মোংলা ও চট্টগ্রাম সমূদ্র বন্দর ব্যবহারের মাধ্যমে পণ্যের ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়ে ভারতের দীর্ঘদিনের জোরালো দাবি পূরণ করেছে বাংলাদেশ। ট্রানজিট সুবিধা দেয়ার ব্যাপারে ২০১০ সালে ভারত বাংলাদেশ শীর্ষ বৈঠকে আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্ত হয়। এর ১৩ বছর পর ভারতকে বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দেয়ার সব প্রক্রিয়া শেষ হলো। তবে এখনও ভারতে ভূমি ব্যবহার করে বাংলাদেশকে ট্রানজিট সুবিধার বিষয়টি চূড়ান্ত হয়নি।
সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় রাজস্ব বোর্ড দুই দেশের মধ্যে চুক্তির আওতায় পণ্য পরিবহনের জন্য কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পাদনের স্থায়ী আদেশ জারী করেছে।
কোন পদ্ধতিতে কীভাবে কোন রূটে ভারতীয় পণ্য পরিবহন হবে এবং এর ফি এবং মাশুল কী হবে সেটিও নির্দিষ্ট করা হয়েছে এই স্থায়ী আদেশে।
বিগত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এনিয়ে দুই দেশ নানা পর্যায়ে বৈঠক, আলোচনা, সমঝোতা ও প্রয়োজনীয় চুক্তি সম্পাদন করেছে। এছাড়া পরীক্ষামূলক চালানও পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে। সবশেষে স্থায়ী আদেশ জারীর মাধ্যমে ভারতকে দুটি বন্দর ব্যবহারের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ।
ভারতের বৈধ যে কোনো পণ্যের চালান সমূদ্রপথে মোংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস হবে। সেসব পণ্য বাংলাদেশের সড়ক পথ ও যান ব্যবহার করে চারটি স্থলবন্দর হয়ে ভারতে যাবে অথবা ভারত থেকে আসবে।
এই চারটি স্থল বন্দরের রুট হলো সিলেটে তামাবিল-ডাউকি ও শেওলা-সুতারকান্দি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া-আগরতলা এবং কুমিল্লার বিবিরবাজার-শ্রীমন্তপুর।
ভারত বাংলাদেশের দুটি বন্দর ব্যবহার করে পণ্যের ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট করলে উভয় দেশই লাভবান হবে বলে মনে করা হয়। এছাড়া এ অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে বলেও মত অনেকের।
ভারতের সুবিধা
প্রায় ১৬শ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে এবং দীর্ঘ সময় ব্যয় করে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে ত্রিপুরা ও মেঘালয়ে পণ্য আসতো।
মোংলা এবং চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোয় পণ্য পরিবহনের সময় এবং খরচ বহুলাংশে কমে যাবে ।
সেটি এখন অল্প সময়ে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বা মোংলা বন্দর ব্যবহার করে ত্রিপুরা, আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে পৌছে যাবে।
ভারতের বিবেকানন্দ ইন্টারন্যাশনাল ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো শ্রীরাধা দত্ত বলেন, এই সুযোগ ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি সুবিধা সৃষ্টি করবে।
“শিলিগুড়ির একুশ কিলোমটার কোরিডোর ছাড়া উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সাতটা রাজ্য মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন থাকে। যে কারণে ব্যবসা বাণিজ্য বলুন ওখানে দ্রব্য যাওয়া বলুন, সবকিছুই অ্যাফেকটেড (ক্ষতিগ্রস্ত) হচ্ছিল।”
“বাংলাদেশের সাথে আমরা যখন ক্রসবর্ডার ফ্যাসিলিটি তৈরি করেছি তাতে সবচেয়ে বেশি উপকার পেয়েছে নর্থ-ইস্টের লোকরা। মোংলা বা চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করতে পারলে এখন নর্থ-ইস্টের কমার্স পুরোটাই চেঞ্জ হয়ে যাবে,” বলেন শ্রীরাধা দত্ত।
বাংলাদেশ কী পাচ্ছে?
ভারত বাংলাদেশের মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করলে বন্দরের কর্মকাণ্ড বাড়বে এবং নানারকম ফি ও মাশুল আদায় হবে। এছাড়া কাস্টমস কর্তৃপক্ষের আদায় করা ফি ও চার্জ এবং সড়ক ব্যবহারের মাশুল থেকেও আয় করবে বাংলাদেশ।
মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দরের চার্জ ছাড়াও বাংলাদেশ কাস্টমস ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট ফি আদায় করবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তালিকা অনুযায়ী প্রতি চালানে ৩০ টাকা প্রসেসিং ফি, টন প্রতি ২০ টাকা ট্রান্সশিপমেন্ট ফি, ১শ টাকা সিকিউরিটি চার্জ ও একশ টাকা প্রশাসনিক চার্জ দিতে হবে।
এছাড়া কনটেইনার বা লরি প্রতি কিলোমিটারে ৮৫টাকা পুলিশ এসকর্ট ফি এবং প্রতিটি কন্টেইনার স্ক্যানিং ফি ধার্য করা হয়েছে ২৫৪ টাকা। পনের শতাংশ ভ্যাটসহ এই ফি দিতে হবে। এর সাথে প্রতি কিলোমিটারে সড়ক ব্যবহার মাশুল দিতে হবে ১ টাকা ৮৫ পয়সা।
বাংলাদেশ ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের জন্য যে চার্জ নির্ধারণ করেছে সেটি আরো বেশি হতে পারতো বলে মনে করেন, বন্দর বিশেষজ্ঞ এবং অর্থনীতিবিদ ড.মইনুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “এই বন্দর ব্যবহার করে ভারতের ১শ ডলার যদি বেঁচে যায়, তাহলে ৫০ ডলার বাংলাদেশকে দেয়া হোক, ৫০ ডলার ভারত রাখুক। কিন্তু ভারত যদি ৮০ ডলারই নিয়ে যায় বাংলাদেশকে মাত্র ২০ ডলারের সুবিধা দেয় সেটা আমি ন্যায্য মনে করি না।”
“কারণ বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার হবে, বাংলাদেশের সড়ক ব্যবহার হবে, রেলপথ ব্যবহার হবে।অতএব এগুলোর যে অবচয় সেটি অনেক বেড়ে যাবে। এ বিষয়গুলো বিবেচনা করলে বাংলাদেশের ন্যায্য হিস্যা আরো বেশি হওয়া উচিৎ বলেই আমি মনে করি।”
এছাড়া দুই দেশের মধ্যে চুক্তির আওতায়। ট্রানজিট ও ট্রানশিপমেন্ট পণ্যের কাস্টমস প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে যে ফি এবং চার্জ নির্ধারণ করা হয়েছে সেটি টাকায় উল্লেখ করা হয়েছে।
এসব চার্জ ডলারে নির্ধারণ করলে ভালো হতো বলে মনে করেন ড. মইনুল ইসলাম।
“টাকার যে প্রায় ২৫শতাংশ অবচয়ন হয়েছে সেটা গত দেড় দুই বছরে হয়েছে। অতএব সেখানে টাকার অঙ্কে যদি মাশুল নির্ধারণ হয় তাহলে আমরা ২৫ শতাংশ কম পাচ্ছি আগের চাইতে। তো ভবিষ্যতেও বাংলাদেশের টাকা আরো বেশি অবচয়নের শিকার হবে। কারণ বাংলাদেশের বৈদেশিক মূদ্রা রিজার্ভের যে সংকটটা সেটা আরো অনেকদিন থাকবে,” বলেন অধ্যাপক ইসলাম।
“ডলারে নির্ধারন হলে এই অবচয়নের কবল থেকে আমরা রক্ষা পেতাম। কিন্তু টাকায় হওয়াতে এইটার সুবিধাটা ভারত পেয়ে যাচ্ছে।”
মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্যের ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার ক্ষেত্রে ফি ও মাশুল এবং মূদ্রার ক্ষেত্রে টাকা নির্ধারণ নিয়ে বাংলাদেশে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বিবিসি বাংলার কাছে দাবি করেন, ট্রানজিট এবং ট্রান্সশিপমেন্টের কাজ যখন পুরোদমে শুরু হবে তখন ফি-মাশুল পুনপুনর্বিবেচনা করার সুযোগ রয়েছে।
“এনবিআর থেকে যে এসআরওটা জারী হয়েছে সেটা কিন্তু দীর্ঘদিন পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর কতটুকু কী করবো না করবো, সবকিছু মিলিয়ে কিন্তু গত কয়েকদিন আগে এটা জারি হয়েছে। যেহেতু আমাদের সঙ্গে তাদের একটা এগ্রিমেন্ট হয়ে গেছে আমরা শুরু করতে চাই,” বলেন মি. চৌধুরী।
বন্দর কতটা প্রস্তুত ?
বাংলাদেশের বন্দর ব্যবহার বাড়াতে এবং আঞ্চলিক ব্যবসা বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চট্টগ্রামকে ঘিরে ব্যাপক পরিকল্পনা করছে সরকার।
বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরের যে সক্ষমতা তাতে বছরে প্রায় ৩৫-৪০ লাখ কনটেইনার ওঠানামা করতে পারে। এছাড়া এখন গড়ে ২.৫ দিনের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরে মাল খালাস সম্ভব হচ্ছে বলে জানায় বন্দর কর্তৃপক্ষ।
ভারত পুরোদমে বন্দর ব্যবহার শুরু করলে চট্টগ্রাম বন্দরের ওপর বাড়তি চাপ পড়তে পারে। তবে বন্দর কর্তৃপক্ষের দাবি হচ্ছে, চট্টগ্রাম বন্দরের যে সক্ষমতা আছে তাতে ভারত এ বন্দর ব্যবহার করলে কোনো বাড়তি চাপ পড়বে না।
চট্টগ্রাম বন্দরের সচিব মো: ওমর ফারুক বিবিসি বাংলাকে বলেন, পতেঙ্গা টার্মিনাল তৈরি হয়ে আছে, যেখানে বছর সাড়ে চার লাখ টন কনটেইনার ওঠা নামার সক্ষমতা রয়েছে।
এ বাস্তবতায় বন্দরের সক্ষমতাও আরো বৃদ্ধি করা দরকার বলে মনে করে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী ও বন্দর ব্যবহারকারীরা।
চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাহাবুবুল আলম বিবিসি বাংলাকে বলেন,
“বে টার্মিনাল বাড়াতে হবে, জেটির সংখ্যা বাড়াতে হবে লজিস্টিক সাপোর্ট বাড়াতে হবে। যেহেতু বাংলাদেশের ইমপোর্ট আমরা করছি । সাথে সাথে যদি পার্শবর্তী দেশের ইমপোর্ট আসে তাহলে আমাদের ওপর প্রেসার পড়বে।”
চাপ কমানোর জন্য মোংলা ও চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন বলে মনে করেন মি. আলম।
চট্টগ্রাম কাস্টমস সিএন্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কাজী মাহমুদ ইমাম বলেন, ভারত বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট পুরোদমে শুরু করলে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক তৎপরতা ও কর্মসংস্থান বাড়বে। বিষয়টিকে তিনি ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন।
“ভারত কেন আমাদের পাশ্ববর্তী অন্যান্য দেশগুলোকেও যদি আমরা এ সুবিধা দেই আমরা এটাকে স্বাগত জানাবো। প্রাথমিকভাবে এটা কোনো অসুবিধা হবে বলে মনে করি না।আমরা নেক্সট জেনারেশন পোর্ট বলছি বে টার্মিনালকে। এখন এটা কতদ্রুত আমরা বাস্তবায়ন করতে পারবো সেটা নীতিনির্ধারকেদর সিদ্ধান্তের ওপরই নির্ভর করছে,” বলেন মি. ইমাম।
আঞ্চলিক উন্নয়ন
আঞ্চলিক বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে ভারতের পাশাপাশি নেপাল ও ভুটানকেও বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিতে চায় বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সমূদ্র বন্দর ব্যবহারে নেপাল ও ভুটানের আগ্রহ রয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম এটিকে ‘দূরদর্শী সিদ্ধান্ত’ হিসেবে দেখছেন। আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টি সবার জন্য ‘উইন-উইন সিচুয়েশন’ বা লাভজনক হিসেবে দেখছেন অধ্যাপক মইনুল।
অধ্যাপক মইনুল বলেন, “বাংলাদেশের এ বন্দর ব্যবহারের জন্য তারা যে ব্যয় করবে তার একটা অংশ বাংলাদেশ পাবে। এখানে ইকোনোমিক হাব গড়ে উঠলে সেখানে যে শিল্প কারখানা গড়ে উঠবে সেগুলো বাংলাদেশে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। এবং ওভারঅল ইকোনমির জন্য আমি মনে করি যে এটা ভাল একটা সিদ্ধান্ত।”
দিল্লীর বিবেকানন্দ ফাউন্ডেশনের শ্রীরাধা দত্ত বলছেন এটা আঞ্চলিক সহযোগিতার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হবে।
“এই যে এতগুলো ট্রান্সপোর্ট ফ্যাসিলিটিজ তৈরি হয়েছে, ক্রসবর্ডার ফ্যাসিলিটিস তৈরি হয়েছে তাতে তো এখানে ইকোনোমিক করিডোর না হলে তো আটকে গেল বিষয়টা তাই না। এটা শুধু ভারত-বাংলাদেশ মিলেই তো হবে না, সাবরিজিয়নও যুক্ত হবে, এটাই আমাদের ভিশন।”