ঢাকা
জানুয়ারি থেকে টানা আট মাস মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। এর মধ্যে আগস্টে ১১ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ ৯.৫২ শতাংশে ওঠে মূল্যস্ফীতি।
শেষ হয়ে আসা ২০২২ সালে দেশে মূল্যস্ফীতি যেন বড় পীড়াদায়ক খলনায়কে পরিণত হয়েছে। সবচেয়ে স্বস্তির এই সূচকও বছরজুড়ে বেশ খারাপ আকার ধারণ করে। এর মধ্যে ১১ বছর ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা গেছে গত আগস্টে। ওই মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ। এখনো মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে।
সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছে এই উচ্চ মূল্যস্ফীতি। বাজারে গিয়ে মানুষ ভুগেছেন। কখনো চালের দাম বেড়েছে। কখনোবা তেলের দাম আকাশচুম্বী হয়েছে। আবার কখনো ডিমের ডজন দেড় শ টাকা ছাড়িয়েছে। এভাবেই বছরজুড়ে মূল্যস্ফীতি মানুষের জীবনযাপনকে কঠিন করে তুলেছে।
অথচ এক যুগ ধরে দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে সবচেয়ে শক্তিশালী ও স্থিতিশীল সূচক মূল্যস্ফীতির। দীর্ঘ এই সময়ে মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশের আশপাশেই ছিল। তবে কোভিড–পরবর্তী চাহিদা ও চলতি বছরের শুরু থেকেই বিশ্ববাজারে নিত্যপণ্য ও শিল্পের কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি পাওয়ায় স্থানীয় পর্যায়ে পণ্যের দাম বাড়তে থাকে। এর মধ্যে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ সেটিকে আরও উসকে দেয়। আবার বছরের মাঝামাঝি সময় থেকে মার্কিন ডলারের দাম বাড়তে থাকে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়ে। ফলে আরেক দফা নিত্যপণ্যের দাম বাড়ে।
কয়েক বছর ধরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সরকারের একটি সাফল্য হিসেবে বিবেচিত। যদিও মূল্যস্ফীতির তথ্য-উপাত্ত নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) প্রতি মাসে যে মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করে, তার চেয়ে বাস্তবে মূল্যস্ফীতির চাপ অনেক বেশি—এমনটা মনে করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষক তৌফিকুল ইসলাম খান প্রথম আলোকে বলেন, দেড় যুগ আগের পুরোনো ভিত্তিবছর ধরে হিসাব করায় মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না। তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহেও দুর্বলতা আছে। কারণ, বিবিএস ও ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) তথ্যের মধ্যে গরমিল আছে।
দেড় যুগ আগের পুরোনো ভিত্তিবছর ধরে হিসাব করায় মূল্যস্ফীতির প্রকৃত চিত্র উঠে আসছে না। তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহেও দুর্বলতা আছে। কারণ, বিবিএস ও ট্রেডিং করপোরেশনের (টিসিবি) তথ্যের মধ্যে গরমিল আছে।
তৌফিকুল ইসলাম খান মনে করেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতির এই সময়ে গরিব মানুষের জন্য আলাদাভাবে হিসাব করা প্রয়োজন। তাঁদের চিত্র পাওয়া গেলে সরকারি সহায়তা দেওয়া সহজ হবে। উচ্চ মূল্যস্ফীতিতে মানুষের প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে।
১১ বছর ৩ মাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি
গত আগস্ট মাসে অকটেন, পেট্রল, ডিজেলসহ সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম ৪২ থেকে ৫১ শতাংশ বাড়ানো হয়। এর আগে একলাফে জ্বালানি তেলের দাম এত বাড়ানো হয়নি। তখন থেকেই উচ্চ মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা করা হয়। শুরু হয় মধ্যবিত্তের নতুন লড়াই। প্রথমেই পরিবহন খরচ বাড়ে। এ কারণে নিত্যপণ্যের দামও বেড়েছে। আবার জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে উৎপাদন খরচ বেড়ে যায়। ফলে মধ্যবিত্তের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়ে। এমন অবস্থায় গত আগস্ট মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়ে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশে ওঠে, যা গত ১১ বছর ৩ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। ২০১১ সালের এপ্রিলের পরে এত বেশি মূল্যস্ফীতি ঘটেনি।
টানা আট মাস মূল্যস্ফীতি বেড়েছে
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এখন পর্যন্ত চলতি বছরের প্রথম ১১ মাস, অর্থাৎ জানুয়ারি–নভেম্বরের মূল্যস্ফীতির তথ্য প্রকাশ করেছে। এতে দেখা গেছে, জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত টানা প্রথম আট মাস মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। জানুয়ারি মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৫ দশমিক ৮৬ শতাংশ। এরপর প্রতি মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল—এই তিন মাস মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশে এবং মে, জুন ও জুলাই মাসে ৭ শতাংশের মধ্যে ছিল। আর আগস্ট ও সেপ্টেম্বর—এই দুই মাসে মূল্যস্ফীতি ৯ শতাংশের ওপরে থাকে। আর গত দুই মাসে মূল্যস্ফীতি ৮ শতাংশে ওঠে। তবে তিন মাস ধরে খাদ্যবহির্ভূত মূল্যসূচক ১০ শতাংশের কাছাকাছি রয়েছে; যা নতুন চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
বাজেটেই মূল্যস্ফীতির শঙ্কা শুরু
মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে—এমন শঙ্কা ছিল নীতিনির্ধারকদের। গত জুন মাসে চলতি ২০২২–২৩ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণার সময় একটি নীতি বিবৃতি দেওয়া হয়। সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ে বলা হয়েছে, সাম্প্রতিক সময়ে বৈশ্বিক সরবরাহব্যবস্থায় একটি বড় মাপের অভিঘাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। যার কারণে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে এবং একই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে কোভিড–পরবর্তী পুনরুদ্ধার বিঘ্নিত হতে পারে। ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণ এবং পরবর্তী সময়ে রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা বিশ্বব্যাপী জ্বালানি সরবরাহকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
নীতি বিবৃতিতে আরও বলা হয়, রাশিয়া বিশ্বের প্রায় ১০ শতাংশ জ্বালানি সরবরাহ করে। এর মধ্যে ১৭ শতাংশ প্রাকৃতিক গ্যাস ও ১২ শতাংশ তেল। তেল ও গ্যাসের দামের ঊর্ধ্বগতি শিল্প খাতে উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি করবে। ভোক্তাদের প্রকৃত আয় কমিয়ে দেবে। বিশ্বে একটি রেকর্ড পরিমাণ উচ্চ মূল্যস্ফীতি ইতিমধ্যে দৃশ্যমান হয়েছে, বাংলাদেশও যার প্রভাব থেকে মুক্ত নয়।
এই নীতি বিবৃতিটি প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই মিলে গেছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের প্রকৃত আয় কমেছে। তেল ও গ্যাসের দামের ঊর্ধ্বগতি শিল্পপণ্যে উৎপাদন খরচ বাড়িয়েছে। প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। জীবনযাত্রা আরও বেশি ব্যয়বহুল হয়ে গেছে।