১৩ জুলাই বাংলাদেশ ব্যাংক এ বিষয়ে এক সার্কুলার জারি করেছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, বেসরকারি খাতে বৈদেশিক ঋণের ক্ষেত্রে সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত, যুক্তরাজ্যের দিকেই ব্যবসায়ীদের আগ্রহ বেশি। গত মার্চ শেষে বেসরকারি খাতে স্বল্প মেয়াদি বিদেশী ঋণ এসেছে ১ হাজার ৪০৮ কোটি ৩৬ লাখ ডলার। এর মধ্যে শীর্ষ ৫ দেশ থেকেই এসেছে প্রায় ৬০ শতাংশ। এর মধ্যে সিঙ্গাপুর থেকে এসেছে ৩১২ কোটি ৫২ লাখ ডলার। যা মোট ঋণের ২২ শতাংশের ওপরে। আরব আমিরাত থেকে এসেছে ২৩২ কোটি ৯৪ লাখ ডলার, যা মোট ঋণের ১৬.৫৩ শতাংশ। বেসরকারি উদ্যোক্তাদের কাছে তৃতীয় পছন্দের দেশ হলো যুক্তরাজ্য। এই দেশ থেকে বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণ এসেছে ১০০ কোটি ২৯ লাখ ডলার, যা মোট ঋণের ১৪ শতাংশ। শীর্ষ ৫ দেশের মধ্যে অপর দুটি দেশ হলো হংকং ৯২ কোটি ৫৬ লাখ ডলার, এবং চীন থেকে এসেছে ৮২ কোটি ৩৮ লাখ ডলার।
বেসরকারি খাতে বিদেশী ঋণের খাতভিত্তিক বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, গত মার্চ শেষে বায়ার্স ক্রেডিট এসেছে ৮১৩ কোটি ৪৫ লঅখ ডলার, যা মোট ঋণের প্রায় ৫৮ শতাংশ। এদিকে বকেয়া এলসির পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। ডলার সঙ্কট দেখা দিলে আমদানিকারকরা ঋণ পরিশোধ করতে পারেন না। বাধ্য হয়ে এলসির অর্থ পরিশোধ না করে বকেয়া রাখা হয়। এতে বাড়তি চার্জ বা ফি গুনতে হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, মার্চ শেষে বেসরকারি খাতে ডেফার্ড এলসি বা বকেয়া ঋণের পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৭৮ কোটি ৬৪ লাখ ডলার, যা মোট ঋণের প্রায় ৬ শতাংশ। গত বছরের জুন শেষে যা ছিল ৬৯ কোটি ডলার। অন্যদিকে স্বল্প মেয়াদি মেয়াদি ঋণ এখন সময় শূণ্যের কোঠায় ছিল। এখন তা বেড়ে ৩৭২ কোটি ৪৫ লাখ ডলার হয়েছে। এ ঋণ মোট ঋণের প্রায় সাড়ে ২৬ শতাংশ। আর ফরেন ব্যাক টু ব্যাক ২০১৯ সাল শেষেও শূণ্যের কোঠায় ছিল। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৭৭ কোটি ৩৪ লাখ ডলার।
সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বেসরকারি খাতে যেসব বিদেশী ঋণ আসছে তা সঠিকভাবে ব্যবহার হচ্ছে কীনা তা কঠোরভাবে তদারকি করা প্রয়োজন। একই সাথে এসব ঋণের আড়ালে অর্থ পাচার হচ্ছে কী না তাও কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। দেখা গেলো কাগজে কলমে পণ্য এলো, বাস্তবে বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ সৃষ্টি হয়ে রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে। ইতোমধ্যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে শুরু করেছে। সর্বশেষ হিসেব মতে, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে। যদিও আইএমএফ’র হিসাবে ২২ বিলিয়ন। ঋণের কিস্তি ছাড় পেতে হলে প্রকৃত রিজার্ভ ২৪ বিলিয়নের ওপরে রাখতে হবে। এ কারণে এমনিতেই চাপের মধ্যে আছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এরওপর স্বল্প মেয়াদি বৈদেশিক ঋণ বেড়ে গেলে এ সঙ্কট আরো প্রকট আকার দেখা দিতে পারে। কেননা, সামনে রূপপুরসহ বিভিন্ন প্রকল্পের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে।