ঢাকা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ৪২ মাসে সাত কিস্তিতে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ দেবে বাংলাদেশকে। তার মধ্যে প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে কোনো শর্ত ছাড়া। প্রথম কিস্তির ৪৫ কোটি ৪৫ লাখ ৩১ হাজার ডলার বাংলাদেশ পাবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে।
তবে পরের কিস্তিগুলো পেতে হলে সংস্থাটির দেওয়া শর্ত পূরণ করতে হবে বাংলাদেশ সরকারকে। শর্তের মধ্যে অন্যতম আর্থিক খাতের সংস্কার। এর মধ্যে রয়েছে ব্যাংক খাত ও রাজস্ব খাত। সম্ভাব্য শর্তগুলো পূরণ না করলে কিস্তির অর্থ দিতে দেরি, এমনকি আটকেও দিতে পারে আইএমএফ। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
আইএমএফের এশিয়া ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দের নেতৃত্বাধীন দল এরই মধ্যে দুই সপ্তাহের আনুষ্ঠানিক সফর শেষ করেছে। গতকাল বৃহস্পতিবার সংস্থাটি বৈঠক করেছে দেশের বেসরকারি তিনটি গবেষণা সংস্থার সঙ্গে।
এগুলো হচ্ছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি), পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (পিআরআই) এবং সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)। সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফ দল বিভিন্ন পরামর্শ দিলেও তিন গবেষণা সংস্থার কাছে উল্টো পরামর্শ চেয়েছে।
বৈঠক সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশকে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে আইএমএফ ইতিবাচক। পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করতেও তারা নারাজ। বাংলাদেশের সঙ্গে ঋণ কর্মসূচিটি সফলভাবে করতে যাচ্ছে বলে আইএমএফ দল খুশি।
এদিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, সরকারি দপ্তরগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে আইএমএফের দল যা যা পেয়েছে, তা প্রতিবেদন আকারে তুলে ধরবে ওয়াশিংটনে আইএমএফের পরিচালনা পর্ষদের কাছে। এরপর বাংলাদেশকে দেওয়া শর্তগুলো সংস্থাটি গণমাধ্যমে প্রকাশ করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর সালেহউদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নিজের দেশের লোকেরা এত দিন সংস্কারের কথা বলে এলেও সরকার তা কানে নেয়নি। আইএমএফের কথা শুনে এখন সংস্কারে মনোযোগ দেবে। ভালো হলো যে এখন অন্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলোকে বাংলাদেশের জন্য ঋণ অনুমোদন করতে তেমন সমীক্ষা করতে হবে না। কারণ, মৌলিক কাজগুলো আইএমএফ করে দিচ্ছে।
সালেহউদ্দিন আহমেদ আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সামষ্টিক অর্থনীতির যে স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে, তা মোকাবিলায় অর্থ দিচ্ছে আইএমএফ। এ অর্থ অপচয় করা যাবে না। করলে ঋণটা বোঝা হয়ে যাবে। আর আর্থিক খাত সংস্কারে শুধু বাংলাদেশ ব্যাংক নয়, অন্য সংস্থাগুলোকেও ভূমিকা পালন করতে হবে। সমন্বিত পদক্ষেপ ছাড়া সংস্কার অসম্ভব।
জানা গেছে, প্রতিটি কিস্তি দেওয়ার আগে আইএমএফের একটি মিশন আসবে ঢাকায়। এটাই তাদের নিয়ম। কিস্তি ছাড়ের আগে সফরে এসে তারা দেখবে শর্তগুলো ঠিকঠাকভাবে পূরণ হচ্ছে কিনা। ফিরে গিয়ে আইএমএফের পর্ষদে আবার প্রতিবেদন দাখিল করা হবে মিশনের পক্ষ থেকে। শর্ত পূরণ না হলে তখন পরের কিস্তির অর্থ আটকেও দিতে পারে আইএমএফ।
অর্থ বিভাগের সূত্রগুলো জানায়, আইএমএফের শর্ত পূরণ সরকারের জন্য তেমন কঠিন হবে না। কারণ, ব্যাংক ও আর্থিক খাতে নতুন আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইন সংশোধনের কিছু কাজ এমনিতেই করা হচ্ছে। মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) তুলনায় রাজস্ব সংগ্রহের হার যে কম, তা অস্বীকার করার কিছু নেই। আইএমএফ তাগিদ দিচ্ছে রাজস্ব-জিডিপি হার বাড়াতে। সরকার নিজেও তা চায় এবং এ জন্য কাজও চলছে।
রাজস্ব সংগ্রহ বৃদ্ধির জন্য সরকার ইতিমধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বলে গত বুধবার সাংবাদিকদের জানান অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। অর্থমন্ত্রী ওই দিন বলেন, ‘ভ্যাট আদায়ে ৬ হাজার ৭৩২টি ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস (ইএফডি) বসানো হয়েছে। আগামী বছরে আরও ৬০ হাজার মেশিন বসবে। পরের চার বছরে মেশিন বসবে ২ লাখ ৪০ হাজার।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারও বুধবার বলেন, অর্থমন্ত্রী চলতি অর্থবছরের বাজেটে জাতীয় সংসদে যেসব সংস্কার প্রস্তাব দিয়েছেন, এগুলো প্যাকেজ আকারে আইএমএফের কাছে তুলে ধরা হবে। আইএমএফও সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছে।
ব্যাংক খাত সংস্কারের মধ্যে খেলাপি ঋণ ১০ শতাংশের মধ্যে রাখা, রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি সংশোধন করা, বছরে চারবার মুদ্রানীতি করা ইত্যাদি কাজ করতে আপাতত সম্মত হয়েছে সরকার।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আইএমএফ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়া যাবে চার বছরে। আগামী ফেব্রুয়ারিতে যে প্রথম কিস্তি পাওয়া যাবে, তার আগে ওই কিস্তির দ্বিগুণের বেশি পরিমাণ রিজার্ভ কমে যাবে। গত ছয় মাসের প্রবণতা হচ্ছে, প্রতি মাসেই ১০০ কোটি ডলার করে রিজার্ভ কমছে। তাই ঋণের ওপর পুরো ভরসা না করে বা ঋণ পাওয়া যাচ্ছে বলে স্বস্তিতে না থেকে অপ্রয়োজনীয় কিছু প্রকল্প থেকে সরকারের সরে আসা উচিত।