ব্যাংক খাতে টান পড়েছে বাড়তি তারল্যে

দৈনিক ইত্তেফাক

অর্থনীতি রিপোর্ট
প্রকাশ : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
ব্যাংক খাতে টান পড়েছে বাড়তি তারল্যে

দেশে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য কমেছে। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাপনের খরচ বেড়ে গেছে। এ জন্য অনেকে জমানো টাকা তুলে ব্যয় মেটাচ্ছেন। আবার আমানতের কম সুদের কারণে মানুষ ব্যাংক থেকে টাকা তুলে অন্য খাতে বিনিয়োগ করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ব্যাংকিং খাতে গত জানুয়ারি মাসে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ কমেছে ৮ হাজার ১২৮ কোটি টাকা। বর্তমানে কয়েকটি ব্যাংক তারল্য সংকটে থাকলেও বেশ কিছু ব্যাংকের এই অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে।

ব্যাংকাররা বলছেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাপক ডলার বিক্রি, কম আমানতের সুদ হার, ডলারের মূল্যবৃদ্ধি, গ্রাহকের নগদ অর্থ উত্তোলনে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য কমছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুন মাসে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ২ লাখ ৩ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা। এরপর তা কমতে কমতে জানুয়ারিতে এসে ঠেকে ১ লাখ ৩৭ হাজার ৬০০ কোটি টাকায়।

একাধিক ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, ২০২২ সাল জুড়েই ব্যাংকগুলো ডলার-সংকটে রয়েছে। এই সময়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ব্যাপক ডলার কেনায় ব্যাংকগুলোর তারল্যসংকট দেখা দেয়। এছাড়া কিছু ব্যাংকের ঋণ অনিয়মের তথ্য প্রকাশ হওয়ায় গ্রাহকের নগদ তারল্য ওঠানো ব্যাপক বেড়েছে, যার কারণে উদ্বৃত্ত তারল্য কমেছে।

তারা আরও বলেন, সাধারণত ব্যাংকগুলো সরকারি বিল-বন্ডের রেট বেশি হলে অতিরিক্ত তারল্য দিয়ে বিনিয়োগ করে। আবার বিল-বন্ডের রেট কমে গেলে বিনিয়োগের পরিমাণও কমে যায়। গত ১৫ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক নতুন মুদ্রানীতিতে ভোক্তা ঋণের সুদ হার ৯ শতাংশ থেকে ১২ শতাংশ হয়েছে। যার কারণে অনেকের বিল-বন্ডে বিনিয়োগ ম্যাচিউরিটি হওয়ায় নতুন করে বিনিয়োগ করেনি। এ কারণেও অতিরিক্ত তারল্য কমেছে। সংবিধিবদ্ধ তারল্য অনুপাত (এসএলআর) এবং নগদ রিজার্ভ অনুপাত (সিআরআর) বজায় রাখার পর অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়।

নগদ আকারে মোট আমানতের ৪ শতাংশ সিআরআর এবং নন-ক্যাশ আকারে ১৩ শতাংশ এসএলআর বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে রাখা ব্যাংকগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৯১-দিনের ট্রেজারি বিলগুলোর জন্য একটি নিলাম ডাকে, যেখানে ইল্ড রেট ছিল ৬ দশমিক ৮৪ শতাংশ, যা জানুয়ারির ৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ থেকে কম। ব্যাংকগুলো সেসব বিলে বিনিয়োগের জন্য নিলামে অংশ নেয়, যার মাধ্যমে সরকার বাজেটে ব্যয়ের জন্য ঋণ নেয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুসারে, পাঁচ বছরের ট্রেজারি বন্ডের ইল্ড রেট ফেব্রুয়ারিতে ৮ দশমিক ২০ শতাংশে নেমে এসেছে, জানুয়ারিতেও এই হার ছিল ৮ দশমিক ২৯ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২২ সালের জুন শেষে সরকারের ব্যাংকগুলোর কাছ থেকে সিকিউরিটিজ হিসেবে দায়ের পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ২২ হাজার কোটি টাকা। ডিসেম্বর শেষে এর পরিমাণ কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৭২ হাজার কোটি টাকা। এই ছয় মাসে সরকারের ব্যাংকগুলোর কাছে দায় কমেছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকারের সিকিউরিটিজ হিসেবে দায়ের পরিমাণ কমেছে, অর্থ হচ্ছে সরকার বেশি ঋণ পরিশোধ করছে। চলতি অর্থবছরের সাত মাসে সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ৪৬ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে। সরকার এই ঋণ নিয়ে ব্যাংকগুলোকে আগের ১১ হাজার কোটি টাকা ঋণ পরিশোধ করেছে। তিনি আরও বলেন, চলতি অর্থবছরের ঘাটতি মেটাতে সরকারের ব্যাংকিং খাত থেকে ঋণ নেওয়ার কথা রয়েছে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকা। এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো থেকে নিট ঋণ না নিয়ে উলটো ১১ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। যার অর্থ ব্যাংকগুলোর তারল্যসংকট থাকায় সরকার ঋণ নিচ্ছে না।

বৈদেশিক মুদ্রা বাজারকে স্থিতিশীল করতে এবং ব্যাংকগুলোকে তাদের আমদানি ব্যয়ে বাধ্যবাধকতা পূরণে সহায়তার জন্য ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সময়ে আর্থিক ব্যবস্থায় ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি প্রদান করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলার বিক্রির ফলে ফেব্রুয়ারির ১৫ তারিখে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩২ দশমিক ৬০ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে, ২০২১ সালের আগস্টেও এটি ছিল রেকর্ড ৪৮ দশমিক ৬ বিলিয়ন ডলার।